কুমিল্লার “মাফিয়া ডন” মামুন, ইয়াবা যার পারিবারিক ব্যবসা

ডেস্ক রিপোর্টঃ কুমিল্লার বুড়িচংয়ের আকাবপুর গ্রাম। এই গ্রামের সামান্য সরকারী অফিস কর্মচারী আব্দুল মান্নান। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, কুমিল্লা অফিসের পিয়ন পদে চাকুরী শেষে অবসরে গিয়ে বছর তিনেক আগে মারা যান। সংসারে ৪ ছেলে ৫ মেয়ে। বর্তমানে পরিবারের কমবেশী প্রায় সবাই মাদক ব্যবসায় জড়িত। আর এই মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে তাদের ভাগ্যের চাকা দ্রুত বদলে ফেলেছেন । বাড়ি,গাড়ি,জমিসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে কোটি কোটি টাকার মালিক তারা। বিভিন্ন ব্যবসার আড়ালে মাদক ব্যবসাকে নিরাপদ রাখতে চালু করেছেন বিভিন্ন কৌশল। বিভিন্নস্থানে নিয়োগ করেছেন বেতনভোগী সোর্স। অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কিছু অসাধূ লোকজন তাদের থেকে নিচ্ছেন মাসোয়ারা। আগে পরিবারের লোকজন হেরোইন ব্যবসার সাথে জড়িত থাকলেও হালে এখন কুমিল্লার অলিখিত “মাফিয়া ডন” ইয়াবা ডিলার।

সরেজমিন স্থানীয় বিভিন্ন সুত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়,কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়নের আকাবপুর গ্রাম। এই গ্রামের আব্দুল মান্নান। সংসারে রয়েছে ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন, মিজানুর রহমান, মানিক মিয়া ও মাসুম আর কন্যা হাসু, নাছিমা, স্বপ্না, রত্না ও সুমী। অভাবের সংসারে সন্তানদের শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ হয়নি দরিদ্র পিতার। ফলে স্কুলের গন্ডি পেরুতে পারেনি ছোট ছেলে মাসুম ছাড়া অন্য কেউ।

দায়িত্বশীল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুত্র জানায়, বর্তমানে জেলার অন্যতম মাফিয়া ডন আব্দুল্লাহ আল মামুন ও মিজানুর রহমান দু’জনেই রাজনৈতিক ও জনপ্রতিনিধির লেবাসধারী। মিজান ময়নামতি ইউনিয়নের বর্তমানে নির্বাচিত ইউপি সদস্য।

সুত্র আরো জানায়,মামুন ও মিজান বিগত শতাব্দির মাঝামাঝি সময় থেকে হেরোইন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। এর পেছনে রয়েছে মজার তথ্য। মিজান বিয়ে করে যশোহরের বেনাপোল এলাকায়। শ্বশুরবাড়িতে আসা-যাওয়ায় একসময় পরিচয় ঘটে বেনাপোল এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে। সেসময় হেরোইন পাচাঁরের অন্যতম রুট ছিল বেনাপোল। মিজান এই সুযোগ কাজে লাগায়। এরপর থেকে আর এই পরিবারটিকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

স্থানীয় সুত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মামুন ও মিজান হেরোইন ব্যবসা শুরুর পর তার মা মোহছনা খাতুন তাদের মাদক পাচাঁরে সহযোগীতা শুরু করে। বিভিন্ন গন্তব্যে হেরোইন পৌঁছে দিতে মা ছিল তাদের বিশ্বস্ত বাহক। একপর্যায়ে তার বোনেরাও কিছু সময় সহযোগী হিসেবে কাজ করতো। পরবর্তীতে তারা অপর ভাই মানিককেও এর সাথে জড়িয়ে ফেলে। কক্সবাজার, বান্দরবান থেকে বিভিন্ন সোর্স কখনোবা নিজেরাই মাইক্রোবাস, কাভার্ডভ্যান বা ট্রাকে করে ইয়াবা নিয়ে আসে কুমিল্লায়। এরপর সময় সুযোগমত পাচাঁর করছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও স্থানীয় বিক্রেতাদেরও কাছে।

সুত্র মতে এলাকায় ইয়াবা ব্যবসা নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে তারা গড়ে তোলে কমপক্ষে অর্ধ শতাধিক খুচরা ইয়াবা বিক্রেতার সিন্ডিকেট। মামুন তার স্ত্রী জুলিয়া,মিজান স্ত্রী নাসরিন সহ তাদের সাথে বিগত সময়ে একাধিকবার স্থানীয় মহিলা ইউপি সদস্য পদে নির্বাচনে পরাজিত রেহানা আক্তার, তার চালকসহ বেশ ক’জন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়ে কুমিল্লা, ঢাকা কাশিমপুর, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ছিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সুত্র জানায়, বিগত সময়ে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশের হাতে মামুন হেরোইনসহ হেরোইন মাপার নিক্তি-পাল্লাসহ আটক হয়েছিল। ২০০৮ সালে পুলিশের হাতে, গত কিছুদিন আগে ইয়াবা সহ ঢাকায় আটক হয় মামুন তার চালক ও রেহানা নামের এক নারী। ঠাই হয় কাশিমপুর কারাগারে। প্রায় ২০ দিন আগে জামিনে বেরিয়ে আসে মামুন। এখনো কারাগারে আটক চালকসহ রেহানা। এরই মাঝে গত ১৯ মার্চ চট্টগ্রাম বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওয়াজেদিয়া মোড় এলাকা থেকে ট্রাকসহ চট্টগ্রাম ডিবি পুলিশের একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ৬৩ হাজার পিছ ইয়াবাসহ মিজান, গাড়ি চালক বুড়িচং উপজেলার মোকাম ইউনিয়নের কোরপাই এলাকার আবুল বাশার ও সহযোগী বুড়িচং উপজেলার ভারেল্লা (উত্তর) ইউনিয়নের পশ্চিম সিং গ্রামের জসিম নামের ৩ জনকে আটক করে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে লালদীঘি এলাকা থেকে আটক হয় আব্দুল্লাহ আল মামুন ও তাহের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল সুত্র জানায়, আটকের পর মামুন তার ঠিকানা ভূল উল্লেখ করে। পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সুত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান,২০১৬ সালে পুলিশ তাকে আকাবপুর গ্রামে মাদকসহ আটক করলে তার সহযোগীরা পুলিশের উপর হামলা করে হ্যান্ডকাফসহ তাকে ছিনিয়ে নেয়। পরদিন গোপন দফারফা করে হ্যান্ডকাফ ফেরত দিলেও অধঁরা থেকে যায় মামুন।

মাফিয়া ডন এই মিজান-মামুন পরিবার সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য হচ্ছে সামান্য অফিস কর্মচারী পিতার সন্তানরা মাদক ব্যবসার আড়ালে কামিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।

সুত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরো জানায়, বর্তমানে মামুন-মিজানগংরা নিজেদের মাদক ব্যবসা নিরাপদ রাখতে দেশের অন্যতম বৃহৎ কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার মোকাম ইউনিয়নের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে নিমসার কাচাঁমালের বাজারটি সম্প্রতি সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকায় ইজারা নেয়।

দায়িত্বশীল সুত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতিদিন তরকারীর বড় বড় ঝুঁড়ির ভিতর থাকা মিষ্টি কুমড়ো, লাউ, চালকুমড়া ছাড়াও অন্যান্য তরকারীর ঝুঁড়িতে করে প্রতিদিন নিমসার বাজার থেকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ পাচাঁর করছে লাখ লাখ পিছ ইয়াবা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি গোয়েন্দা সুত্র জানায়, নিমসার বাজার থেকে ট্রাক বা কাভার্ডভ্যানে করে পাচাঁর হওয়া মাদক নিরাপদ রাখতে মহাসড়কের একাধিকস্থানে বিপুল অংকের টাকা দিতে হচ্ছে। সর্বশেষ ঢাকার কারওয়ান বাজারে প্রবেশের পর রাতের আধাঁরে সেখান থেকে মাদক সিন্ডিকেটের লোকজন তাদের পছন্দের লোকজন দিয়ে নির্ধারিত গন্তেব্যে নিয়ে যান ইয়াবা।

স্থানীয় দায়িত্বশীল সুত্র আরো জানায়, মামুন-মিজান গং তাদের ইয়াবা ব্যবসা নিরাপদ রাখতে নিমসার কাচাঁবাজার ইজারা ছাড়াও নিমসার সিএনজি অটোরিক্সা স্ট্যান্ড, ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট লেগুণা ষ্ট্যান্ড, কংশনগর সিএনজি অটোরিক্সা ষ্ট্যান্ডও নিজস্ব লোকজন দিয়ে ইজারা নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনদেও গতিবিধি ও চলাচল মনিটরিংসহ সময় সুযোগমত বিভিন্ন যানবাহনে করে নানা গন্তেব্যে ইয়াবা পৌঁছে দিচ্ছে।

কংশনগর এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, মামুন রাজনৈতিক নেতা, তার ভাই মিজান মেম্বার জনপ্রতিনিধি। তারা তাদের বউসহ পরিবারের লোকজনদের নিয়ে মাদকের ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছে। তিনি আরো বলেন,সম্প্রতি মামুন-মিজান মাদক পাচাঁর নিরাপদ রাখতে দু’টি মাইক্রোবাস ও একটি ট্রাক ক্রয় করেছে। বর্তমানে ওই বাহন ৩’টি দিয়েই অবাধে ইয়াবা পাচাঁর করছে। এদিকে গত ১৯ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিবি) বন্দর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ পিপিএম এর দিক নির্দেশনায় অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিবি) পশ্চিম এ এ এম হুমায়ুন কবীরের নেতৃত্বে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে একটি দল চট্টগ্রাম মহানগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওয়াজেদিয়া মোড় এলাকায় একটি ট্রাক থামায়। তখন ট্রাক থেকে আটক করা হয় কুমিল্লা ময়নামতি ইউনিয়নের ইউপি সদস্য জেলার অন্যতম মাফিয়া ডন ইয়াবা সম্রাট মিজান মেম্বার, তার অবৈধ ব্যবসার বিশ্বস্ত পাচাঁরকারী ট্রাক চালক আবুল বাশার ও অন্যতম বিশ্বস্ত সহযোগী জসিমকে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ট্রাকের পিছনের চাকার সাথে বিশেষ কৌশলে রাখা অবস্থা থেকে উদ্ধার হয় ৬৩ হাজার পিছ গোলাপী রংয়ের নিষিদ্ধ ইয়াবা এবং নগদ ১০ লাখ টাকা। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ওই দিন রাত সাড়ে ১১ টায় চট্টগ্রামের লালদীঘি এলাকার জেলা পরিষদ ভবনের সামনে থেকে আটক করা হয় মিজান মেম্বারের প্রধান সহযোগী আপন সহোদর আব্দুল্লাহ আল মামুন ও তাহের নামের অপর এক সহযোগীকে।

চট্টগ্রামে আটক মামুন ও মিজান সহ ৫ জন

পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, বান্দরবান থেকে তারা কুমিল্লার নিমসার বাজার এলাকায় এই ইয়াবার চালান নিয়ে যাচ্ছিল। আর সেখান থেকে তরকারী বোঝাই ট্রাক,কাভার্ডভ্যানসহ অন্যান্য যানবাহনে করে ইয়াবার চালান পৌঁছে দিচ্ছে ঢাকার কারওয়ান বাজারে। চট্টগ্রামে আটক ইয়াবার মূল্য প্রায় ১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল সুত্র জানায়,আটকের পর মিজান ও মামুন আপন ভাই হলেও ভিন্ন পরিচয় দেয় ডিবি পুলিশের কাছে। মিজান বাবার নামসহ সঠিক ঠিকানা ব্যবহার করলেও আব্দুল্লাহ আল মামুন কুমিল্লা সদর উপজেলার দূর্গাপুর উত্তর ইউনিয়নের শাসনগাছা এলাকায় তার ঠিকানা উল্লেখ করে। এঅবস্থায় মাফিয়া সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণকারী দু-ভাই তথ্য গোপন করে দ্রুত জামিনে বের হয়ে আবারো ইয়াবা ব্যবসায় নিজেদের জড়িয়ে ফেলার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় অনেকেই।

এছাড়াও বুড়িচং থানার এক পুলিশ অফিসার নাম গোপনের শর্তে জানান, বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি, মোকাম, ভারেল্লা উত্তর ও দক্ষিণ ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে ইয়াবা। বেচাঁ-কেনার পাশাপাশি অবাধে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য লোক ইয়াবা নেশায় আসক্তির কারণে শত শত অভিভাবক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। পুলিশ মাঝে মাঝে কিছু ইয়াবা উদ্ধারসহ দু/একজনকে আটক করলেও মূল ব্যবসায়ীরা রয়ে যাচ্ছে ধঁরাছোঁয়ার বাইরে।

এদিকে দায়িত্বশীল একটি সুত্র জানায়, গত শুক্রবার পুলিশ মামুন-মিজান সিন্ডিকেটের ৩ সদস্যকে কুমিল্লা টিক্কাচর ব্রীজ এলাকা থেকে আটক করেছে। তারা হলো, শাহীন ভূইয়া, সোহেল ও ফরহাদ হোসেন।

আরো পড়ুন