কুমিল্লার অজপাড়াগাঁয়ে আলিশান ‘মাদকবাড়ি’

ডেস্ক রিপোর্টঃ কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার নবীয়াবাদ সীমান্তের ‘নো ম্যানস ল্যান্ডের’ দিকে যাওয়ার পথে সিন্দুরিয়া সেতুর সামনে পুলিশের একটি দল যানবাহন ও মোটরসাইকেল তল্লাশি চালাচ্ছে। এর লক্ষ্য যাতে সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে কোনো মাদকদ্রব্য প্রবেশ করতে না পারে। সিন্দুরিয়া সেতু থেকে দুই কিলোমিটার দূরে একটিই মাত্র পথে যাওয়া যায় নবীয়াবাদ ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’।

সীমান্তে পৌঁছার পর দেখা গেল পিলারের পাশেই বসে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) এক সদস্য পাহারা দিচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে বসে আছেন এক ব্যক্তি। জানা গেল, এই ব্যক্তি মাদকপাচারের একজন ‘লাইনম্যান’। তিনি হাতের ইশারায় বিজিবি সদস্যের সামনেই এই প্রতিবেদককে ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে’ মাদকের আস্তানায় যাওয়ার আহ্বান জানালেন।

‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ এলাকা থেকে ফেরার পথে মাত্র আধাকিলোমিটার আসার পর বিলাসবহুল একটি বাড়ির ওপর চোখ আটকে গেল। ভেতরে ঢুকতেই মো. হুমায়ুন পরিচয় দিয়ে একজন জানালেন বাড়িটি তাঁর ছোট ভাই মো. মহসিনের।

বাড়িটিতে কয়েকটি এয়ার কন্ডিশনার (এসি) লাগানো আছে, গাড়ি রাখার জন্য আছে বিলাসবহুল পার্কিং। জানা গেল, বাড়িটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা মাদক বিক্রেতাদের তালিকাভুক্ত বুড়িচংয়ের উত্তর চড়ানলের মো. মহসিন আলীর। কুমিল্লা ৮৬ জন পাইকারি ও খুচরা মাদক কারবারির এই তালিকায় নেই আরো বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির মালিক ওই এলাকার শংকুচাইলের জসিম উদ্দিন ওরফে মামা জসিম ও মো. বিল্লাল, জগতপুরের কামাল হোসেন ওরফে ফেন্সি কামালদের নাম।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা ধরে মাদক কারবারিদের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে গত মঙ্গলবার দিনভর বুড়িচং উপজেলায় ঘুরে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। মাদকবিরোধী অভিযান চলমান থাকলেও সেখানে প্রকাশ্যেই চলছে মাদকদ্রব্য বেচাকেনা।

নবীয়াবাদ সীমান্তের কাছে উত্তর চড়ানল এলাকার মহসিনের বড় ভাই পরিচয় দেওয়া হুমায়ুন জানান, তাঁর ভাই (মহসিন) ছয় মাস ধরে মাদক কারবার করেন না। তাঁর নামে মামলা থাকায় তিনি পলাতক।

হুমায়ুন জানান, মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর দ্বিতীয় দিন মহসিনের স্ত্রী মিনু বেগমকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।

জানা গেছে, উত্তর চড়ানলে কোটি টাকা খরচ করে ডুপ্লেক্স বাড়ি করলেও মহসিন থাকেন নারায়ণগঞ্জে। সেখানেও তাঁর স্ত্রী রয়েছে। মহসিন সীমান্ত থেকে মাদক নিয়ে পাইকারি বিক্রি করেন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জগতপুরের কামাল হোসেন ওরফে ফেন্সি কামাল এলাকায় বিপুল সম্পত্তির মালিক। বাড়ি, স্কুল, গাছের বাগান—সব কিছুই রয়েছে তাঁর। শুধু নেই প্রকাশ্য কোনো ব্যবসার নাম। এলাকায় সবাই তাঁকে ভালো লোক বলেই জানে। কারণ মাদকের টাকায় গড়া স্কুলে তিনি এলাকায় শিশুদের বিনা মূল্যে পড়ান। তিনি উপজেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি। মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর কামাল পালিয়ে চলে যান ভারতে।

জানা গেছে, কামাল বর্তমানে আজমিরে অবস্থান করছেন। সেখান থেকে তিনি যাবেন সৌদি আরবের জেদ্দায়, তাঁর বড় ভাই বাহার মিয়ার কাছে। কিভাবে যাবেন? এমন তথ্য জানতে চাইলে একটি সূত্র জানায়, ভিসা হয়েছে। কলকাতা থেকে ঢাকা বিমানবন্দর এবং ঢাকা বিমানবন্দর থেকে সৌদি আরব। কিভাবে সম্ভব—এই প্রশ্নের উত্তরে সূত্রটি জানায়, ভারতে যেভাবে গেছে সেভাবে।

জগতপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার হাজী মার্কেটের অর্ধেক, জগতপুর উদয়ন একাডেমি ও তার পাশে একতলা বাড়ি, বাড়ির পাশের কয়েক একর বাগান ও কয়েকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক কামাল হোসেন ওরফে ফেন্সি কামাল। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই কথা হয় ফেন্সি কামালের ভাবি ও সৌদি আরবে অবস্থানরত বাহার মিয়ার স্ত্রী সেলিনা বেগমের সঙ্গে। কৌশলে শেলী বেগম সেলফোনে তাঁর স্বামীকে ও কামালকে ভিডিও কলে সংযুক্ত করে রাখেন।

জানতে চাইলে শেলী বেগম বলেন, বাড়ি, স্কুল, মার্কেট ও বাগান তাঁর স্বামীর বাহার মিয়ার। সৌদি থেকে পাঠানো টাকায় এসব কিনেছেন তাঁরা। কামাল ও কামালের স্ত্রী, সন্তানরা কোথায় আছে তিনি তা জানেন না। মামলা আছে তাই তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন। কামালের কিছু নেই, এমন দাবি করে তিন বলেন, ‘সে কিছু করে না।’ সেল ফোনে কে লাইনে আছে জানতে চাইলে বলেন, তাঁর স্বামী বাহার মিয়া।

পরে বাহার মিয়া জানান, তাঁর ভাই কোথায় আছেন তিনি জানেন না। জায়গা জমি সবই তাঁর।

কামাল কবে আপনার কাছে যাবেন জানতে চাইলে বাহার মিয়া বলেন, ‘এটা আমি জানি না।’

জানা গেছে, পাইকারি মাদক বিক্রেতা ফেন্সি কামাল সীমান্ত থেকে মাদক এনে তাঁর নিজের বাড়িতে মজুদ করেন। তারপর কংশনগর এলাকা দিয়ে ঢাকায় মাদক পাচার করেন তিনি। একাধিক মামলা থাকলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ‘ম্যানেজ’ করে চলায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় তাঁর নাম নেই।

জসিম উদ্দিন ওরফে মামা জসিম পাঁচ-ছয় বছর আগেও বাইসাইকেলে করে সীমান্ত দিয়ে চিনি, ডাল, জিরা আনতেন। তিনি এখন বুড়িচং বাজারে তিনতলা শপিং কমপ্লেক্স, ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক। র‌্যাব ও পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার কিংবা মামলা থাকলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় তাঁর নাম নেই।

জানা গেছে, মামা জসিম ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি মাদকের হাট হিসেবে কুখ্যাত ঢাকার আমিন বাজারে গাঁজা সরবরাহ করেন। অভিযান শুরুর আগেই খবর পেয়ে মালয়েশিয়া চলে যান জসিম।

শংকুচাইলের দক্ষিণপাড়ায় দিঘির পাশে বিল্লালের বিলাসবহুল বাড়ি। তিনি ফেনসিডিল ও গাঁজা পাচার করেন। র‌্যাবের গাড়িতে আগুন দেওয়ার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। বাড়ি ছাড়াও গাড়ি ও কয়েকটি দোকানের মালিক তিনি।

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ

আরো পড়ুন