কুমিল্লায় টমেটো চাষে বিপর্যয়, কৃষকরা পথে বসার উপক্রম

মারুফ আহমেদঃ কুমিল্লার দাউদকান্দির টামটা গ্রাম। গ্রামের প্রায় পুরো ফসলী জমিতে শুধুই টমেটোর চাষ। টামটা ও এর আশপাশ এলাকার কমপক্ষে ৫ হাজার একর জমিতে শত শত কৃষক কিছুদিন আগেও স্বপ্ন দেখেছিল টমেটো তুলে লাভের মুখ দেখার । কিন্তু স্থানীয়ভাবে ‘পোড়া’ বা ডায়রিয়া নামের এক রোগে আক্রান্ত হয়ে শত শত একরের টমেটো গাছ শুকিয়ে মড়ে যাচ্ছে। কৃষকদের অভিযোগ,জেলা বা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কোন কর্মকর্তা বা মাঠ পর্যায়ের কেউ কখনো তাদের চাষাবাদে পরামর্শ বা অন্য কোন খবর নিতে কখনো আসেনি। ফলে শত শত কৃষক বিপুল অংকের অর্থের ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পূজিঁ হারানোসহ ঋনগ্রস্থ হওয়ার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।

কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জ দক্ষিণ ইউনিয়নের একটি গ্রাম টামটা। এরপাশে রয়েছে পুটিয়া,বীরতলা,বীটমান,দইয়াবাড়ি। দেশের প্রধান জাতীয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উত্তর পাশজুড়ে গ্রামগুলোর অবস্থান। বর্ষায় পানিতে এসকল গ্রামের ফসলী জমিতে মাছের চাষ হয়। পানি শুকিয়ে গেলে শুরু হয় বিভিন্ন সব্জি চাষ। আর এমনিভাবে দিনে দিনে টামটা ও এর আশপাশের গ্রামগুলোতে টমেটোর ব্যাপকহারে চাষাবাদ শুরু হয়।

স্থানীয় একাধিক কৃষকের ভাষ্য,বছর ১৫/২০ বছর ধওে এখানকার কৃষকরা ব্যাপকহাওে বানিজ্যিক ভিত্তিতে টমেটোর চাষাবাদ কওে আসছে। টামটা গ্রামের টমেটো ক্ষেতে কথা হয় ফারুক হোসেন (২৪) নামের এক কৃষকের সাথে। তিনি বলেন,প্রতিদিন সকাল ৮ টায় জমিতে এসে একটানা দুপুর ২ টা পর্যন্ত কাজ করছে কৃষক। এসময় যাদের লোকবলের অভাব রয়েছে তারা বিভিন্নস্থান থেকে শ্রমিক এনে জমির পরিচর্যাসহ সেচ সুবিধা দিচ্ছেন। তিনি আরো বলেন,সকাল থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত একজন শ্রমিককে কমপক্ষে ৩’শ টাকার মুজুরী দিতে হচ্ছে,সাথে নাস্তা-পানিও। তাছাড়া দুপুরের পর অন্যান্য পরিচর্যার জন্য দিতে হয় অতিরিক্ত আরো ১’শ টাকা করে।

জমিতে কথা হয় চাষী মফিজুল ইসলাম (৬০)’র সাথে। তিনি জানান,টামটা গ্রামের কোন পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবেনা,যে পরিবারের কেউ না কেউ টমেটো চাষ করেনি। তিনি বলেন,অগ্রহায়ণ মাসে জমি তৈরী করে চারা রোপণ করি,চৈত্রে ফসল তোলা শুরু হয়। প্রতি একরে জমি তৈরী থেকে ফসল তোলা পর্যন্ত কমপক্ষে ৬০/৬৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়। মোটামুটি ফলন হলে একর প্রতি জমির ফলন লক্ষাধিক টাকা বিক্রি হয়। ফলন ভালো পেতে উন্নতমানের বীজ পাশাপাশি কীটনাশক ব্যবহারসহ প্রায় নিয়মিত জমি পরিচর্যা করতে হয়। তিনি জানান, সবল, সোনালী, ঔশি, শশি, শক্তিমানসহ বিভিন্ন উন্নতজাতের বীজ তারা রোপণ করেন। বর্তমানে জমিতেই বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৯/১০ টাকা করে। রাজধানী ঢাকা,চট্টগ্রাম,কুমিল্লা ,নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা আবার কখনো কৃষক নিজেই ট্রাক ভর্তি করে ঢাকা,কুমিল্লা নিয়ে বিক্রি করছে। আর কৃষক বা পাইকাররা টমেটো পরিবহনে ক্ষতিগ্রস্থ যেন না হয় সেজন্য এক প্রকার প্লাস্টিকের বাক্সে করে টমেটো বহন করছে। মফিজুল ইসলাম জানান,যদি জমিতে কোন রোগ আক্রমণ না করে তাহলে আগামী এক মাস টানা ফসল তুলবে। তবে তিনি জানান,এরই মাঝে কিছু কিছু গাছ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এজন্য বিভিন্ন কোম্পানীর কীটনাশক ব্যবহার চলছে। তবে টামটা গ্রামের পশ্চিম অংশে গিয়ে দেখা মিলে কৃষকদের দুর্দশা। একরের পর একরের জমির টমেটো গাছ স্থানীয় কৃষকদের ভাষায় “পোড়া” বা “ডায়রিয়া” রোগে আক্রান্ত হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন কোম্পানীর কীটনাশক বা সেচ সুবিধা দেওয়ার পরও কোন সুফল পাচ্ছেন না কৃষকরা। ফলে তারা হতাশ হয়ে পড়েছে। টামটা পশ্চিম পাড়া এলাকার ইকবাল জানান,প্রায় ১’শ শতক জমিতে টমেটো রোপন করেছিলাম। ফলন আসার পর গাছগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। কোন প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে পারিনি। ফলে বিপুল অংকের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। একই কথা বললেন আরো অনেক কৃষক। প্রত্যেকেরই আক্ষেপ কোন সাহায্য সহযোগীতা ছাড়াই ধার-দেনা করে লাভের আশায় টমেটো চাষ করেছিলাম। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেলো । ফলন আসার পর থেকেই রোগ দেখা দেয়। অনেক চেষ্টা করেছি কীটনাশক প্রয়োগ করে কোন লাভ হয়নি। উল্লেখিত প্রতিটি কৃষকের অভিযোগ এখানে চাষীদের কোন প্রকার সাহায্য সহযোগীতা করেনি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কোন অফিসার বা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা। টামটা গ্রামে জমিতে পাহাড়ারত ৭৫ বছরের বৃদ্ধ সুলতান মিয়ার সাথে। তিনি জানান,বছর দেড়েক আগেও আলী আকবর নামে এক কৃষি বিভাগের লোক এখানে আসতেন। শুনেছি তিনি মারা গেছেন। এরপর থেকে আর কাউকেই টামটা গ্রামের পশ্চিম পাড়ায় কখনো দেখিনি। তিনি আরো বলেন,বিশাল এলাকাজুড়ে টামটা গ্রাম। কয়েক হাজার একর হবে এই গ্রামের সীমানা। তিনি বলেন,ফলন ভালো হলে প্রতি ৩০ শতক জমিতে কমপক্ষে ৩-সাড়ে ৩’শ মন টমেটো উৎপাদিত হতো। তিনি বলেন,যদি কৃষি বিভাগের লোকজন নিয়মিত এখানে এসে কৃষকদের সাহায্য সহযোগীতা করতো,তাহলে রোগাক্রান্ত হয়ে কৃষকের দুর্ভোগ দেখা দিতনা। সুলতান মিয়ার ভাষ্য টামটা পশ্চিম পাড়া এলাকায় কমপক্ষে একশত একরের টমেটো “পোড়া” বা ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এতে করে বিপুল পরিমান অংকের ক্ষতির হিসাব করছেন স্থানীয় কৃষকরা। অনেকেই ক্ষোভের সাথে বলেন,আগামীতে আর টমেটো চাষ করা হবেনা।

দাউদকান্দির টামটা গ্রামে টমেটো চাষে বিপর্যয়সহ ক্ষতির বিষয়টি এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কোন কর্মকর্তা বা মাঠ পর্যায়ের লোকজনের অনুপস্থিতির অভিযোগ সম্পর্কে কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। আপনি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করেন। দাউদকান্দি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ সারোয়ার জামান বলেন,আমি প্রায় ১ মাস হলো এখানে এসেছি। টামটা গ্রামের টমেটো চাষিদের বিপর্যয়ের বিষয়টি আমার জানা নেই। আপনার মাধ্যমে আজ রোববার(১১ মার্চ) আমি বিষয়টি জেনেছি।আমি বিকেলেই আমার সহকর্মীদেও নিয়ে টামটা গ্রামে গিয়ে কৃষকদেও সাথে কথা বলবো এবং টমেটোর ক্ষেত পরিদর্শন করবো। তিনি আরো বলেন,এবার দাউদকান্দিতে ১৯০ হেক্টও জমিতে টমেটো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হলেও চাষাবাদ হয়েছে প্রায় দু’শ হেক্টর। প্রতি হেক্টর জমিতে ৩০ মেট্রিক টন টমেটো উৎপাদনের সম্ভাবনা। তিনি আরো বলেন,প্রায় ১০ হাজার কৃষক টমেটো চাষাবাদে জড়িত রয়েছে।

আরো পড়ুন