কুমিল্লায় দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে চেরি টমেটো চাষ

দেখতে আঙ্গুরের মতো খুবই সুন্দর, খেতে সুস্বাদু, লাল বর্ণের এক ধরণের ছোট জাতের টমেটোর নাম হচেছ চেরি। এটি দেখতে অনেকটা চেরি ফলের মতো বলে এর নামকরণ করা হয়েছে চেরি টমেটো।

নজরকাড়া সাইজ, আকর্ষণীয় রঙ, গুণাবলী যা সবার কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে বলে দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে কুমিল্লাসহ সারা দেশে। তবে আকারে ছোট বলে সে ভাবে ক্রেতা টানছে না।

যার কারণে কুমিল্লাসহ জেলার ১৮টি উপজেলায় এখনো সে ভাবে চেরি টমেটো বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করা না হলেও নগরীর বিভিন্ন বাসা বাড়ির ছাদ বাগানে বাড়ছে এর চাষ। ফলে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই চেরি টমেটো। ছাদের শোভা এখন চেরি টমেটো

বিজ্ঞানীদের দাবি, চেরির পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সাধারণের ধারণা স্পষ্ট হলেই এর বাণিজ্যিক চাহিদা বেড়ে যাবে দ্রুত।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট কুমিল্লা কেন্দ্রসহ বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে চেরি টমেটোর ইতিহাস জানতে গিয়ে বের হয়ে আসছে এর জন্ম ইতিহাসও। দেশে এর চাষ মাত্র কয়েক বছর আগে শুরু হলেও এর জন্ম ১৫ শতাব্দীতে মেক্সিকো নগরীতে।

পর্যায়ক্রমে ১৮০০ সালে চিলি ও পেরুতে, ১৮১৫ সালে গ্রীসে, ১৯১৯ সালে আমেরিকাতে এবং পরবর্তীতে ইসরাইলসহ পৃথিবীর নানা দেশে বিশেষ করে এশিয়ার দেশ কোরিয়া, জাপান ও থাইল্যান্ডে এর চাষাবাদ শুরু হয়। যা ধীরে ধীরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

বিভিন্ন দেশে এর রং, আকৃতি মিষ্টতা, লতার বৃদ্ধি, মৌসুমী ফলন শংকরায়নের মাধ্যমে পরিবর্তন করা হয়। এর মিষ্টতা ৯-১০% হলেও বাংলাদেশে তা অনেক বেশি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের আওতাভুক্ত সমন্বিত মানসম্পন্ন উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে এর উৎপাদন ও সম্প্রসারণের জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

গত ৩/৪ বছর থেকে এই প্রকল্পের অধীনে এর চাষাবাদ শুরু করা হয়েছে। যা এরইমধ্যে দেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

বিভিন্ন রঙের চেরি টমেটো আছে। লাল, হলুদ, সবুজ, কালো রঙের চেরি টমেটো খুবই জনপ্রিয়। তবে টুকটুকে লাল চেরি টমেটোর খাওয়ার স্বাদ এবং গুণগত মান অন্য রঙের চেরির তুলনায় কিছুটা আলাদা বলে জানা যায়।

বাসা বাড়ির ছাদে সারা বছরই চেরি টমেটো কম বেশি উৎপাদন হলেও বাণিজ্যিকভাবে এর উপযুক্ত চাষাবাদের সময় হচ্ছে, বছরের শেষ দুই মাস নভেম্বর ডিসেম্বরে। এই সময়ে বীজ রোপণ করা হয়ে থাকে। জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত চেরি টমেটো সংগ্রহ করা যায়।

অন্যান্য টমেটোর তুলনায় চেরি টমেটো আকারে অনেক ছোট হওয়ায় তা বৃদ্ধি পায় খুব দ্রুত। এটি ঘরের বারান্দায়,বাসার ছাদে খুব সহজে লাগানো সম্ভব।
প্রথমে সুস্থ সবল চেরি টমেটোর চারা অথবা বীজ সংগ্রহ করে নিতে হবে। এরপর ছোট টবে কিছু পরিমাণ পটিং মিক্স(কোকোপিট-৫০%, মাটি-২০%, ভার্মিকম্পোস্ট-২০%, পার্লাইট-১০% এর মিশ্রণ) নিয়ে নিতে হবে। এরপর এতে বীজ রোপণ করতে হবে একই দূরত্বে। এর ওপর হালকা লেয়ার করে মাটি দিয়ে দিতে হবে। এরপর পানি দিতে হবে। প্রায় ১৫-২০ দিনের মধ্যেই চেরি টমেটো বীজ থেকে চারা উৎপন্ন হবে। ২০ দিন পরে অন্য টবে স্থানান্তর করতে হবে।

এক গ্রাম এনপিকে এক লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছের পাতার ওপর স্প্রে করে দিতে হবে। গাছে সবসময় ইপসম লবণ, ডিমের খোসা দিতে হবে। গাছের বয়স ১৫ দিন হলে ফ্লোরা দিতে হবে। পুণরায় ফুল ফোটার পর ফ্লোরা দিতে হবে।

কুমিল্লায় মাত্র কয়েক বছর ধরে এর চাষাবাদ শুরু হলেও বাণিজ্যিকভাবে এখনো তেমন উল্লেখ করার মত অবস্থায় পৌঁছে নি। তবে নগরীর বিভিন্ন বাসা বাড়ির ছাদে এর চাষ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি কুমিল্লা জেলার কোষাধ্যক্ষ আনোয়ার হোসাইন একজন সৌখিন কৃষক হিসেবে নগরীতে বেশ পরিচিত। তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সবজির চাষাবাদ করে থাকেন তার বাসার ছাদে। এ বছর প্রথম বারের মত চেরি টমেটোর কয়েকটি চারা কুমিল্লা কেন্দ্র থেকে নিয়ে তারা ছাদে রোপণ করেছিলেন নভেম্বর মাসের শেষ দিকে। জানুয়ারির শুরুতেই এর ফলন পেতে শুরু করেছেন। প্রথম বারেই চেরি টমেটো চাষ করে বাহবা কুড়িয়েছেন তিনি।

সাংবাদিক আনোয়ার হোসাইন এ প্রতিবেদককে বলেন, নিউজ করতে গিয়েছিলাম বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটে কুমিল্লা অফিসে। সেখানকার কর্মকর্তা সিফাতে রাব্বানা খানম কয়েকটি চারা দিলেন। বাসার ছাদের টবে ও প্লাষ্টিকের বালতিতে রোপণ করেছি। যত্ন তেমন নিতে পারিনি তারপরও ধরেছে মোটামুটি।

এ টমেটোগুলো দেখতে খুব সুন্দর। স্বাদও ভালো। উন্নত বিশ্বে খাবারের টেবিল অলংকৃত করতে এসব টমেটো প্লেটে করে নাকি সামনে রাখা হয়। আবার অনেক দেশে ফ্রুট সালাদে এগুলো দেয়া হয়।

টমেটোগুলো দেখলে বেশ মোহনীয়। খেতে ইচ্ছে করে না। গাছে পাকার সে দৃশ্যটা অনেক সুন্দর। গাছগুলো খুব বেশি বড় হয়না। চারা রোপণের দু’মাসের মধ্যে ফল আসে। রোপণ করে দেখতে পারেন। খেতে পারবেন, বোনাস হিসেবে আনন্দও পাবেন।

চেরি টমেটো খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি দেখতে এতটা আকর্ষণীয় ও টুকটুকে লাল হয় তাই খাবার ডেকোরেশন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত সালাদ, জুস, সস, বিভিন্ন ধরণের রান্নায় ব্যবহৃত হয়। এছাড়া অনেকে সৌন্দর্য চর্চায় ব্যবহার করে থাকেন।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট কুমিল্লা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের মতে, চেরি টমেটোর রয়েছে অসামান্য পুষ্টিগুণ। চেরি টমেটো উচ্চপুষ্টিমান সম্পন্ন একটি সবজি। এতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট লাইকোপিন থাকে যা ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করে। চেরি টমেটো হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। রক্তচাপ কমায়, স্কিন কেয়ার করে। চেরি টমেটো কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে।

গর্ভবতী নারীদের জন্যে চেরি টমেটো খুবই উপকারী। টমেটো সালাদ বা রস করে খেলে ত্বকের মসৃণতা বৃদ্ধি পায়। বাচ্চাদের অল্প পরিমাণ টমেটো সালাদ করে খাওয়ালে তারা সবল ও রোগমুক্ত থাকে। দৈনিক চেরি টমেটো খেলে চেহারার ফ্যাকাশেত্ব কমে। ত্বক মসৃণ ও উজ্জ্বল করে।

চেরি টমেটো ওজন হ্রাসে সাহায্য করে। ত্বকের যত্নের পাশাপাশি এটি চুলকে মজবুত রাখতে সাহায্য করে। দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখে। চেরি টমেটো দেহের রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করে এবং মেনোপজ উপসর্গগুলি হ্রাস করে।

সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা জানান, চেরি টমেটোর টবকে এমন জায়গায় রাখতে হবে যাতে সুর্যের আলো পড়ে ২-৩ ঘণ্টা সকালের আর যাতে দুপুরের কড়া রোদ যেন না পড়ে। খেয়াল রাখতে হবে যেন এতে ছায়া পড়ে। একই সঙ্গে চারা গাছের সঙ্গে একটা লাঠি বেধে দিতে হবে।

কুমিল্লার বাসা বাড়ির ছাদ বাগানে চেরি টমেটোর চাষ জনপ্রিয় হলেও এখনো কেন বাণিজ্যিকভাবে এর প্রসার বাড়ছে না জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের কুমিল্লা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবদুর রাকিব বলেন, চেরি টমেটো অন্যান্য স্বাভাবিক টমেটোর তুলনায় পুষ্টিগুণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধেও এটি অত্যান্ত বেশি কার্যকর হলেও এর আকার অত্যন্ত ছোট।

ফলে ক্রেতারা আকৃতিগত ছোট হওয়ার কারণে এই টমেটো কিনতে আগ্রহী হয় না। ফলে চাষিরাও এটি চাষাবাদ করতে চায় না। কারণ চাষিতো তার লগ্মির টাকা উঠে আনার চিন্তা করবে আগে। দেশে এই চেরি টমেটোর আগমন খুব বেশি দিন হয়নি।

বিভিন্ন পর্যায়ে কাউন্সিলিং করে এর গুণাগুণ সম্পর্কে চাষি-ক্রেতা সবাইকে সচেতন করা হবে। এরইমধ্যে বিভিন্ন বাসা বাড়ির ছাদ বাগানে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এটিও আমাদের প্রচেষ্টার অংশ বিশেষ। তিনি চেরি টমেটো চাষে এবং এর ব্যবহারে এগিয়ে আসার জন্য সবাইকে আহবান জানান।

সূত্রঃ ডেইলি বাংলাদেশ

আরো পড়ুন