কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে কোটি টাকার গড়মিল!

ডেস্ক রিপোর্টঃ শতবর্ষের ঐতিহ্যের ধারক বাহক দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খ্যাত কুমিল্লার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের তহবিলে ধস নেমেছে। কলেজের সদ্য বিদায়ী অধ্যক্ষ প্রফেসর রতন কুমার সাহার ১৬ মাস দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে কলেজের তহবিলে ব্যাপক গড়মিল পাওয়া গেছে।

১৬ মাসে কলেজের আয় এবং ব্যায়ের মধ্যে দেখা গেছে ব্যাপক তফাত। বিদায়ী অধ্যক্ষ প্রফেসর রতন কুমার সাহা দায়িত্ব হস্তান্তরের সময় নতুন অধ্যক্ষ প্রফেসর মো: রুহুল আমীন ভূইয়াকে যে ব্যাংক স্থিতি দিয়ে গেছেনে তা থেকেই গড়মিলের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রফেসর রতন কুমার সাহা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সময় কলেজের তহবিলে সাত কোটি ১৫ লাখ ২৯ হাজার ৭২৮ টাকা থাকলেও গত ১১ জুন ২০১৯ সালে তহবিলে মোট টাকা রয়েছে পাঁচ কোটি ৫৩ লাখ ৫৮ হাজার ৫৪৬টাকা।

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের লেনদেন হয় পূবালী ব্যাংকে। ওই ব্যাংকে মোট ৪৪টি হিসাব রয়েছে কলেজের। প্রফেসর রতন কুমার সাহা দায়িত্ব গ্রহন করার পর বিগত ১৬ মাসে প্রায় সবকটি খাত ও হিসাবেই গড়মিল হয়েছে। তবে এ গড়মিলে কোন দুর্নীতি হয়েছে কিনা তা এ মুহূর্তে বলতে নারাজ কলেজ কর্তৃপক্ষ।

প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন খাত থেকে প্রাপ্ত আয়ের টাকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অমান্য করে ব্যয় করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০১৪ সালের পরিপত্র অনুয়ায়ি বিভিন্ন খাত থেকে আয় হওয়া টাকা স্বস্ব খাতে ব্যয়ের নির্দেশ থাকলেও সেটি মানা হয়নি। কলেজের অধিকাংশ ব্যয়েরই নেই সঠিক ভাউচার।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র না মানায় কলেজের ভয়াবহ দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কলেজের অনেক শিক্ষক-কর্মচারী। চাকরির ক্ষতি হতে পারে সেই ভয়ে পরিচয় প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।

পূবালী ব্যাংকে পরিচালিত ৪৪টি ব্যাংক হিসাবের মধ্যে ৮৬৩৩৩ নম্বর হিসাবটি অত্যাবশ্যকীয় কর্মচারী তহবিল। এই হিসাব থেকে কলেজের বেসরকারি কর্মচারীদের বেতন বোনাস প্রদান করা হয়ে থাকে। কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থী ব্যাংকের মাধ্যমে অন্যান্য ফি এর সাথে ৬০০টাকা, ফরম পূরণের সময় ২৫০ টাকা করে দিয়ে থাকেন।

বুধবার কলেজের হিসাব শাখায় গিয়ে দেখা যায়, অধ্যক্ষ রতন কুমার সাহার ১৬ মাস দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠানে মোট ভর্তি হয়েছেন ২৯ হাজার শিক্ষার্থী। ফরম পূরণ করছেনে ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী। সেই হিসেব অনুযায়ি আয় হয়েছে ২ কোটি ৮৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

অধ্যক্ষ রতন কুমার দায়িত্ব গ্রহণের সময় পূর্বের অধ্যক্ষ প্রফেসর আবু তাহেরের কাছ থেকে স্থিতি পেয়েছিলেন ১ কোটি ৮৭ লাখ ৯৪ হাজার ৫৭৪ টাকা। সবমিলিয়ে শুধু এই খাতে আয় হয়েছে ৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। কলেজের অত্যাবশ্যকীয় কর্মচারির বেতন প্রতিমাসে সর্বমোট পরিশোধ হয় ৮ লাখ ৯৬ হাজার টাকা।

রতন কুমার সাহা ১৬ মাসে বেতন পরিশোধ করেছেন এক কোটি ৪৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা প্রায়। এই বেতনের সাথে ঈদের ১০০% বোনাস ও ২০% বৈশাখী ভাতা যোগ করলে ১৬ মাসের সর্বমোট ব্যয়ের পরিমান দাড়ায় ১ কোটি ৭২ লাখ টাকা প্রায়। সে অনুযায়ী পূবালী ব্যাংকের ৮৬৩৩৩ নম্বর হিসাবে টাকা থাকার কথা তিন কোটি টাকারও বেশি।

কিন্তু বর্তমানে ব্যালেন্স রয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ ৬৮ হাজার ২৫৯ টাকা মাত্র। বাকী টাকা কোথায় গেল? শুধু একটি খাত থেকেই নেই প্রায় ২ কোটি টাকা। কলেজের উন্নয়ন ফান্ডে স্থিতি রয়েছে মাত্র ৮২ হাজার টাকা। রতন কুমার দায়িত্ব গ্রহণের সময় ওই হিসাবে স্থিতি ছিল প্রায় ১৫ লাখ টাকা। ২৯ হাজার শিক্ষার্থী তার সময়ে ২০০ টাকা হারে দিয়েছে আরো ৫৮ লাখ টাকা।

এতো টাকার উন্নয়ন কলেজের কোথায় হয়েছে? কলেজে ছাত্রছাত্রী সংসদ না থাকার পরেও শিক্ষার্থী ভর্তির সময় ব্যাংকের মাধ্যমে ২৫ টাকা করে কলেজে আদায় করে আসছে। অধ্যক্ষ রতন কুমার সাহা দায়িত্ব গ্রহন করার সময় স্থিতি পেয়েছিলেন ৩ লাখ ৮৭ হাজার ২০৮ টাকা। ২৯ হাজার শিক্ষার্থীর ২৫ টাকা হারে জমা দেয়া টাকার পরিমান হয় সাত লাখ ২৫ হাজার টাকা।

সবমিলিয়ে আয় হয়েছে ১১ লাখ ১২ হাজার ২০৮ টাকা। কিন্তু স্থিতি আছে মাত্র এক লাখ ৮৯ হাজার ৩১০ টাকা। বাকী টাকা কোথায়? কলেজের পরিবহন, ল্যাবেরেটরি, ম্যাগাজিন, তথ্য প্রযুক্তি, শিক্ষা সফর খাতগুলোতেও একই অবস্থা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, কলেজের হিসাব শাখায় কর্মরত কয়েকজন জানিয়েছেন, বিভিন্ন ভূয়া বিল ভাউচার বানানোর জন্য তিনজন কর্মচারী রয়েছেন।

তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে ভূয়া বিল ভাউচার তৈরি করে নথিভূক্ত করা। কলেজের হিসাব রক্ষকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, অধ্যক্ষ রতন কুমার সাহার আমলে দৃশ্যমান উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের মধ্যে রয়েছে পাঁচ লাখ টাকা ব্যায়ে অধ্যক্ষের বাস ভবন মেরামত, ৪ লাখ ২৯ হাজার টাকা ব্যায়ে ছাত্রীহল মেরামত, ৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা ব্যয়ে লাইব্রেরির উন্নয়ন, সাড়ে সাত লাখ টাকা ব্যয়ে ডিগ্রি শাখায় উন্মুক্ত মঞ্চ নির্মাণ, তিন লাখ ২০ হাজার টাকার মাটি ভরাট, সাড়ে ছয় লাখ টাকা ব্যয়ে উচ্চ মাধ্যমিক শাখায় মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার নির্মাণ(চলমান)।

সবমিলিয়ে ৩২ লাখ প্রায়। পাঁচ লাখ টাকা ব্যয়ে অধ্যক্ষের বাসভবন মেরামত হিসাবের ভাউচারে দেখা গেছে, একটি স্টিলের আলমারি মেরামত ও রং করা বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ১০ হাজার টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে, কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর মো: রুহুল আমীন ভূইয়া বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ি এক খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যয়ের কোন সুযোগ নেই। প্রয়োজনে সীমিত সময়ের জন্য হাওলাত নেয়া যায়। কলেজের ব্যাংক হিসাবের যে স্থিতি তা হতাশাজনক। তিনি বলেন, বিগত কয়েক মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট আমি নিয়েছি। যোগদানের দুদিন হলো মাত্র। এ বিষয়ে এই মুহুর্তেই সব বলা সম্ভব নয়। অল্প সময়ের মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পেলেই বিস্তারিত বলা যাবে।

কলেজের উপাধ্যক্ষ ড. আবু জাফর খান বলেন, কলেজের বিভিন্ন খাতের আয়ের সম্পর্কে আমার ধারণা থাকলেও ব্যয়ের কোন ধারনা আমার কাছে নেই। কারন, ব্যাংক হিসাবগুলো সব অধ্যক্ষের নিয়ন্ত্রনে। তিনি একাই সব নিয়ন্ত্রণ করেন। আমি এসবের কিছুই জানিনা।

বিদায়ী অধ্যক্ষ রতন কুমার সাহা বলেন, আমি কোন দুর্নীতি করিনি। আমার সময়ে ষাট লাখ টাকার উন্নয়ন হয়েছে। এক খাতের আয়ের টাকা অন্যখাতে ব্যয় করাটা ভিক্টোরিয়া কলেজে নতুন ঘটনা না। বিগত অধ্যক্ষরা যেভাবে কলেজ পরচিালনা করেছেন আমিও সেভাবে কলজে পরচিালনা করেছি। কলেজ পরিচালনায় পূর্বে আমার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। অত্যাবশ্যকীয় কর্মচারী খাতের টাকা কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যয় হয়েছে। তাছাড়া আমার সময়ে আয় কম হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে কতগুলো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এগুলো অনুষ্ঠিত হলে কলেজের মূল হিসেবে আরো কয়েক কোটি টাকা যোগ হবে।

কলেজের বিদায়ী অধ্যক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী, কলেজে যদি ষাট লাখ টাকার উন্নয়ন কর্মকান্ড হয়ে থাকে তাহলে ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণের সময় উন্নয়ন হিসাব (৮৬২৩৪ হিসাব নং) খাতে ব্যাংকে পাওয়া স্থিতি ১৪ লাখ ৬৭ হাজার ৩৬৪ টাকার সাথে ভর্তি হওয়া ২৯ হাজার শিক্ষার্থীর ২০০ টাকা করে দেয়া ৫৮ লাখ টাকা যোগ করলে সর্বমোট আয়ের পরিমান দাড়ায় ৭২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা।

এই টাকা থেকে উন্নয়নের ৬০ লাখ টাকা বাদ দিলে পূবালী ব্যাংকের উচ্চ মাধ্যমিক শাখার ওই হিসাব নম্বরে স্থিতি থাকার কথা ১২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। কিন্তু বর্তমানে স্থিতি আছে মাত্র ৮২ হাজার ৭৬৪ টাকা। উল্লেখ গত ৩০ মে ২০১৯ তারিখে ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর রতন কুমার সাহাকে ওএসডি করা হয়। কলেজের নতুন অধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন দেয়া হয় প্রফেসর মো: রুহুল আমীন ভূইয়াকে। গত ১১ জুন তিনি ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব হস্তান্তর করে বিদায় নেন।

আরো পড়ুন