কুমিল্লা লাকসামে মেয়রের দখলে ডিসির জমি

ডেস্ক রিপোর্টঃ ‘প্রায় ৫০ বছর ধরে বাজারটিতে আমরা ব্যবসা করে আসছিলাম। এই বাজারে ব্যবসা করে, শ্রম দিয়ে প্রায় এক হাজার ব্যবসায়ী ও কর্মচারী তাদের পরিবারের সদস্যদের মুখে আহার তুলে দিত; কিন্তু আট মাস ধরে বাজারটি দখলে নিয়ে টিনের বেড়া দিয়ে রেখেছেন পৌরসভার মেয়র। প্রতিদিন কোটি টাকার বেশি লেনদেন হওয়া বাজারটি থেকে আমাদের উচ্ছেদ করে রেলওয়ের জমিতে নির্মিত অবৈধ মার্কেটে নেওয়া হয়েছে; কিন্তু সেখানে ব্যবসার পরিবেশ নেই। আমরা বাজারটি রক্ষায় বারবার প্রশাসনের কাছে গিয়েছি, ২৪৮ জন ব্যবসায়ী বাদী হয়ে আদালতে মামলাও করেছি। এর পরও মেয়রের হাত থেকে দখলমুক্ত হয়নি বাজারটি। এ ঘটনায় প্রতিবাদ করলে হয়রানির শিকার হতে হয় ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের।’

গত মঙ্গলবার এই প্রতিবেদকের কাছে কথাগুলো বলেন কুমিল্লার লাকসামের ঐতিহ্যবাহী ‘দৈনিক কাঁচা বাজার’ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আলী আজগর। লাকসাম পৌর শহরের দৌলতগঞ্জে সরকারের ১ নম্বর খাস খতিয়ানের কুমিল্লার জেলা প্রশাসকের (ডিসি) মালিকানাধীন ৫৬ শতকের ‘দৈনিক কাঁচা বাজার’ থেকে ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদের পর টিনের বেড়া দিয়ে গত বছরের আগস্ট থেকে দখলে রেখেছেন লাকসাম পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মো. আবুল খায়ের। বাজারটিতে মেয়র পৌরসভার নামে একটি বহুতল ভবন নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছেন।

বারবার বক্তব্য পাল্টান ইউএনও : গত ৭ জুলাই কালের কণ্ঠে বাজারটি দখলচেষ্টার ঘটনায় ‘ডিসির জমিতে মেয়রের লোভ’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২৮ আগস্ট ‘ডিসির সেই জমি মেয়রের দখলে’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রতিবেদনে লাকসামের ইউএনও মো. রফিকুল হক বলেন, ‘এভাবে বাজারের ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদের সুযোগ নেই। ওই সম্পত্তি সরকারের, সেখানে অনুমোদন ছাড়া মার্কেট নির্মাণের সুযোগ নেই।’ দ্বিতীয় প্রতিবেদনে ইউএনও বলেন, ‘আমার জানামতে সেখানে ড্রেনের কাজ করা হচ্ছে। আর সরকারি অনুমোধন ছাড়া সেখানে ভবন করা যাবে না।’ দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর ইউএনও এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা এই বাজারের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়েছি। শিগগিরই জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট টিনের বেড়া উচ্ছেদের মাধ্যমে বাজারটি দখলমুক্ত করবে।’ তবে বর্তমানে ইউএনও বলছেন, ‘কাঁচা বাজারটি আমাদের দখলেই আছে। সেখানে টিনের বেড়া থাকলেও সমস্যা নেই। কারণ বাজারটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পৌরসভার। পৌরসভা যদি ব্যবসায়ীদের না বসিয়ে আমাদের ইজারার টাকা দেয়, সমস্যা কোথায়?’ তবে দৌলতগঞ্জ ভূমি অফিসের সহকারী কর্মকর্তা (তহশিলদার) মো. নুরুল আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘বাজারটিতে টিনের বেড়া দেওয়ার পর বিষয়টি লিখিতভাবে জেলা প্রশাসক মহোদয়কে জানিয়েছি। টিনের বেড়া উচ্ছেদের জন্যও আবেদন পাঠিয়েছি।’

নির্দেশ কার্যকর হয়নি : কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আসাদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি লাকসামের ইউএনও এবং এসি ল্যান্ডকে অনেক আগেই বলেছি মেয়রের দেওয়া টিনের বেড়া উচ্ছেদ করার জন্য; কিন্তু এখনো বাজারটি দখলমুক্ত হয়নি! আমি আবার তাঁদের নির্দেশনা দিচ্ছি শিগগিরই ওই বেড়া উচ্ছেদ করে বাজারটি দখলমুক্ত করতে।’ জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর বলেন, ‘খোঁজখবর নিয়ে বিষয়টি দেখা হচ্ছে।’

বাজার রক্ষায় ব্যবসায়ীদের চেষ্টা : ২০১৬ সালে দৌলতগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের সম্পত্তি দখল করে অবৈধ বিশাল ‘পৌর হকার্স মার্কেট’ নির্মাণ করেন মেয়র। এরপর বাজারটির ব্যবসায়ীদের ওই মার্কেটে নিতে চেষ্টা চালান তিনি এবং গত বছরের আগস্টে ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করেন। গত ৩১ জুলাই বাজাটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি আলী আজগরসহ ২৪৮ জন ব্যবসায়ী বাদী হয়ে কুমিল্লার আদালতে একটি মামলা করেন। মামলায় পৌর মেয়র মো. আবুল খায়ের, লাকসাম উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের শ্যালক মহব্বত আলী এবং কুমিল্লা জেলা প্রশাসককে বিবাদী করা হয়। আদালত বিবাদীদের আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন; কিন্তু কয়েক দফা সময় নিয়েও আদালতে হাজির হননি বিবাদীরা।

মামলায় কী আছে : মামলায় ব্যবসায়ীরা উল্লেখ করেন, সিএস খতিয়ান মূলে সারাফত উল্লাহ নামে এক ব্যক্তি ওই সম্পত্তির মালিক ছিলেন। তিনি সম্পত্তিতে সপ্তাহের শনি ও বুধবার গরুর হাট বসিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পরে সারাফত উল্লাহর নামীয় সম্পত্তি থেকে ৫৬ শতক সম্পত্তি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জেলা প্রশাসকের নামে খাস খতিয়ানে নেয়। এরপর বাংলাদেশ সরকারের জেলা প্রশাসক, কুমিল্লার নামে ১ নম্বর খাস খতিয়ানে ওই সম্পত্তি লিপিবদ্ধ হয়। পরে সেখানে কাঁচা মালের বাজার শুরু হলে বাদীদের দাদা, বাবা এবং বর্তমানে বাদীরা সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করছিল; কিন্তু মেয়র সন্ত্রাসী নিয়ে ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করে ভবন নির্মাণের পাঁয়তারা করছেন।

কষ্টের জীবন : বাজারটির ব্যবসায়ী ও কর্মচারী জানান, রেলের জমির মার্কেটে তাঁদের অনেককে জোর করে আনা হলেও সেখানে ব্যবসার পরিবেশ নেই। আট মাস ধরে তাঁদের লাখ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।  বিভিন্ন এলাকার খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে তাঁদের লাখ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। তাঁরা সেই টাকাও তুলতে পারেননি। প্রায় এক হাজার কর্মচারী-ব্যবসায়ীর পরিবারের সদস্যরা কষ্টে জীবন যাপন করছে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে মেয়র আবুল খায়েরের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ

আরো পড়ুন