কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের “গলাকাটা” হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ!

কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের (কুসিক) ১৮ নং ওয়ার্ডের নূরপুরের ১০১ নম্বর বাড়ির মালিক হাবিব উল্লার গত বছরের (২০১৯) বার্ষিক হোল্ডিং ট্যাক্স ছিল ৩৪০ টাকা। চলতি বছর পুনর্মূল্যায়নে তা বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৬৪১ টাকা। সম্প্রতি কুসিক থেকে আসা হোল্ডিং ট্যাক্সের বিল দেখে তিনি হতভম্ব হয়ে পড়েন। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যান সিটি করপোরেশনের ট্যাক্স / কর পরিশোধ শাখায়। কিন্তু কর্মকর্তারা নির্ধারিত ট্যাক্সে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেননি।

হাবিব উল্লা জানান, ২০১৫ সাল থেকে তিনি তার বাড়ির বার্ষিক ট্যাক্স দিয়ে আসছেন ৩৪০ টাকা। এর মধ্যে ওই বাড়িতে তিনি কোনো অতিরিক্ত সম্পত্তিও ক্রয় করেননি। এবার ট্যাক্স নির্ধারণের আগে তার বাড়িতে কুসিক থেকে একটি চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে, পুনর্মূল্যায়নে হোল্ডিং ট্যাক্সের পরিমাণ বাড়তে পারে। কিন্তু এই বৃদ্ধি যে এরকম আকাশছোঁয়া হবে, সেকথা কখনও চিন্তাও করেননি তিনি। ‘একলাফে এতো ট্যাক্স বাড়িয়ে জুলুম করা হচ্ছে’ মন্তব্য করেন তিনি।

কুসিক থেকে একই রকম আকাশছোঁয়া বিল পেয়ে হতভম্ব হয়ে পড়েন ১৪ নং ওয়ার্ডের দ্বিতীয় মুরাদপুরের ২০৪ নম্বর বাড়ির মালিক মৃত আনিছুল হকের স্ত্রী মনোয়ারা বেগমও। তার বাড়ির বার্ষিক হোল্ডিং ট্যাক্স ছিল ১৭০ টাকা। এবার বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৫২৫ টাকা। কুসিকের দেওয়া এমন বিল পেয়ে তিনিও ছুটে আসেন সিটি কর্পোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধ শাখায়।

শুধু হাবিব উল্লা ও মনোয়ারা বেগম নন, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডের প্রায় ৪০ হাজার বাসিন্দার ক্ষেত্রেই ঘটছে এমন ঘটনা। হোল্ডিং ট্যাক্স একলাফে ১৪ গুণ বাড়িয়ে দিয়ে সিটি কর্পোরেশন বাড়িওয়ালাদেরকে ফেলে দিয়েছেন ট্যাক্স-আতঙ্কে। অনেকে ট্যাক্স কমানোর জন্য সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে ছুটছেন। এই সুযোগে কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ঘুষের বিনিময়ে ট্যাক্স কমিয়ে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

ওদিকে সিটি কর্পোরেশন হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়িয়ে দেওয়ায় কুমিল্লা নগরীর ভাড়াটিয়াদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। তারা মনে করছেন, বাড়ির মালিকরা তাদের ভাড়া বাড়িয়ে এই ‘ক্ষতি’ পুষিয়ে নেবেন। এতে বাসাভাড়া মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষ পড়বে মহাবিপদে।

গত সোমবার কুসিকের ট্যাক্স ও কর পরিশোধ শাখায় গিয়ে দেখা যায় উপচে পড়া ভিড়। কেউ বিল পরিশোধ করতে নয়, সবাই এসেছেন অভিযোগ নিয়ে। তাদের একটিই কথা সিটি কর্পোরেশন হঠাৎ এতো ট্যাক্স বাড়িয়ে বাসিন্দাদের উপর জুলুম করছে।

তাদের অভিযোগ, কুসিক এতদিন যে হারে ট্যাক্স আদায় করেছে, সে তুলনায় সেবা দিয়েছে নামমাত্র। ময়লা-আবর্জনা, মশার উৎপাত আর অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থায় নগরবাসী প্রতিনিয়ত পড়ছেন নানা ভোগান্তিতে। পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন নির্মাণের পরও নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না, যতদিন পর্যন্ত ময়লা, নোংরা ও দুর্গন্ধময় পানি সড়কে ছড়িয়ে না পড়ে। সড়ক থেকে ড্রেন উঁচু হওয়ায় এবং পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় হালকা বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। ডাস্টবিনগুলো প্রতিদিন নিয়মিত পরিষ্কার না করায় ময়লাপচা দুর্গন্ধে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, মশার উৎপাত ঠেকাতে এবং তার প্রজননস্থান ধ্বংসের মতো নাগরিক সেবায় কুসিক কোনোই ব্যবস্থা নেয় না। ওদিকে সড়ক বাতি বিষয়েও কুসিক উদাসীন; রাখে না কোনো খোঁজ-খবর। এরকম যাচ্ছেতাই সেবা দেয়ার পরও তারা কোন যুক্তিতে হঠাৎ করে ‘গলাকাটা’ ট্যাক্স নির্ধারণ করে, তা বোধগম্য হচ্ছে না কুমিল্লাবাসীর।

হঠাৎ অতিরিক্ত হারে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ার কারণ জানতে চাইলে কুসিকের ওই শাখার কর নির্ধারণ কর্মকর্তা মো. জামাল খাঁ গতকাল মোবাইল ফোনে বলেন, ‘স্থানীয় সরকারের নির্দেশক্রমে ৫ বছর পর পর পুনর্মূল্যায়নে বাড়ির মালিকদের হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানো হয়। তবে কেউ যদি ট্যাক্স অতিরিক্ত মনে করেন তাহলে ২০ টাকার বিনিময়ে আবেদনপত্র ক্রয় করে মেয়র বরাবর অভিযোগ করতে পারবেন। এর বাইরে আর কিছু বলা সম্ভব না’ বলে ফোন কেটে দেন তিনি।

এ বিষয়ে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নগরবাসীর ওপর অতিরিক্ত ট্যাক্স বা কর আরোপ হোক, সেটা আমি চাই না। সিটি করপোরেশন চাইলেও হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোর ক্ষমতা নেই। এ জন্য স্থানীয় সরকারের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। তবে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়নের একটি নিয়ম রয়েছে।’

মেয়র আরো বলেন, কুমিল্লা নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডে প্রায় ৪০ হাজার বাসিন্দা আছেন। স্থানীয় সরকারের নির্দেশ রয়েছে, পুরনো বিলের তুলনায় তিন ডাবল ট্যাক্স বাড়ানোর। কিন্তু আমরা সেটা করছি। ট্যাক্স অতিরিক্ত হলে আমাদের কাছে সংশোধনের সুযোগ রয়েছে। আবেদন করলে আমরা বিবেচনা করে সমতার মধ্যে নিয়ে আসছি। যেমন, কোনো বাড়ির মালিকের ট্যাক্স ১০ হাজার টাকা এলে সেটা বিয়োগ করে তিন কিংবা চার হাজারে নিয়ে আসছি। কারণ, এই বাসিন্দাদের ট্যাক্স এবং কর দিয়েই সিটি কর্পোরেশন চলে। আমাদের আর বাড়তি কোনো আয় নেই।’

আরো পড়ুন