দেবিদ্বারে দপ্তরী নিয়োগে টালবাহানা : ভূয়া প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে সবাই একাট্টা

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জ ইউনিয়নের ৫৬ নং খয়রাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরী কাপ প্রহরী নিয়োগ নিয়ে চলছে টালবাহানা। অযোগ্য ও ভূয়া প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে এক হয়েছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। সঙ্গে যোগ দিয়েছে স্থানীয় কতিপয় রাজনীতিবিদ। ফলে উপজেলার ৪৯টি বিদ্যালয়ে বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও বাদ রয়ে গেছে খয়রাবাদ।

জানা গেছে, খয়রাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরী নিয়োগ দিতে গেলো বছরের ১৯ জুলাই উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তার কার্যালয়ে মৌখিক ও বাইসাইকেল চালানোর পরীক্ষায় অংশ নেয় তিনজন প্রার্থী। তাদের মধ্যে খয়রাবাদ গ্রামের আব্দুর রশীদের ছেলে রুহুল আমিন প্রথম, একই গ্রামের জয়নাল আবেদীনের ছেলে বদরুল ইসলাম দ্বিতীয় ও ফরিদ মিয়ার ছেলে মিজানুর রহমান তৃতীয় হয়।

নিয়ম অনুযায়ী রুহুল আমিনের নিয়োগ পাওয়ার কথা। সে প্রক্রিয়াও এগিয়ে যায় অনেক দূর। কিন্তু বিপত্তি ঘটে যখন ফাঁস হয়ে যায় তার দাখিল করা সনদপত্র ভূয়া। দ্বিতীয় হওয়া বদরুলের মা মনোয়ারা বেগম রুহুল আমিনের সনদপত্রের বৈধতা নিয়ে স্থানীয় সাংসদ রাজী মোহাম্মদ ফখরুল, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জেলা প্রশাসক এবং তৎকালীন উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী দপ্তরী পদে আবেদনের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে ন্যূনতম অস্টম শ্রেণী পাশ। মনোয়ারা বেগম লিখিত অভিযোগে জানান, রুহুল আমিন অস্টম শ্রেণী পাশ নয় এবং ভূয়া সনদপত্র দিয়ে সে আবেদন করেছে। বিষয়টি তদন্ত করে রুহুলের সনদপত্র বাতিলসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানান তিনি। অভিযোগের বিষয়টি অবহিত করা হয় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা খগেন্দ্র চন্দ্র সরকারকেও।

জেলা প্রশাসক অভিযোগটি আমলে নিয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) শরীফ নজরুল ইসলামকে বিষয়টি তদন্ত করতে নির্দেশ দেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এক নোটিশের মাধ্যমে ১৬ আগস্ট বেলা সাড়ে ১২টায় উভয়পক্ষকে তাঁর দপ্তরে হাজির হতে নির্দেশ দেন। কিন্তু অভিযোগকারী সেই নোটিশ হাতে পায় নিষ্পত্তির জন্য নির্ধারিত তারিখের আটদিন পর। সেদিন বৃহস্পতিবার থাকায় নোটিশের প্রেক্ষিতে পরের রোববার অর্থাৎ ২৭ আগস্ট অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে উপস্থিত হয় মনোয়ারা বেগম। কিন্তু রুহুল আমিনের পক্ষে কেউ উপস্থিত না থাকায় বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়নি।

পরে ১০ সেপ্টেম্বর উভয়পক্ষকে হাজির হতে আরেকটি নোটিশ দেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। সেদিন রুহুল আমিনের অস্টম শ্রেণীর সনদপত্র যে ভূয়া, তার পক্ষে বেশ কিছু নথিপত্র দাখিল করেন মনোয়ারা বেগম। রুহুল আমিন খয়রাবাদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অস্টম শ্রেণী পাশের সনদপত্র জমা দিয়েছিলেন। অথচ ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ভর্তি রেজিস্ট্রি খাতা থেকে শুরু করে অস্টম শ্রেণীর ফলাফল পর্যন্ত দেখা যায়, রুহুল আমিন সেখানে ভর্তি হলেও ক্লাস করেছেন হাতেগোনা। আর কয়েকটি পরীক্ষায় অংশ নিলেও পাশ করার জন্য পর্যাপ্ত নম্বর পাননি। খয়রাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলী আহম্মদও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে জানান, রুহুল আমিন তাঁর স্কুল থেকে পাশ করেনি এবং সনদপত্রও তিনি দেননি। এর স্বপক্ষে তিনি রুহুল আমিনের ভর্তি থেকে শুরু করে অস্টম শ্রেণীর ফলাফল বিবরণী খাতা ও শিক্ষক হাজিরা খাতা দাখিল করেন। অথচ যে তারিখে রুহুল আমিনকে সনদপত্র দেয়া হয়েছিলো সেদিন প্রধান শিক্ষক স্কুলে উপস্থিত ছিলেন। বিপরীতে রুহুল আমিন জানায়, স্কুল থেকেই সে সনদপত্র পেয়েছে, যার ভিত্তিতে সে পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে। সনদপত্র পাওয়ার বিষয়ে স্থানীয় একজন নেতা তাকে সহায়তা করেছে বলেও জানায় রুহুল। নোটিশে উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তার পক্ষ থেকে একজন উপযুক্ত প্রতিনিধিকে উপস্থিত থাকতে বলা হলেও কেউ যায়নি।

উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বলেন, দপ্তরী নিয়োগে বেশকিছু অভিযোগ এসেছে। তবে মনোয়ারা বেগমের অভিযোগটিই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এ বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে লিখিতভাবে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ উভয়পক্ষকে অবহিত করা হবে বলে জানান তিনি।

কিন্তু এরপরই পাল্টে যায় চিত্র। বিষয়টির অগ্রগতি জানতে পরবর্তীতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে, প্রতিবারই অভিযোগকারীর সঙ্গে অশোভন আচরণ করা হয়। পাশাপাশি এও জানানো হয় রুহুল আমিন অন্য একটি স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়েছে।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জানান, তাঁর কিছু করার নেই, অভিযোগ যেহেতু জেলা প্রশাসক বরাবর ছিলো সেহেতু তাঁকেই এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে হবে। তাঁর দপ্তরে যোগাযোগ না করতেও বলেন শরীফ নজরুল ইসলাম। তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম অভিযোগকারীকে নানাভাবে অপদস্থ করেন। উপজেলা প্রশাসনেরও একই সুর। রুহুল আমিনের পক্ষে সাফাই গাইছে তাঁরাও।

জানা গেছে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার যোগসাজশে রুহুল আমিনের আবেদনপত্রটি পরিবর্তন করে অন্য স্কুলের একটি সনদপত্র সংযুক্ত করে তাকে নিয়োগের পায়তার চলছে। উল্লেখ্য, এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আগে প্রকাশিত আরেকটি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী রুহুল আমিনের বড় ভাই নজরুল ইসলামও ভূয়া সনদপত্র দিয়ে আবেদন করে এবং নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হয়। কিন্তু অন্য এক আবেদনকারীর লিখিত আপত্তি ও তদন্ত সাপেক্ষে সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল হয়ে যায়। পুনরায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পরও একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এবার বাতিল হবেতো?

এ বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসার খগেন্দ্র চন্দ্র সরকার জানান, খয়রাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরী নিয়োগে অনিয়ম এর অভিযোগের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসন থেকে তদন্ত করা হয়েছে। তদন্তের প্রতিবেদন আমাদের কাছে আসেনি । প্রতিবেদন আসলে প্রতিবেদন অনুযায়ী আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নিব ।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবীন্দ্র চাকমা বলেন, দেবিদ্বার উপজেলায় আমি ২ মাস পূর্বে এসেছি এর মধ্যে এধরণের কোন নিয়োগ প্রক্রিয়া হয়নি। পূর্বে হয়ে থাকলে তা আমার জানা নেই।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) শরীফ নজরুল ইসলাম এর মোবাইলে কল দিয়ে পাওয়া যায়নি।

আরো পড়ুন