মুক্তিযোদ্ধা বশির এবার চায় বীরত্বের খেতাব

মারুফ আহমেদঃ দু’নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা বশির আহম্মেদ। দেশের স্বাধীনতায় অকুতোভয় এই যোদ্ধা জীবন বাজি রেখে দেশ মার্তৃকার টানে বাড়ি থেকে বাবা-মাসহ পরিবারের লোকজনদের না বলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে পালিয়ে গিয়েছিল যুদ্ধের মাঠে। যুদ্ধ শেষে ফিরে এসেছে স্বাধীন দেশে। পেয়েছেন জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে স্বীকৃতিও। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আতœীয়ের বাসায় বেড়াতে এসে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবীতে ঢাকার রাজপথে মিছিল করেছেন। জীবন সায়াহ্নে এই মুক্তিযোদ্ধা চায় তার বীরত্বের খেতাব। পালিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাওয়া এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বশির চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার বৈদ্যনাথপুর গ্রামের জিন্নাত আলী মাষ্টারের ছেলে।

এমুক্তিযোদ্ধা বশির নিজেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা নেই এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের। তবে দেশ প্রেমে আগে যেমন ছিলেন এখনও তেমনি। ১৯৫১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বশির আহমেদ চাঁদপুরের বৈদ্যনাথপুর গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অভাবের সংসারে পিতা জিন্নত আলী মাষ্টারের পক্ষে সম্ভব হয়নি সন্তান বশিরকে লেখা-পড়া করানোর। শৈশব থেকে ডানপিটে বশির তাই স্কুলের গন্ডিও পেরুতে পারেনি। এদিকে পাকিস্তানী শোষনের বিরুদ্ধে দিন দিন বাড়তে থাকে বাঙ্গালীদের ক্ষোভ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলে তার দু’মামাতো ভাই চাকুরী করার সুবাধে তাই মাঝে মাঝে বশির বেড়াতে চলে আসতেন ঢাকায়।

এমনিভাবে একসময় ঢাকায় আসলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতারের পর তার মুক্তির দাবীতে ঢাকার রাজপথে মিছিল করেছেন। তিনি বলেন,তখন মিছিলে নেতৃত্বে ছিলেন শাহজাহান সিরাজ,আ স ম আব্দুর রব প্রমূখ নেতা। পরবর্তীতে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধু’র ভাষণ রেইসকোর্স ময়দানে উপস্থিত থেকে শুনেছেন । পরে ওইদিনই গ্রামে ফিরে এসে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে আক্রমনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। ২৫ মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনী বাঙ্গালীদের উপর আক্রমন শুরু করলে দলে দলে শহর থেকে মানুষ গ্রামে ফিরতে শুরু করে।

এসময় অসহায় মানুষের সাহায্যে এগিয়ে যান বশির। হানাদারদের আক্রমন বাড়তে থাকলে এলাকায় মাইিকিং করে স্থানীয় উটারচর হাই স্কুল মাঠে সাধারণ মানুষ,সেনাবাহীনি,তৎকালীন ইপিআর,পুলিশ সদস্যদের নিয়ে একটি বাহিনী গঠণ করেন। পরে ওই উটারচর হাই স্কুল মাঠেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এম এ অদুদ,সেনাবাহিনীর হাবিলদার জাহাঙ্গীর আলম,মোখলেস,ইপিআরের হাবিলদার আজিজ, নায়েক বাসার,সেনাবাহিনীর নায়েক লতিফ বাগ, পুলিশের হাবিলদার আব্দুর রশিদ সহ অন্যান্যরা মিলে একটি ট্রেনিং সেন্টার করে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে সেখানে এক সপ্তাহ প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে এক’শ যুবককে বাছাই করে ভারতে পাঠানোর জন্য। তাদের মধ্যে বশির একজন। তাদেরকে ধনাগোদা স্কুল মাঠে উপস্থিত হতে নির্দেশ দেয়।

তখন বাবা-মাসহ পরিবারের কাউকে না জানিয়ে প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড়সহ পথ খরচের টাকা সংগ্রহে দুটি ছাগল বিক্রি করে যাত্রা শুরু করেন সীমান্তের দিকে। দাউদকান্দি, ব্রাহ্মণপাড়ার শশীদল হয়ে যখন মুক্তিযুদ্ধে দু’নং সেক্টরের অধীন ভারতের বক্সনগর ইউথ ক্যাম্পে দিনভর পায়ে হেটে যখন পৌছান তখন প্রায় সন্ধ্যা। এরপর সেখানে ১৫ দিন প্রশিক্ষণ নিয়ে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় রাতে অপারেশন করতে আসতেন। কিছুদিন পর তাকেসহ ওই দলটিকে পাঠিয়ে দেয় অম্পি ট্রেনিং সেন্টার। সেখানে ৬ সপ্তাহ গেরিলা ট্রেনিংসহ গ্রেনেড, এসএমজি, এলএমজি,রাইফেল, এসএলঅর ,পিস্তল পরিচালনার ট্রেনিং দিয়ে ভারতের মেলাঘর ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে পাঠিয়ে দেয় বাংলাদেশের সালদা এলাকায়। সেখানে হানাদারবাহীনির সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অনেক পাক আর্মি মারা যায়। আবারো

ভারতে ফিরে গেলে আমাদের ৪০জনকে আলাদা করে কমান্ডার মিয়া জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে পাঠিয়ে দেয় নৌকাযোগে মতলব। এসময় আমাদের প্রত্যেককে ২ টি করে গ্রেনেড ও পুরো দলের জন্য ৫ টি রাইফেল,৫ টি এসএমজি,৫ টি এসএলআর ও ৫ টি এলএমজি দেয়। মতলব পৌঁছে ২০ জন করে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ মতলবে অবস্থান নিয়ে দু/তিন দিন বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে খবরাখবর সংগ্রহ করে রাজাকার,আলবদর,মুসলিম লীগসহ স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিচারণ করে বশির আরো বলেন,সময়টা মনে নেই,তবে যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় একদিন দেখলাম ঢাকা থেকে দাউদকান্দির দিকে একটি গান বোট আসছে। আমরা এলএমজি দিয়ে সেটাতে আক্রমন করি। এতে কয়েকজন পাক সেনা নিহত ও দু’জনকে জীবিত অবস্থায় আটক করি। এসময় গান বোট থেকে ২ টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করি। পরবর্তীতে আটক দু’পাক সেনাকে ধনাগোদা এলাকায় হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেই।

এর পর দাউদকান্দির গোয়ালমারি এলাকায় পাক হানাদারদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। সরাসরি অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা বশির বলেন, সে যুদ্ধে এম এ অদুদের গায়ে গুলি লাগে। নিহত হন রুহুল আমিনসহ বেশ কজন মুক্তিযোদ্ধা। এঘটনায় ৫ পাকিস্তানী সৈনিককে হত্যা করে তাদের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রগুলো লুট করে বশিরসহ তার কয়েক সহযোগী। এঘটনার ৩ দিন পর বশিরসহ মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় কালিপুরা বাজারের লালপুর গ্রামে পাক বাহিনীর সাথে দু’দিন সম্মুখ যুদ্ধ করেন। এতেও বেশ কিছু পাক সেনা নিহত হয়। এসময় ৩ টি নৌকা ভর্তি এলএমজি,রাইফেলসহ গোলাবারুদ জব্দ করেন বশির ও তার সহযোগীরা। ফিরে আসেন তার দলবল নিয়ে বৈদ্যনাথপুর গ্রামে। এর কিছুদিন পর দেশ স্বাধীন হয়। এরপর বঙ্গবন্ধু মুক্তির পর অস্ত্র ফেরতের নির্দেশ দিলে চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের কাছে বশির ও তার সহযোদ্ধারা তাদের ব্যবহৃত ও পাকবাহিনীর কাছ থেকে লুণ্ঠিত আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেন। এসময় তাকে দেওয়া হয় একটি সার্টিফিকেট ও একটি কম্বল। জীবন সায়াহ্নে এসে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার আক্ষেপ জীবন বাজি রেখে সরাসরি যুদ্ধ করে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ভূমিকা রাখার জন্য চায় রাষ্ট্রীয়ভাবে বীরত্বের খেতাব।

আরো পড়ুন