লাকসামে ‘নূর হোসেন’ কে?

ডেস্ক রিপোর্টঃ ‘তারেক সাঈদ এই গুমের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তিনি কুমিল্লায় এসে এই অপহরণ ও গুমের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে সব তথ্য বেরিয়ে আসবে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের পরিকল্পনাকারী নূর হোসেনের মতো জোড়া গুমে কে কলকাঠি নেড়েছেন, তা আমরা বুঝতে পারছি না। ’ কুমিল্লার লাকসাম পৌর বিএনপির নিখোঁজ সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজের স্ত্রী শাহনাজ বেগম গতকাল রবিবার এ কথাগুলো বলেন।

২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর পারভেজসহ কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি, সাবেক সংসদ সদস্য মো. সাইফুল ইসলাম হিরু নিখোঁজ হন। আজ সেই নিখোঁজের চার বছর পার হচ্ছে। এই চার বছরে ঘটনা তদন্তে সরকারি কর্তৃপক্ষের গাফিলতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২৮ দফা সময় বাড়িয়েও তদন্তকাজ শেষ করতে পারেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এমনকি তারা নিখোঁজ দুই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখাও করেনি।

গতকাল রবিবার সকালে এই মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী মুহাম্মদ বদিউল আলম সুজন বলেন, ‘নারাজি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি আদালত মামলাটি সিআইডিকে পুনরায় তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।

এ পর্যন্ত ২৮ দফা সময় পার হলেও প্রতিবেদন দাখিল করেননি কর্মকর্তা। ’ তিনি আরো বলেন, ‘মামলাটি তদন্তে সরকার বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতা রয়েছে। সঠিকভাবে তদন্ত করা হলে এই অপহরণ এবং গুমের সব তথ্য বেরিয়ে আসবে। ’

এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি কুমিল্লা জোনের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী খুঁজছি। এ ছাড়া অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদের চেষ্টা করছি। ’

তবে মামলার বাদী মো. গোলাম ফারুক বলেন, ‘৩৩ মাস পার হলেও তদন্ত কর্মকর্তা আসামি, সাক্ষী তো দূরের কথা, আমার সঙ্গেও যোগাযোগ করেনি। এমনকি তদন্ত করতে এলাকাতেও আসেনি। ’ তিনি জানান, এর আগে প্রথম তদন্তে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ না করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ। এসবের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা আড়ালের চেষ্টা করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর ছিল বিএনপির অবরোধ। ওই দিন রাত ৯টায় র‌্যাব সদস্যরা হিরুর মালিকানাধীন ‘লাকসাম ফ্লাওয়ার মিলে’ প্রায় এক ঘণ্টা অভিযান চালায়। ৯ জনকে আটক করে। খবর পেয়ে রাতেই হিরু, পারভেজ ও পৌর সহসাংগঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিন একটি অ্যাম্বুল্যান্সে করে লাকসাম থেকে কুমিল্লার উদ্দেশে রওনা দেন। কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের হরিশ্চর-আলীশ্বরে পৌঁছলে সাদা পোশাকধারী একদল লোক অ্যাম্বুল্যান্সটির গতিরোধ করে। র‌্যাব পরিচয়ে তাঁদের আটক করে অন্য একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে কুমিল্লার দিকে নিয়ে যায়। ওই দিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে জসিম (অ্যাম্বুল্যান্সে থাকা) এবং লাকসামে গ্রেপ্তার হওয়া ৯ জনকে থানায় হস্তান্তর করেন র‌্যাব-১১-এর তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) মো. শাহজাহান আলী। পরদিন সকালে তাঁদের জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ। এর পর থেকে বাকি দুজনের সন্ধান দিতে পারেনি র‌্যাব বা পুলিশ।

এ ঘটনায় ২০১৪ সালের ১৮ মে পারভেজের বাবা রঙ্গু মিয়া গুমের অভিযোগ এনে কুমিল্লা আদালতে মামলা করেন। মামলায় র‌্যাব-১১-এর অধিনায়ক (বাধ্যতামূলক অবসর, সিইও) লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা কম্পানি-২-এর মেজর শাহেদ হাসান রাজীব, ডিএডি শাহজাহান আলী, উপপরিদর্শক (এসআই) কাজী সুলতান আহমেদ ও অসিত কুমার রায়কে আসামি করা হয়।

ওই দিন বেঁচে যাওয়া জসিম উদ্দিন বলেন, ‘র‌্যাব পরিচয়ধারী লোকগুলো আমাদের তিনজনকে আটকের পর অ্যাম্বুল্যান্সচালককে মারধর করে ধানক্ষেতে ফেলে দেয়। এরপর আমাদের চোখ বেঁধে ফেলে। চোখ বাঁধার পর হিরু ও হুমায়ুন ভাইকে কোথায় নেওয়া হয়েছে, তা আর বুঝতে পারিনি। রাতে চোখ খোলার পর দেখি লাকসাম থানায় রয়েছি। ’

পারভেজের স্ত্রী শাহনাজ বেগম বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। ছোট মেয়ে জান্নাতুল মাইশা তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। ছোট বলে বাবার অনেক আদরের ছিল। প্রতিনিয়ত বাবার জন্য কান্না করত। তার অবস্থা দেখে অনেক সময় মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে বলতাম, বাবা কিছুদিনের মধ্যেই ফিরবে। মাইশা এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। এখনো কান্না করে। কিন্তু এখন আর মিথ্যা সান্ত্বনা দেওয়া যায় না। ’

হিরুর ছেলে রাফসান ইসলাম বলেন, ‘বাবা বেঁচে আছেন, নাকি তাঁদের খুন করা হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চার বছর ধরে পাগলের মতো ঘুরছি। কোনো উত্তর আজও পাইনি। যদি শুনতাম মেরে ফেলা হয়েছে, তাহলে মনকে বুঝিয়ে তাঁদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করতাম। ’

সূত্রঃ কালের কন্ঠ

আরো পড়ুন