কুমিল্লার আসিফ কাঁদলেন, কাঁদালেন, চাইলেন ক্ষমা

ডেস্ক রিপোর্টঃ দেড় যুগের সংগীতজীবনে এই আসিফকে কেউ দেখেননি। সাধারণত তাঁর অ্যালবাম কিংবা গানের প্রকাশনা অনুষ্ঠান বেশ হই হুল্লোড়, আনন্দ-উল্লাসে কেটে যায়। এবার যোগ হয়েছে কান্না। মঞ্চে আসিফের সেই কান্না ছুঁয়ে যায় মিলনায়তনে বসা দর্শকের হৃদয়। আসিফ যখন মঞ্চ কথা বলতে বলতে কাঁদছিলেন, তখন সামনে বসা অতিথিরাও চোখ মুছেছেন। শুধু তা-ই নয়, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ইথুন বাবুর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় ক্ষমা চান আসিফ। আগত অতিথিদের অনেকেই বলেছেন, এমন আসিফকে তাঁরা আগে কখনো দেখেননি।

দেড় যুগ আগে সংগীতশিল্পী আসিফ আকবর তাঁর সংগীতজীবনের প্রথম অ্যালবাম ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ দিয়ে শ্রোতামহলে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পান। ইথুন বাবুর কথা, সুর ও সংগীতে এই অ্যালবাম আসিফের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। প্রথম অ্যালবামের সাফল্যের পর কোনো কারণে তাঁদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। এরপর একসঙ্গে কোনো অ্যালবামে দেখা যায়নি এই দুই তারকাকে। অভিমানের পাহাড় গলে গেছে। ‘চুপচাপ কষ্টগুলো’ শিরোনামের একটি গান দিয়ে আবার ফিরলেন এই দুই তারকা। জানালেন, এখন থেকে তাঁরা দুজন নিয়মিত নতুন গান প্রকাশ করবেন। তাঁদের এই সম্পর্ক আগের মতোই দুর্দান্ত গতিতে এগোতে থাকবে।

গতকাল রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর বিজয়নগরের একটি হোটেলে গানটির প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন বরেণ্য সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর, তপন চৌধুরী, খুরশিদ আলমসহ এ প্রজন্মের অনেক তারকা।

দীর্ঘ দেড় যুগ পর ইথুন বাবুর কথা, সুর ও সংগীতে নতুন গান প্রকাশ অনুষ্ঠানে জীবনের প্রথম দিককার অনেক কথা মনে পড়ে যায় আসিফের। কোনো কিছু না ভেবেই সেসব বলেন তিনি। আসিফ বলেন, ‘সাউন্ডের ব্যবসা করব বলে ১৯৯৭ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকায় আসি। কুমিল্লার ইফতেখার আহমেদ পিন্টু ভাই আমাকে নিয়ে যান শওকত আলী ইমন ভাইয়ের কাছে। আমি ওখানে গানের ডেমো ভয়েস দিতাম। আলী আকরাম শুভ ভাইয়ের সঙ্গেও পরিচয় হয় ওখানে। “ক্ষ্যাপা বাসু” সিনেমার একটি গান গাই। এই গান শুনে ইথুন বাবু ভাই আমাকে ডাকলেন। তখন আমি মাস্টার্স পড়ছি। ঢাকা-কুমিল্লা যাওয়া-আসা করি। আমি দুই সন্তানের বাবা। ইথুন বাবু ভাই একদিন আমাকে ডেকে বললেন, “তোকে এমন গান দিলাম, কোনো দিন পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।” অসহায় অবস্থায় যখন জাহাজ সমুদ্রে ভাসে, তখন মানুষ বাঁচার জন্য খড়কুটো খোঁজে। আমারও তেমন হয়েছিল। আমি সিদ্ধান্ত ভুল নিইনি। “ও প্রিয়া তুমি কোথায়” গানটি গাইলাম। সেই সময় ইথুন বাবু ভাইয়ের সঙ্গে রাতদিন গান নিয়ে থেকেছি। ঘুম থেকে ওঠাতাম তাঁকে, আবার তাঁকে বাসায় দিয়ে আমি বাসায় ফিরতাম।’

আসিফ আরও বলেন, ‘ইথুন বাবু ভাই আর আমার রাতজাগা অভ্যাস। একদিন সারা রাত কাজ। হঠাৎ গভীর রাতে আমার স্ত্রীর ফোন, ছোট ছেলে রুদ্র অসুস্থ। অজ্ঞান হয়ে গেছে। বললাম, তুমি তো আছ। কোনোভাবে সামলে নাও প্লিজ। হাসপাতালে নিয়ে যাও। ভোরে কাজ শেষে বাসায় ফিরি। ইথুন বাবু ভাই আমাকে গাড়িতে করে নিয়ে নামিয়ে দেন। আমি চলে যাচ্ছি, এই সময় আবার গাড়ি ঘুরিয়ে এসে বললেন, “তোর মন খারাপ কেন?” ইথুন বাবু ভাই আমাকে ৫০০ টাকা দিলেন। আমার পকেটে ছিল মাত্র ১০ টাকা। ইথুন বাবু ভাই বললেন, তুই রাতে আসবি। তোর টাকা আছে আমার কাছে। রাতে তোর টাকা দেওয়া হবে। ওই ৫০০ টাকায় আমি অ্যাংকর মিনি প্যাক দুধ কিনেছিলাম ২০ টাকা করে। ৬ প্যাকেট দুধ কিনলাম। ৬ প্যাকেট দুধের সঙ্গে ছয়টা চামচ ফ্রি। (এই কথা বলার সময় আসিফ কাঁদতে থাকেন। এমন সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইথুন বাবু এগিয়ে এসে আসিফের পিঠে হাত রাখেন) আমার বাসার জন্য এক সেট চামচ হলো। এই রকম অসংখ্য গল্প আছে ইথুন বাবু ভাইয়ের সঙ্গে। ইথুন বাবু ভাই মেজাজি মানুষ কিন্তু একদম শিশুর মতো মন। “ও প্রিয়া” যখন রিলিজ হবে, তখন সাউন্ডটেক হঠাৎ করে অ্যালবাম রিলিজ বন্ধ করে দেয়। ঈদে আর রিলিজ হবে না অ্যালবাম। আমার খুব মন খারাপ। আহমেদ রিজভী ভাই বললেন, এখন আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, এস ডি রুবেলদের মতো বড় শিল্পীদের অ্যালবাম বের হচ্ছে। তোমার অ্যালবামটি পরে বের হলেই ভালো। কারণ তোমার অ্যালবাম হিট হলেও পুনরায় অর্ডার পাবে না। মন খারাপ আমার। কুমিল্লা চলে গেলাম। সেবার আমি ঈদ করিনি। তবে আমি কিন্তু সামর্থ্যবান পরিবারের সন্তান। নিজের কষ্টগুলো শেয়ার করতে চাইনি।’

আসিফ বলেন, ‘কয়েক দিন পর ঢাকায় এলাম। ইথুন বাবু ভাই আমাকে ডাকলেন। ঢাকা শহরের গুলিস্তান থেকে মিরপুরের বিভিন্ন ফুটপাথে ওষুধ বিক্রেতাদের কাছে ঘুরে ঘুরে অ্যালবাম দিলাম। গান বাজাতে অনুরোধ করলাম। রাজশাহী, রংপুর থেকে শুরু করে সারা বাংলাদেশ ঘুরেছি ইথুন বাবু ভাইয়ের গাড়ি চড়ে। তিন মাস পরে অ্যালবামের ফলাফল পেলাম।’

গায়ক আসিফ আকবরের জীবনের এমন গল্প কাঁদায় উপস্থিত অতিথিদের। থমকে যান মঞ্চে থাকা অতিথিরাও। এমন সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইথুন বাবু এগিয়ে এসে আসিফের পিঠে হাত রাখেন। ইথুন বাবু বলেন, ‘আমি কিন্তু আগেই বলেছি, আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ, যাঁরা আমাদের ১৮ বছর সরিয়ে রেখেছিল। এই ভালোবাসার শেষ হয় না। ১৮ বছর পর আমি আমার ছেলেকে পেয়েছি, আমার যুবক ছেলেকে।’

‘চুপচাপ কষ্টগুলো’ শিরোনামের গানটির কথা, সুর ও সংগীত পরিচালনার পাশাপাশি ভিডিওটি পরিচালনা করেছেন ইথুন বাবু। আসিফ আকবরের সঙ্গে গানটিতে মডেল হয়েছেন অর্ণব ও মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের আলোচিত প্রতিযোগী জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল। ধ্রুব মিউজিক স্টেশনের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত আসিফের গানের কোরিওগ্রাফি করেছেন হাবিব।

আসিফ বলেন, ‘আমরা ১৯ বছর পর গানের কারণে একত্র হলাম। আমরা এই সময় কেউ কাদা ছোড়াছুড়ি করিনি। মিডিয়ার একটা অংশও আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরির চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। আমি আমার মতো করে ভালো আছি। ইথুন বাবু ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চাইছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।’

আসিফ বলেন, ‘আমার কষ্টের জীবন। পরিবার জানে না। পকেটে কোনো টাকা নাই। ঈদের সময় ইথুন বাবু ভাই তাঁর সন্তানদের জন্য কাপড় কিনতেন। সঙ্গে আমার আর আমার সন্তানদের জন্যও কিনতেন। এসব ঋণ শোধ হওয়ার নয়।’

সূত্রঃ প্রথম আলো

আরো পড়ুন