কুমিল্লার কৃতি সন্তান ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

ডেস্ক রিপোর্টঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত। স্বাধীনতা পদকজয়ী এই চিকিৎসকের জীবনের গল্প শুনেছেন আতাউর রহমান কাবুল।

আপনার জন্ম ও পারিবারিক ইতিহাস জানতে চাই?

কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার মহিচাইল গ্রামে ১৯৫৩ সালের ১ অক্টোবর আমার জন্ম। তখন পরিবারে শুধু আমার দাদুরই (অশ্বিনী কুমার) ঘড়ি ছিল। তিনি ডাক্তারি কাজে বাইরে ছিলেন। তাই জন্মের ক্ষণ ঠিক করতে ঘরের ছায়া ঠিক যেখানে পড়েছিল, সেখানে একটা দাগ দিয়ে রাখা হয়েছিল। পরের দিন ওই জায়গায় ছায়াটা দেখে আমার জন্মের সময় নির্ধারণ হয়েছিল সকাল প্রায় ৯টা ৫৯ মিনিট। ভাগ্য ভালো, সেদিন আকাশে মেঘ ছিল না। তা না হলে সঠিক সময় নির্ধারণ কঠিন হয়ে যেত। আমি বড় হয়েছি বিশাল যৌথ পরিবারে। অনেকে ধনী জোতদার পরিবারও বলতেন। বাবা কালাচান দত্ত ছিলেন পরিবারে বড় সন্তান। দাদু সেই আমলের পাস করা ডাক্তার হওয়ায় আমাদের বাড়িটা ডাক্তারবাড়ি নামেও পরিচিত ছিল। দাদুর পরিবারে বাবাসহ তিন ছেলে, এক মেয়ে। ছোট দাদুর ছিল পাঁচ ছেলে, এক মেয়ে। আমরা চার ভাই, তিন বোন। আমি দ্বিতীয়। তার মানে, ১০ জন কাকা-পিসির কোলে-পিঠে আমি বড় হয়েছি।

স্কুলজীবন কেমন ছিল?

ঠাকুরমাই আমার প্রথম শিক্ষক। তাঁর কাছেই বর্ণমালা শেখা। গ্রামের স্কুলটি ছিল ভাঙাচোরা। আমি স্কুলে যেতে চাইতাম না। ওখানে বিজ্ঞান বিভাগও ছিল না। তাই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে চলে গেলাম চান্দিনা মডেল পাইলট স্কুলে। সেটি আমাদের বাড়ি থেকে আট মাইল, আর মামার বাড়ি থেকে আড়াই মাইল দূরে ছিল। তাই মামার বাড়িতেই থাকলাম। তিনটি খালের ওপরে বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে মতিন মামা, সফিক, গৌরাঙ্গ পালসহ আরো অনেকের সঙ্গে দল বেঁধে স্কুলে যেতাম। আমার রোল নম্বর সব সময়ই ১ ছিল। যা ইচ্ছা করে বেড়াতাম। কাউকে মানতাম না। মতিন মামার সঙ্গে রাতে পেঁপেগাছের ডগা কেটে পাইপ বানিয়ে খেজুরগাছের রস খেয়ে ফেলতাম। মালিক যখন দেখলেন, প্রায় প্রতিদিনই রস কম হয়, তিনি একদিন সেই গাছে ধুতুরা লাগিয়ে রাখলেন। খেয়ে আমার তো একেবারে পাগলের মতো অবস্থা!

মেডিক্যাল শিক্ষার ইচ্ছা জাগল কিভাবে?

১৯৬৮ সালে চান্দিনা স্কুল থেকে পাঁচ বিষয়ে লেটার মার্কস নিয়ে ম্যাট্রিক পাস করি। এরপর ভর্তি হই কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। সেখান থেকে তিনটা লেটারসহ পাঁচ জন ইন্টারমিডিয়েট পাস করি ১৯৭০ সালে। তবে কখনো মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা ছিল না। ছোটবেলায় পড়েছিলাম, মাদাম কুরি একমাত্র নারী হিসেবে পদার্থ ও রসায়নে দুটি নোবেল পেয়েছেন। আমারও ইচ্ছা ছিল পদার্থ ও রসায়নে পড়ব, গবেষণা করব এবং নোবেল পাব। তবে বাবা, কাকা, দাদুসহ পূর্বপুরুষরা সবাই ডাক্তার ছিলেন বলে তাঁরা চাইছিলেন আমিও যেন ডাক্তার হই।

ডাক্তারিতে ভর্তি হতে বাবা টাকা দিলেন। কিন্তু বন্ধু ক্যাবিনেট সেক্রেটারি আজিজ, মোখলেসসহ আমরা দল বেঁধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি বিভাগে ভর্তি হয়ে গেলাম। বাড়ি যাওয়ার পর বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভর্তি হয়েছ?’ বললাম, ‘হইছি।’ তিনি আর কিছু জিজ্ঞেস করেননি। আমিও বলিনি। বাবার এক স্কুল জীবনের বন্ধু ছিলেন গাইনি চিকিৎসক সৈয়দ ফিরোজা বেগম। থাকতেন ঢাকার ১৯ নম্বর গ্রিন রোডে। মেডিক্যালে ভর্তির শেষ দিন সেই ফিরোজা ফুফু তাঁর ড্রাইভারকে দিয়ে চিঠি পাঠিয়ে বাবাকে জানালেন, ‘তোমার ছেলে তো ভর্তি হয়নি।’ বাবার মাথায় তখন বাজ পড়ার মতো অবস্থা। যাই হোক, অনেক ঝগড়াঝাঁটির পর বাবা আমাকে নিয়ে ঢাকায় এলেন। ফিরোজা ফুফু একটা চিঠি লিখে দিলেন চিটাগং মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন প্রফেসর মান্নান স্যারের কাছে। লিখলেন, ‘ছেলেটা অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট। তোমাদের তো এখনো ভর্তি শুরু হয়নি। তুমি ওকে ভর্তি করিয়ে নিও।’ এরপর বাবার সঙ্গে রাতের মেইল ট্রেনে চট্টগ্রামে পৌঁছে ওনার ডিপার্টমেন্টে গেলাম। তিনি মার্কশিট দেখে বললেন, ‘যাহ বেটা!’ এরপর ভাইভায় অংশ নিলাম। শুধু গেলাম আর এলাম। এই হলো এমবিবিএসে ভর্তির ইতিহাস!

মেডিক্যাল কলেজ, হোস্টেল জীবনের সে সময়গুলো কেমন ছিল?

ক্লাস শুরু হওয়ার সময় বাবা নিজে নিয়ে গেলেন হোস্টেলে উঠিয়ে দেবেন বলে। তখন শর্ত দিলাম, আমাকে একটা ‘সনি টুইনওয়ান’ কিনে দিলে ভর্তি হব। চট্টগ্রাম নিউ মার্কেট থেকে ৭০০ টাকা দিয়ে একটা সনি টুইনওয়ান এবং রেকর্ড করা কিছু ক্যাসেট কিনে দিলেন বাবা। এরপর হোস্টেলে সিট পেতে কোনো সমস্যা হলো না। আমার হাতে টুইনওয়ান দেখে এক সিনিয়র ছাত্র বললেন, ‘ঠিক আছে, ও আমাদের সঙ্গেই থাকবে!’

মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে গিয়েছিলেন।

পাকিস্তান আর্মি আমাদের মেডিক্যাল কলেজ দখল করার পর চট্টগ্রামের দক্ষিণে, বাঁশখালীর দিকে পালিয়ে যাই আমরা। সেখান থেকে ইউটার্ন নিয়ে, তিন-চার দিন ধরে কুমিল্লার দিকে আসি। বাড়ি এসে শুনি, অল্প বয়সী সব ছেলে-মেয়েকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখন বাবা আর দাদু বললেন, ‘ইন্ডিয়ায় চলে যাও।’ ৬ এপ্রিল ভারতের সোনামোড়ায় গিয়ে উঠলাম। সেখানে মুজিব বাহিনীর ইস্টার্ন সেক্টরের আঞ্চলিক অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মণি, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতা সৈয়দ রেজাউর রহমান (বর্তমানে পাবলিক প্রসিকিউটর), অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী, সৈয়দ আহমেদ ফারুক, মনিরুল হক চৌধুরী, মাঈনূল হুদাসহ ভিক্টোরিয়া কলেজের অনেক বন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধার দেখা পেলাম। সোনামোড়ার এসডিও হিলে গোপাল চৌকিদার নামের এক ভদ্রলোকের বাড়িতে, ছোট্ট একটা ঘরে থাকতাম। মুজিব বাহিনীর চার সেক্টরের মধ্যে সিলেটসহ পুরো চট্টগ্রাম বিভাগ নিয়ে গঠিত হলো ইস্টার্ন সেক্টর। সেটির নেতৃত্বে ছিলেন মণি ভাই। সিরাজ ভাই ছিলেন শিলিগুড়িতে। ভবানীপুরের নর্দার্ন পার্কের পাশে, সানী ভিলায় থাকতেন উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক তোফায়েল আহমেদসহ অন্য ছাত্রনেতারা। আর আবদুর রাজ্জাক ছিলেন শিলংয়ে। আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্পে জেনারেল সোয়াং সিং ওভান ছিলেন মুজিব বাহিনীর চিফ কো-অর্ডিনেটর। পরে তাঁর ছেলে মেজর জেনারেল ওভান পিতার পক্ষে বাংলাদেশে এসে সম্মাননা গ্রহণ করেছেন।

ভারতের দিনগুলো কেমন কেটেছিল?

সংগঠক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে ৮ জুলাই দেশে ফিরে আসি। মাসখানেক পর মণি ভাই আবার ভারতে ডেকে নেন। তিনি একবার তিন স্যুটকেসভর্তি টাকা কলকাতা থেকে আগরতলা পর্যন্ত বহন করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমাকে। হাতের লেখা সুন্দর হওয়ায় তিনি আমাকে দিয়ে চিঠি লেখাতেন। মণি ভাই চিঠিগুলো লিখতেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের কাছে। দেশের ভেতরেও চিঠি পাঠানো হতো। কিছুদিন আগে ভারতের ইস্টার্ন কমান্ড যখন আমাদের সংবর্ধনা দিল, তখন সেখানকার ওয়েস্ট বেঙ্গল জাদুঘরে একটি চিঠি লিখে দিয়ে এসেছিলাম—সেই ডকুমেন্টগুলো সেখানে আছে কি না। কিন্তু পাওয়া গেল না। ওগুলো পেলে একটি ঐতিহাসিক দলিল হতো।

আবার দেশে এলেন কবে?

দ্বিতীয়বার ভারত থেকে দেশে ঢুকি সেপ্টেম্বর মাসে। শুনলাম, মাদারীপুরে লিটন চৌধুরী ও তাঁর মা, সেরনিয়াবাত সাহেবের স্ত্রী ও সন্তান এবং মণি ভাইয়ের স্ত্রী—এই তিনটি পরিবার আটকা পড়েছে। তাদের উদ্ধার করতে চাঁদপুর গেলাম। নদীর ধারে আওয়ামী লীগের এক নেতার ‘সোনার বাংলা’ নামে এক হোটেলে থাকতাম। কিন্তু মাদারীপুর থেকে তাঁদের লঞ্চে আসতে বেশ দেরি হলো। আমরা যে মুক্তিবাহিনীর লোক, এটা আর্মি জেনে গেছে—এই অজুহাতে সেই নেতা আমাদের একটা নৌকা ভাড়া করে দিয়ে বললেন, ‘আপনারা নদীতেই থাকেন।’ দুই রাত নদীতে থাকলাম। মশার কামড়ে শরীরের অবস্থা মোটামুটি ডাবল হয়ে গেল! একপর্যায়ে তাঁরা লঞ্চে করে আমাদের কাছে পৌঁছলেন। সেখান থেকে ট্রেনে লাকসাম, লাকসাম থেকে বরুরা, বরুরা থেকে এলাম আমাদের বাড়ি চান্দিনায়। দুঃখজনক বিষয়, চান্দিনায় আসার পর এত লোক ও আমাকে বাবা জায়গা দিতে চাননি পাকিস্তানি আর্মি জেনে যাওয়ার ভয়ে। পানের বরজের ভেতর আমাদের লুকিয়ে রাখা হলো।

সেইবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন।

ওই তিন পরিবারকে নিয়ে দেবিদ্বারে এক বাড়িতে উঠেছিলাম। খুব ভোরে রিকশা নিয়ে তাঁদের পৌঁছে দিতে ময়নামতি থেকে সিলেট রোড ক্রস করি। তাঁদের রিকশাগুলো আগে চলে গেল। আমার সঙ্গে বাদল নামে একটি ছেলে ছিল। তার সঙ্গে রাজাকারের আইডি কার্ডসহ আরেকজন লোকও ছিল। আমি সব সময় বলি, সব রাজাকার কিন্তু স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল না, তারা অনেক সময় মুক্তিবাহিনীকে সহায়তাও করেছে। হঠাৎ পাকিস্তানি আর্মির একটি গাড়ি এসে বলল, ‘হল্ট।’ রাজাকার লোকটি তার ডান্ডি কার্ড বের করল। তারা প্রশ্ন করল, ‘ইসকো কোন হ্যায়?’ সে জবাব দিল, ‘হামারা ভাই হায়।’ ‘মুসলমান হায়?’ ‘ইয়া।’ ‘কলমা বাতাও।’ কিন্তু ছেলেটি মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও কলেমা বলতে পারল না। এরপর তাকে লাথি মেরে গাড়িতে তুলে নিল। আমি ছিলাম পরের রিকশায়। আমাকে জিজ্ঞেস করার আগেই কলেমা বলে দিলাম। এরপর প্রশ্ন করল, ‘আপকা নাম কিয়া হ্যায়?’ বললাম, ‘আবু উসমান বুখারি।’ তারা বলল, ‘ইয়ে তো আচ্ছা নাম হায়।’ এই নামটি কিন্তু মণি ভাই আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন বুখারি নামের একজনকে তখন পুরো কুমিল্লার সবাই চেনে। তারা আমাকে ও ডান্ডি কার্ডধারী ওই রাজাকার ছেলেটিকে ছেড়ে দিল। রাস্তাটা ক্রস করে আমরা তখন দুই হাজার মিটারের মতো দূরত্বে গেছি। আমাদের দুজনের কাছেই দুটি পয়েন্ট থ্রি এইট বোরের রিভলবার ছিল। বাদলকে গাড়িতে তোলার পরই সার্চ করে ওর পায়ের নিচে রিভলবারটা পেয়ে গেল। এরপর ওই গাড়ি থেকেই ওরা ব্রাশফায়ার করা শুরু করল। কিন্তু আমরা তখন রেঞ্জের বাইরে চলে গেছি বলে বেঁচে গিয়েছিলাম। ছেলেটির কী পরিণতি হলো, তা তো বলাই বাহুল্য।

ছাত্ররাজনীতি শুরু করেছিলেন ঠিক কবে থেকে?

১৯৬৮ সাল থেকেই ছাত্রলীগ করি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে থাকা অবস্থায় ইকবাল হলে ছাত্রলীগের কুমিল্লা ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলর হয়েছিলাম। নিউ হোস্টেলের আমরা মাত্র তিনজন ছাত্রলীগ করতাম। বাকি সবাই করত ছাত্র ইউনিয়ন। ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে আমি যখন দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি, পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থীরা থাকার পরও ছাত্র সংসদের নির্বাচনে পরিচিতি সভার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছিল। আমি অবশ্য বেশ ভালো বক্তা ছিলাম। আমিই চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রলীগের প্রথম সদস্য; তারপর একে একে প্রচার সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক এবং পঞ্চম বর্ষে ওঠার পর ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছিলাম।

বাবা মারা যাওয়ার পর নাকি ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন?

১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর বাবাকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেল। আমি তখন ইন্ডিয়ায়। আমার বন্ধুবান্ধব ওদেরকে বলল, যদি প্রাণ গোপালের বাবার কিছু হয়, তাহলে কিন্তু সবার বংশ নির্বংশ করে ফেলব। বাবাকে খুব টর্চার করে, একপর্যায়ে ছেড়েও দিল। কিন্তু ১৩ নভেম্বর রক্তবমি করে তিনি মারা গেলেন। খবরটা জেনে সেদিনই ইন্ডিয়া থেকে ফিরে এলেও বাবাকে দেখতে চিতা পর্যন্ত যেতে পারিনি। ফের চলে গেলাম ইন্ডিয়ায়। ১০ ডিসেম্বর আবার ফিরে এসে বাবার শ্রাদ্ধ করলাম। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম, বাবা যেহেতু মরে গেছেন, এখন ডাক্তারি না পড়লেও চলবে। তখন পড়াশোনা ছেড়ে ঢাকা ও কুমিল্লা ঘুরি-ফিরি। উদাস উদাস ভাব আর কি!

কী ভেবে আবার মেডিক্যাল কলেজে ফিরে গেলেন?

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে দাদুর কথায় আবার মেডিক্যালে ফিরে গেলাম। গিয়ে দেখি মারামারি, কাটাকাটি অবস্থা। ছাত্রলীগ তখন আ স ম আবদুর রব আর শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বে দুই ভাগে বিভক্ত। আমরা মুজিববাদী ছাত্রলীগ রয়ে গেলাম নূরে আলম সিদ্দিকী আর আবদুল কুদ্দুস মাখন ভাইয়ের নেতৃত্বে। তখন টগবগে রক্ত। অনেকের কাছেই অস্ত্র আছে। ১৯৭৩ সালে একবার আ স ম আবদুর রব আর মাহমুদুর রহমান মান্না চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে সমাবেশ করতে গেলে, আমরা বাধা দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিলাম! তবে লেখাপড়া নিয়ে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। তা ছাড়া ১০০ টাকা স্কলারশিপ পেতাম ওই সময়ে। কৃষিই আমাদের আয়ের প্রধান উৎস ছিল। ১৯৭৪ সালের দিকে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের একটা লাভ হলো। এক মণ চাল বিক্রি করে চার-পাঁচ শ টাকা পাওয়া যেত, যা তখনকার একজন ডাক্তারের বেতনের প্রায় সমান।

চিকিৎসা পেশায় প্রবেশ করেন কবে?

১৯৭৬ সালে মেধাতালিকায় স্থান নিয়েই এমবিবিএস পাস করি। এর পরই চাকরিতে ঢুকে যাই। সেটি ছিল ‘ইন সার্ভিস ট্রেইনি’, মানে চাকরিতে প্রশিক্ষণার্থী। ৪৭৫ টাকা স্কেলে ৬০০ টাকা বেতন পেতাম তখন। বিসিএস টাইপের কোনো কিছু তখন ছিল না। পাস করার পর তিন বছর গ্রামে চাকরি করব বলে বন্ড সইও দিয়েছিলাম মেডিক্যালে ভর্তির সময়ই। সেখান থেকে ইন্টার্নশিপ শেষে পোস্টিং হলো চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে।

পিজি হাসপাতালে যোগ দিলেন কবে?

১৯৭৯ সালে আইপিজিএমআরে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) নাক-কান-গলা বিভাগের (ইএনটি) এফসিপিএস পরীক্ষায় সিলেক্ট হলাম। তখনো ইএনটিতে কেউ এফসিপিএস পাস করেনি। পরে স্কলারশিপ নিয়ে রাশিয়া গিয়ে পাঁচ বছরের কোর্স সাড়ে তিন বছরে শেষ করে দেশে ফিরলাম। এর পর চট্টগ্রাম মেডিক্যালে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদের বিপরীতে অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন হিসেবে যোগ দিলাম। ১৯৮৪ সালে পিএসসি দিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হলাম। ১৯৮৭ সালে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী আমাকে পানিশমেন্ট ট্রান্সফার দিয়ে রংপুর মেডিক্যাল কলেজে পাঠিয়ে দেন। সেখানে আড়াই বছর কাজ করে আবার আইপিজিএমআরে ফিরে আসি। ১৯৮৯ সালে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং ১৯৯৬ সালে প্রফেসর হলাম। সলিমুল্লাহ মেডিক্যালে ছিলাম দুই বছর। ১৯৯৮ সালে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হলো, সেখানে যোগ দিলাম। ২০০০ সালে ট্রেজারার এবং ২০০৯ সালের ২৫ মার্চ হলাম ভাইস চ্যান্সেলর। পর পর দুই মেয়াদে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এ পদে ছিলাম। এরপর বিভাগে ফিরে না গিয়ে অবসর নিয়েছি।

আপনার সময়ে বিএসএমএমইউর যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে কাজ করা আমার জন্য বেশ সহজ ছিল। কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে খুব স্নেহ করেন। অনেক বাধা, চ্যালেঞ্জ, হুমকি-ধমকি ছিল। অথচ আমি কোনো কিছুকে বাধা মনে করিনি। শাহবাগের ওষুধের দোকানগুলো বাইরের লোকদের দখলে ছিল। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর চারটা কোর্ট থেকে রায় বের করেছি। দখল নিয়ে যাঁরা দোকানের মালিক ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে চুক্তি করেছি। এ ছাড়া কেবিন ব্লকের উল্টো দিকে জায়গাটা ছিল নবাবদের। এই জায়গাটা রাজউক ও ডিসি অফিস অনেককে বরাদ্দ দিয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এক দিন বললেন, ‘এই জায়গাটা কিভাবে নেওয়া যায়, চেষ্টা করো।’ ওনার তখনকার পিএস নজরুল ইসলাম খান (এন আই খান) ও ঢাকার ডিসি মুহিব ভাইয়ের সহযোগিতায় স্বাস্থ্য, পূর্ত ও ভূমি মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে জায়গাটা ফিরে পেলাম। আমি যখন ট্রেজারার ছিলাম, তখন শেরাটনের উল্টো দিকের জায়গাটা বুঝে পেলাম। সর্বশেষ রেডিও সেন্টারটি বিএসএমএমইউর আওতাধীন নিয়ে এলাম। এখানে আরো অনেকেরই নামই উল্লেখ করার মতো; তবে তখনকার ভূমি সচিব আতাহার ভাই ও মুখ্যসচিব বন্ধুবর করিমের নাম বিশেষভাবে স্মরণ করতে চাই। অবশ্য দুঃখজনক হলো, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে আমি যতটুকু করে এসেছি, এরপর কোনো অগ্রগতি হয়নি। আউটডোরের পাঁচতলা একটা বিল্ডিংয়ের (যার ১৪ তলা ফাউন্ডেশন করা) একটা ব্লক করেছিলাম বিএসএমএমইউর নিজস্ব অর্থায়নে। অথচ গত পাঁচ বছরেও এটা আর ওপরে উঠতে দেখলাম না। কোরিয়ানদের সঙ্গে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের প্রজেক্টও এক বছরের মধ্যে সম্পাদন করে দিয়ে এসেছিলাম।

চিকিৎসা পেশাকে কতটুকু উপভোগ করেন?

একসময় ভেবেছিলাম, ডাক্তার হয়ে কী করব? সার্বিক বিবেচনায় এখন মনে হচ্ছে, মানুষের জন্য কিছু করার এত বড় সুযোগ অন্য কোনো পেশায় নেই। রোগীরা যখন বলেন, ‘ডাক্তার সাহেব উপরে আল্লাহ, নিচে আপনি; আপনার হাতেই রোগীকে ছেড়ে দিলাম’—তখন গর্বের সঙ্গে ওই গুরুদায়িত্ব পালনে ব্রতী হতে আনন্দ বোধ করি। একজন লোক অনেক অসুস্থ হয়ে এলেন, ব্যথায় ছটফট করছেন; তিনি চিকিৎসার পর হাসিমুখে সামনে দিয়ে বিদায় নিয়ে গেলেন। এটা একটা বড় স্বস্তির বিষয়। একবার এক মা তাঁর রুগ্ণ বাচ্চাকে নিয়ে এলেন। শিশুটি একেবারে মরে যাচ্ছে। সেই বাচ্চাটাকে চার দিন পর মা কোলে করে নিয়ে গেলেন হাসতে হাসতে। এটা যে একজন ডাক্তারের জন্য কত আনন্দের ব্যাপার, বলে বোঝানো যাবে না। তাই মনে মনে বলি, ‘বাবা, তুমিই সঠিক ছিলে।’

লোকমুখে শোনা যায়, ইএনটির ডাক্তার মানেই প্রাণ গোপাল দত্ত

আমার চেয়েও ভালো ডাক্তার দেশে আছেন। অথচ অনেক রোগী শুধু আমাকেই দেখাতে চায়। আমি হয়তো দুই বেলা ৬০টি রোগী দেখব। কিন্তু আমার কাছে আসে ৬০০ রোগী। এত রোগী দেখা কিভাবে সম্ভব? আমি যখন পান্থপথের চৌরাস্তার ওপরে চেম্বার করি, তখন সিস্টেম করলাম—কোনো ডাক্তার রেফার না করলে রোগী দেখব না। এরপর কিছু রোগী ফেরত যেত। পরে জানলাম, বিভিন্ন ফার্মেসিওয়ালা নিজেরাই ডাক্তারের বিভিন্ন নামে প্যাড সিল বানিয়ে ১-২ শ টাকা নিয়ে রেফারেল লিখে দিচ্ছে। তাহলে সিস্টেম কন্ট্রোল করব কী করে? তাই এখন আমি যত দূর পারি, দেখি। না হলে হাতজোর করে মাফ চেয়ে চলে যাই। ইটস সিম্পলি ইমপসিবল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে স্বাধীনতা পদক গ্রহণ করছেন অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

এখন আপনার সময় কাটছে কিভাবে?

এখন আমার খুব ভালো সময় কাটছে। প্রায় দিনই পাবলিক হেলথ বিষয়ে ক্লাস নিতে চলে যাই জুডিশিয়াল ট্রেনিং একাডেমি, ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ (এনডিসি), সাভারের পিএটিসি, রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমি, কক্সবাজারের বিয়াম, নীলক্ষেতের এনএপিডি, ল্যান্ড রিকুইজিশন ট্রেনিং সেন্টারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। প্রখ্যাত শিশু মনোবিজ্ঞানী সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুলের নেতৃত্বে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কিছু কাজ করি। তাঁর কাজও আমার নিষ্প্রভ চোখকে আলোতে উদ্ভাসিত করেছে। নিয়মিত রোগী দেখার পাশাপাশি নিজ এলাকায় কিছু সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি।

ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে চাই

আমার স্ত্রী জয়শ্রী রায়। তিনি ঢাকা মেডিক্যালে গাইনির প্রফেসর ছিলেন। তাঁকেও আমি ভলান্টারি রিটায়ারমেন্টে নিয়ে এসেছি। আমি যেমন ভিসির পদ থেকে আর ডিপার্টমেন্টে ফিরে যাইনি, তিনিও রিটায়ারমেন্টের পর গ্রিন লাইফ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গাইনির প্রফেসর হিসেবে কাজ করছেন। আমার মেয়ে অনিন্দিতা দত্তকে আমার আমলে বিএসএমএমইউতে ঢুকাইনি। পরে সে এমডি করে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে ওখানে নিজ গুণে ঢুকেছে। ছেলে অরিন্দম দত্ত এখন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিকসে পড়ালেখা করছে।

আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

বড় একটি ক্যান্সার হাসপাতাল করব। জেনারেল হাসপাতালও হবে; তবে ক্যান্সারের ওপর বেশি জোর দেব। সেখানে প্যালিয়েটিভ ইউনিট থাকবে। ২০০৩ সালে আমার নিজের গ্রামে এর কাজ শুরু করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু তখনকার স্থানীয় এমপির কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। নিজের এলাকায় করতে চাওয়ার কারণ, ওই জায়গায় করলে ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় অঞ্চলের রোগীরা বেশি আসবেন। এখন আমাদের রোগীরা যেমন ভারতে যায়, কিন্তু এই রোগীদের ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য ত্রিপুরা থেকে কলকাতা যাওয়ার চেয়ে কুমিল্লায় আসা সহজ হবে। এখনো যেমন আমার এখানে প্রতি শনিবারে দুই-চারটা রোগী আসে ত্রিপুরা থেকে। আমি গ্রামেই হাসপাতাল করতে চাই। কারণ এখানে চিকিৎসা সুবিধা শহরের তুলনায় অপ্রতুল।

এবার কি জাতীয় সংসদ নির্বাচন করছেন?

ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এলাকায় কিছু করতে গেলে আপনি এমপি না হলে পারবেন না। হয়তো সব এমপির বেলায় এ কথা প্রযোজ্য নয়। আমি দুই বছর ধরে আমার নির্বাচনী এলাকায় কাজ করছি। মানুষের সঙ্গে খুব কাছে থেকে মিশেছি। এখন মনে হচ্ছে, আমাকে আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন দিলে নির্বাচিত হতে পারব। আর নমিনেশন না দিলে নৌকা নিয়ে যে যাবেন, তাঁর পেছনে কাজ করে তাঁকেই জিতিয়ে আনব। আমি মনে করি, আমার যত অভিজ্ঞতা, সেটা কাজে লাগালে স্বাস্থ্য খাত নিঃসন্দেহে অনেক উন্নত হবে।

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ

আরো পড়ুন