কুমিল্লার নারী জাগরণের অগ্রদূত উপেক্ষিত নবাব ফয়জুন্নেছা

ডেস্ক রিপোর্টঃ আজ ২৩ সেপ্টেম্বর রবিবার। ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র মহিলা “নবাব” ফয়জুন্নেছার ১১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। নারী শিক্ষার অগ্রদূত নওয়াব ফয়জুন্নেছা ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম কবি-সাহিত্যিক। মৃত্যুর ১১৮ বছর আর স্বাধীনতার ৫০ বছরেও রাষ্ট্রীয় কোন মর্যাদা বা স্বীকৃতি না মেলায় নওয়াব ফয়জুন্নেছার জন্মস্থান কুমিল্লার লাকসামবাসীর মনে ক্ষোভের যেন শেষ নেই।

অথচ আরেক মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মের সাত বছর আগে বেগম রোকেয়ার জন্মের ৪৬ বছর আগে কুমিল্লার লাকসামে ১৮৩৪ সালে ডাকাতিয়া নদীর উত্তর তীরে খান বাহাদুর বাড়িতে নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী জন্মগ্রহণ করেন। বেগম রোকেয়ার ৭ বছর আগে ১৮৭৬ সালে তিনি ‘রূপজালাল’ কাব্যগ্রন্থ রচনা করে সে সময় বেশ সাড়া জাগান। ‘রূপজালাল’ নামে গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় নারী লেখিকার প্রথম প্রকাশিত বই। নবাব ফয়জুন্নেছার রূপ জালাল কাব্য গ্রন্থের কপি কুমিল্লায় সংরক্ষিত আছে। সংরক্ষিত আছে লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীর বাংলা বিভাগে। বাংলা একাডেমী ১৯৮৩ সালে এ গ্রন্থটি পুনঃ মুদ্রন করেছে। এছাড়াও নবাব ফয়জুন্নেছা সংগীত লহরী ও সংগীত সার নামে আরও ২টি গ্রন্থ রচনা করেন। 

উপমহাদেশের একমাত্র মহিলা নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী নারী জগতের উজ্বল নক্ষত্র। দানবীর এ মহিয়সী নারী প্রচার বিমুখ ছিলেন। নারী লেখিকাদের পথপ্রদর্শকও ছিলেন নবাব ফয়জুন্নেছা। নবাব ফয়জুন্নেছার রূপজালাল কাব্যগ্রন্থ তার স্বামী গাজী চৌধুরীর নামে উত্সর্গ করেন। নবাব ফয়জুন্নেছার বাবার নাম সৈয়দ আহম্মদ আলী চৌধুরী। তার মার নাম আরফান্নেছা চৌধুরানী।

কথিত আছে, বিয়ের ১৭ বছর পর ১৮৫১ সালে নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী জানতে পারেন তার স্বামী হাছান আলী জমিদারের আরেকটি স্ত্রী রয়েছে। মহীয়সী নারী নবাব ফয়জুন্নেছা তার সতীন থেকে পৃথক থাকার জন্য সাড়ে ৩ একর জমির উপর তার বিয়ের কাবিনের ১ লাখ ১ টাকা দিয়ে বাড়িটি নির্মাণ করেন। স্থাপত্যকলার অপূর্ব নিদর্শন বাড়িটি নির্মাণ করতে প্রায় ৩ বছর সময় লেগে যায়। ব্রিটিশ আমলের সিমেন্ট, রড, চুন ও সুরকি দিয়ে বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। নারী জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র নবাব ফয়জুন্নেছা অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। তিনি পর্দার আড়াল থেকে এ বাড়িটিতে বসে উপমহাদেশের সব বিচারকার্য সম্পাদন, রাস্তাঘাট, পুল-ব্রিজ, স্কুল-মাদ্রাসাসহ যাবতীয় জনকল্যাণমূলক কাজ পরিচালনা করতেন। বাড়ির পাশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন দশ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। কালের বিবর্তনে নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি নবাব বাড়ি হিসেবে দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।

ফয়জুন্নেসার আমলে কুমিল্লা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট কুমিল্লার লোকদের উপকারার্থে একটি জনহিতকর কাজে হাত দিয়ে সমস্যায় পড়েন। এসময় মানবতাবাদী নবাব ফয়জুন্নেসা চাহিদা অনুযায়ী টাকার একটি তোড়া দান হিসেবে প্রদান করেন। তার এই দানশীলতার কথা মহারানী ভিক্টোরিয়া জেনে মহারানী হুকুম করেন তাকে ‘বেগম’ উপাধি দেয়ার জন্য। ফয়জুন্নেসা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, জমিদার কন্যা ও স্ত্রী হিসেবে অনেক আগেই এই পদবিতে তিনি ভূষিত। পরে মহারানী ঠিক করেন, এই মহৎ মহীয়সী নারীর একমাত্র সার্থক সম্মান ‘নবাব’ উপাধি-ই হতে পারে। রানীর নির্দেশ অনুযায়ী ১৮৮৯ সালে কুমিল্লার নবাব বাড়ির অট্টালিকায় ৩৫ হাজার টাকা ব্যয়ে এই উপাধি দেয়ার উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। হিরক খচিত মহামূল্যবান পদক দিয়ে তাকে ‘নবাব’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বেগম ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী পর্দার অন্তরাল থেকে এই উপাধিটি গ্রহণ করেন।

তার জমিদারির ১১টি কাচারির প্রতিটির পাশে বিশুদ্ধ পানির জন্য পুকুর এবং মক্তব ও প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সে সময় তার তত্ত্বাবধানে নির্মিত বালিকা বিদ্যালয়টি কালের সাক্ষ্য বহন করেছে। নবাববাড়ির বালিকা বিদ্যালয়টি কালক্রমে লাকসাম ফয়জুন্নেছা ও বদরুন্নেছা যুক্ত উচ্চ বিদ্যালয় (বিএন হাইস্কুল) রূপ নিয়েছে। তত্কালীন মাদরাসা আজ লাকসাম নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ হিসেবে এলাকায় আধুনিক শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করেছে। নবাব ফয়জুন্নেছা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ নির্মাণ কাজেও বিরাট অনুদান প্রদান করেছিলেন। কুমিল্লা শহরে ১৮৭৩ সালে নবাব ফয়জুন্নেছা দুটি বালিকা বিদ্যালয স্থাপন করেন। শহরের পূর্ব প্রান্তে নাজুয়াদীঘির পাড়ে প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয় এবং অপরটি বাদুরতলার উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন নারীশিক্ষায় অগ্রণি ভূমিকা পালনকারী। লাকসামে নবাব ফয়জুন্নেছা তার বাড়ির পাশে দশগম্বুজ মসজিদ স্থাপন করেন। মসজিদের দক্ষিণে পারিবারিক কবরস্থানে নবাব ফয়জুন্নেছাকে চিরদিনের জন্য সমাহিত করা হয়। নারীর স্বাস্থ্য সেবায় ১৮৯৩ সালে নবাব ফয়জুন্নেছা কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালে মহিলা ওয়ার্ড স্থাপন করেন। এছাড়াও লাকসামে দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র, ব্রীজ, কালভার্ট ও মসজিদ নির্মাণ করে একজন দক্ষ দানবীর নেত্রীর ভুমিকা রাখেন।

১৮৯৪ সালে তিনি পবিত্র হজ পালনের জন্য মক্কা গমন করেন। সেখানে গিয়েও তিনি অনেক দান করেন এবং মক্কা শরীফে একটি মুসাফিরখানা প্রতিষ্ঠা করেন। যা এখনো বিদ্যমান। মক্কাশরীফ থেকে এসে পরিবার-পরিজনদের জন্য সামান্য কিছু সম্পত্তি রেখে বাকি সমস্ত সম্পত্তি আল্লাহর নামে ওয়াকফ করে দেন। সম্পত্তি ওয়াকফ করার পর তিনি বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মক্তব ও হাসপাতাল নির্মাণে অনেক টাকা দান করেন। তার ব্যক্তিগত দৈনন্দিন দিনযাপনের তালিকাতেও অনেককিছুু শিক্ষণীয় বিষয় রেখে গেছেন আমাদের জন্য। যদিও তার স্বামী মোহাম্মদ গাজী নবাব ফয়জুন্নেসার সঙ্গে ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছিলেন কিন্তু তিনি একজন উচ্চবংশীয় জমিদার ও সুরুচির অধিকারী মানুষ ছিলেন। বেগম ফয়জুন্নেসা দুই কন্যা সন্তানের জননী ছিলেন। তার দু’কন্যার নাম আসাবুন্নেসা ও বদরুন্নেসা। এই মহীয়সী নারী ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ খ্রীস্টাব্দ ইহলোক ত্যাগ করেন। একুশে পদক প্রদানের মধ্যে দিয়ে তার অসীম কাজের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল।

নবাব ফয়জুন্নেছার পরিবারের পঞ্চম বংশধর মাসুদুল হক চৌধুরী বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকের বলেন, ‘জাতীয়ভাবে নওয়াব ফয়জুন্নেছার সামাজিক ও মানবিক কর্মকান্ডগুলোকে তুলে ধরা হয়নি। নবাব ফয়জুন্নেছাকে তুলে ধরা গেলে উপকৃত হতো আগামী প্রজন্ম। এছাড়া নবাব ফয়জুন্নেছার জমিদার বাড়িটি সংস্কার করে যাদুঘর করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান তিনি।

আরো পড়ুন