কুমিল্লা জুড়ে আলোচনায় বুড়িচংয়ে নৌকার ভরাডুবি

মোবারক হোসেনঃ বুড়িচং উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার ভরাডুবিতে ব্যাপক আলোচনা, বিশ্লেষণ চলছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী এডভোকেট আবুল হাসেম খান ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে একজন স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। পাশাপাশি দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কখনো নৌকা কিংবা শেখ হাসিনার নির্দেশের বাইরে যাননি। এ কারণেই বেশি আলোচনা, বিশ্লেষণ চলছে বুড়িচং জুড়ে।

অপরদিকে আওয়ালী লীগের অপর ত্যাগী নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়া নিয়েও সমান তালে বিশ্লেষণ চলছে। হাট-বাজার সর্বত্র একটিই আলোচনা নৌকার শোচনীয় পরাজয়। বুড়িচংয়ের পার্শ্ববর্তী ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় নৌকার প্রার্থীর পরাজয়টা জনগণ যেমনটা মেনে নিয়েছেন, বুড়িচংয়ের ক্ষেত্রে তা ভিন্ন। বিভিন্ন স্থানে নির্বাচন নিয়ে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে তা এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হল।

এটি একটি হাট-বাজারের আলোচনার বিষয়। প্রতিবেদনটিতে কাউকে খাটো করা কিংবা কাউকে উচ্ছসিত প্রশংসার জন্য করা হয়নি। প্রতিটি কেন্দ্রের ফলাফলও তুলে ধরা হয়েছ প্রতিবেদনে। তাই পাঠকরাই বিবেচনা করবে নৌকার পরাজয়ের বিষয়টি। কারা দায়ী, কেন দায়ী তাও পাঠকরা বিবেচনা করবে। প্রতিবেদক শুধুমাত্র হাট-বাজারের যেসব আলোচনা শুনেছেন সেই বিষয়গুলোই তুলে ধরেছেন।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে বৈঠকে প্রার্থীতা নিয়ে ঐক্যমত পোষণ করতে পারেননি উপজেলা আওয়ালী লীগ নেতারা। ফলে কেন্দ্রে মনোনয়নের জন্য তিন জনের নাম প্রেরণ করা হয় জেলা কমিটির মাধ্যমে। এরা হলেন বুড়িচং উপজেলা আওয়ামী লীগের আহবায়ক এডভোকেট আবুল হাসেম খান, যুগ্ম আহবায়ক আখলাক হায়দার ও এডভোকেট রেজাউল করিম। তারপর থেকেই শুরু হয় নেতাদের ঢাকায় তদবির। স্থানীয় এমপি, জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সহ বিভিন্ন ভাবে তদবির চলতে থাকে। বুড়িচং উপজেলার দুইশতাধিক নেতাকর্মী ঢাকায় অবস্থান করে। কে পাচ্ছেন মনোনয়ন? এ যেন এক যুদ্ধ। দলের টিকেট পেতে মরিয়া সবাই। বিশেষ করে এডভোকেট আবুল হাসেম খান ও আখলাক হায়দার নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকেন। মাঠ পর্যায়ে একেক সময় একেক খবর। নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়ে উত্তেজনাও ছড়িয়ে পরে।

শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পান এডভোকেট আবুল হাসেম খান। মনোনয়নের পর আখলাক হায়দার দ্বিধাদ্বন্ধে ছিলেন নির্বাচন করবেন কি করবেন না? কারণ আখলাক হায়দারে পিতা বুড়িচং উপজেলা আওয়ালী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবুল বাশার চেয়ারম্যানের সঙ্গে ছিলো এড. আবুল হাসেম খানের ভালো সম্পর্ক। হাসেম খান রাজনীতি করতেন বাশার চেয়ারম্যানের সঙ্গে, ভাই ডাকতেন। সেই হিসেবে আখলাক হায়দারও হাসেম খানকে চাচা সম্বোধন করতেন। সম্পর্ক ছিলো দীর্ঘদিনের। কখনো চাচার বাইরে জাননি আখলাক হায়দার। হাসেম খানও নিজের সন্তানের মতো দেখতেন আখলাক হায়দারকে। হাসেম খান ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। তিনি সব সময়ই দলের পক্ষে কাজ করেছেন। যতটুকু জানতে পেরেছি ১৯৮৬ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে সকল নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে তিনি ছিলেন। তিনি কখনো নৌকা বিরোধী ছিলেন না। শত অপমান সত্ত্বেও তিনি দলের দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকেই কোটিপতি বনে যান। স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল মতিন খসরু মন্ত্রী হন। সে সুবাধে অনেকেই টাকার মালিক হয়ে উঠেন। আবদুল মতিন খসরুর সরলতার সুযোগে আসনটি কয়েকজন নেতার কাছেই জিম্মি হয়ে পড়ে। সময় চলে যায়। সরকারি তেমন কোন সুবিধাই ভোগ করতে পারেননি এডভোকেট আবুল হাসেম খান। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়ার অনেক নেতাই বিভিন্ন কারণে কিংবা অভিমানে নিরব হয়ে যায়। কেউ কেউ তালা আবার ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষেও কাজ করেন। কিন্তু কোন কিছু না পেয়েও দলের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন আবুল হাসেম খান। দীর্ঘদিন গ্রুপিং হয়ে যায় হাসেম খান বনাম সাজ্জাদের সঙ্গে। নানা অপমান তারপরও হাসেম খান ছিলেন দলের প্রতি অনুগত। তিনি বেঈমানি করেননি। নৌকা কিংবা দলের সঙ্গে। দল বিভক্ত হয় হাসেম খানের পক্ষে দলের অধিকাংশ নেতারাই ছিলেন। ছিলেন আখলাক হায়দারও।

২০০৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে হাসেম খান সমর্থকরা সেলিম রেজা সৌরভের পক্ষে কাজ করেন। সে নির্বাচনে অনেকটা নিরব ছিলেন হাসেম খান। তবে আখলাক হায়দার তার নিজ এলাকার প্রার্থী মিজানুর রহমান থাকা সত্ত্বেও সাজ্জাত হোসেনের পক্ষে কাজ করেন। তার নিজ কেন্দ্রে বিজয়ী হন সাজ্জাদ হোসেন। হাসেম খানের কেন্দ্রেও বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন সাজ্জাদ হোসেন। বিজয়ী হয়ে সাজ্জাদ হোসেন স্বপন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিরোধীতা করেন আখলাক হায়দারের আপন ছোট ভাই লালন হায়দারের। সেই থেকেই মূলত দুই নেতার বিরোধের সূত্রপাত।

২০১৪ সালের নির্বাচনে উপজেলা আওয়ামী লীগ আবদুল মতিন খসরুর উপস্থিতিতে দলের একক প্রার্থী ঘোষণা করতে পারেননি। সে নির্বাচনটি কেন্দ্রীয়ভাবে মনোনয়ন দেওয়ার সুযোগ ছিল না। ফলে সাজ্জাদ হোসেন ও আখলাক হায়দার উভয়েই নির্বাচনে অংশ নেন। নির্বাচনে আখলাক হায়দারের পক্ষেই ছিলেন এডভোকেট আবুল হাসেম খান। সে নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মিজানুর রহমান চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

তারপর জেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হন সাজ্জাদ হোসেন। স্থানীয় সরকার এবং নির্দলীয় নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সমর্থন দেওয়া হয় রিয়াল এডমিরাল আবু তাহের কে। সে নির্বাচনেও একমত হতে পারেননি বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতারা। তবে শেখ হাসিনার নির্দেশনার কারণেই আবু তাহেরের পক্ষে কাজ করেন এডভোকেট আবুল হাসেম খান। তারপর থেকে সাজ্জাদ হোসেন স্বপন নিজেকে এমপি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হন। আর সজ্জন, সহজ-সরল, পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত হাসেম খানকে উপজেলা চেয়ারম্যান করাবেন বলে ঘোষণা দেন সাজ্জাদ হোসেন।

সরলতার সুযোগে উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি পুনর্গঠনের নামে কমিটির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। সাজ্জাদ হোসেন স্বপনের সখ্যতা গড়ে উঠে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মজিবুল হকের সঙ্গে। মজিবুল হকের কল্যাণে জেলা আওয়ামী লীগের প্রথম যুগ্ম সম্পাদকও হয়ে যান সাজ্জাদ হোসেন। উল্লেখ্য জেলা পরিষদ নির্বাচনে চৌদ্দগ্রাম উপজেলার সকল ভোট পান সাজ্জাদ হোসেন। একটি ভোটও পাননি শেখ হাসিনা সমর্থিত প্রার্থী আবু তাহের। এবার মনোনয়ন কে ঘিরে সাজ্জাদ হোসেন স্বপন, হাসেম খান ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর খান চৌধুরীকে বিভিন্ন মন্ত্রীর বাসায় নিয়ে যান। অনেকটাই মনে হয় সাজ্জাদ হোসেন স্বপনই নেতাদের দিয়ে তাদের মনোনয়ন আনেন এবং এই বিষয়ে স্থানীয় পর্যায়ে আবদুল মতিন খসরুও সমালোচনায় পড়েন। এরই প্রেক্ষিতে নির্বাচনে নৌকার ভরাডুবি ও আনারসের বিজয়ের পর সাধারণ মানুষ যেসব মত প্রকাশ করছেন তার সংক্ষিপ্ত কথাগুলোই পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো:

১. স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল মতিন খসরু বুড়িচংয়ে আখলাক হায়দার কে সমর্থন দিয়েছেন আর ব্রাহ্মণপাড়ায় জাহাঙ্গীর খান চৌধুরীকে। যদিও এ ব্যাপারে কেউ আবদুল মতিন খসরুকে সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করতে পারেনি তিনি কার পক্ষে। তবে প্রতিবেদক লক্ষ্য করেছে এমপি মহোদয়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, পিএ, ঢাকাস্থ এমপি মহোদয়ের সঙ্গে থাকা নেতারা এই দুই প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। এসকল নেতা ও ব্যক্তিরা প্রশাসনকে ব্যবহারের চেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে।
২. অনেকেই মনে করেন সাজ্জাদ হোসেন স্বপনের ভুল কৌশলই হাসেম খানকে পরাজিত করতে ভূমিকা রেখেছে। কারণ নির্বাচনী জনসভাগুলোতে সাজ্জাদ হোসেনের বক্তব্যগুলো অনেক ভোট কমিয়েছে।
৩. আওয়ামী লীগের দলীয় একটি সভায় সাজ্জাদ হোসেন বক্তব্যে বলেন যারা নৌকার বিরুদ্ধে ভোট দিবে তাদেরকে আগরতলায় চলে যেতে হবে। এতে করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ইঙ্গিত করা হয়েছে বলে মনে করেন।
৪. গত ৩০ ডিসেম্বরের ভোটের সময় সাধারণ জনগণ ভোট দিতে না পারার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আনারস মার্কায় ভোট দিয়ে।
৫. আখলাক হায়দারের এলাকা অর্থাৎ নদীর ওপার হিসেবে পরিচিত ভারেল্লা উত্তর, ভারেল্লা দক্ষিণ, মোকাম, ময়নামতি ইউনিয়নের বিএনপি এবং জামায়াত সমর্থকরা ক্ষুদ্ধ ছিলো তাদের নিজ অঞ্চল থেকে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান নির্বাচিত হয়েও উপজেলা পরিষদে বসতে পারেননি রাজনৈতিক কারণে। এই বিষয়টিও নির্বাচনে ওই অঞ্চলে ভোটারদের মাঝে কাজ করে। আর লক্ষ্যনীয় হয়ে ওঠে ভোটারদের উপস্থিতি দেখে।
৬. কারো কারো ধারণা প্রশাসন কোথাও সুষ্ঠু নির্বাচন করেছে আবার কোথাও দখলের সুযোগ দিয়েছে। ভোটার উপস্থিতি কেন্দ্র ভিত্তিক প্রাপ্ত ভোটের তালিকা বিশ্লেষন করলে সেটিই প্রমাণিত হয়।
৭. বুড়িচংয়ের সুষ্ঠু ভোট নিয়েও অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। কেন্দ্র ভিত্তিক ভোট প্রাপ্তির প্রতিবেদন প্রদান করায় বিশ্লেষন পাঠকরাই করবে তবে বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে নৌকার ভোট এতই কম ছিল যা ছিল অবিশ্বাস্য। এই কেন্দ্রগুলোতে ২ ভোট, ৯ ভোট, ১০ ভোট, ১৩ ভোট, ২৩ ভোট, ২১ ভোট, ১১ ভোট, ৩১ ভোট, ৪৮ ভোট তার বিপরীতে আনারসের ভোটের হিসেবে মিলালেই নানা প্রশ্ন ওঠে আসে। কোন কেন্দ্রে ৮১ শতাংশ, ৮২ শতাংশ ৭৯ শতাংশ, ৮০ শতাংশ আবার কোন কেন্দ্রে ১৯ শতাংশ, ২১ শতাংশ ভোট পরায় এই প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
৮. কোন কেন্দ্রে আনারস শূন্য ভোট প্রাপ্তিও প্রশ্নের সৃষ্টি করে।

নির্বাচনে কে বিজয়ী হয়েছে, কে পরাজিত হয়েছে, কার লাভ হয়েছে, কার ক্ষতি হয়েছে সেটা জনগণই বিভিন্নভাবে ব্যখ্যা করছে।
তবে প্রতিবেদক মানুষের সাথে কথা বলে যা জানতে পেরেছে তাহলো নৌকা হেরেছে। জিতেছে হাসেম খান এবং আখলাক হায়দার। তার বড় প্রমাণ নির্বাচনের পরদিন দুই প্রার্থীর অর্থাৎ চাচা-ভাতিজার কান্না জড়িত মুলাকাত।

আরো পড়ুন