কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদে পদে উপাচার্যের অনিয়ম

ডেইলিকুমিল্লানিউজ ডেস্কঃ ‘রাজনীতিমুক্ত’ ঘোষিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সবকিছুই এখন রাজনীতিকেন্দ্রিক। যোগ্য ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে তুলনামূলক কম যোগ্য ব্যক্তিদের শিক্ষক বানানো হচ্ছে রাজনৈতিক পরিচয়, স্বজনপ্রীতি ও আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে। উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ায় নিয়োগ ও প্রশাসনিক পদে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা প্রাধান্য পাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।
শুধু তা-ই নয়, উপাচার্যের বিরুদ্ধে সন্ধ্যাকালীন কোর্স থেকে টাকা নেওয়া, নিয়মবহির্ভূতভাবে ভাতা নেওয়াসহ আরও বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। ক্যাম্পাসে রাজনীতির বিস্তার এতটাই যে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসের ভেতরেই কার্যালয় খুলেছে।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং অনুসন্ধানে এমন আরও নানা অনিয়মের চিত্র পাওয়া গেছে। অবশ্য উপাচার্য অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ এসব অভিযোগ মিথ্যা বলে অভিহিত করেছেন।
কুমিল্লা শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে কোটবাড়ী শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘরসংলগ্ন এলাকায় ২০০৬ সালের ২৮ মে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্লাস শুরু হয় এক বছর পর। এখন ১৯টি বিভাগে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ হাজার ৩৯৫।

যেন ‘মিনি’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বর্তমান উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে চার বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি। কয়েকজন শিক্ষক ও প্রশাসনিক কাজে যুক্ত কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান উপাচার্য আসার পর থেকে শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে নিয়োগ কমিটির বিশেষজ্ঞ, সিন্ডিকেট ও প্রশাসনিক পদগুলোতে প্রাধান্য পাচ্ছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ফলে উপাচার্য সবকিছুই তাঁর মতো করে করতে পারছেন। কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সর্বশেষ নিয়োগ পাওয়া চার শিক্ষকের মধ্যে তিনজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি বিভাগে পাঁচজনের মধ্যে চারজন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে তিনজনের মধ্যে দুজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। আগের নিয়োগসহ ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগে মোট শিক্ষক আছেন পাঁচজন। এর মধ্যে চারজনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। অন্য বিভাগগুলোতেও কমবেশি একই চিত্র।
বর্তমান প্রক্টর কাজী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র। প্রক্টরিয়াল বডির বাকি চার সদস্যের মধ্যে তিনজনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। ছাত্র পরামর্শক মুহম্মদ আহসান উল্লাহও চট্টগ্রামের। চারটি আবাসিক হলের তিনটিতে প্রভোস্ট আছেন। এই তিনজনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। বাকি একটিতে ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট। সিন্ডিকেটে নির্ধারিত শ্রেণির বাইরে বাকি সদস্যদের সবাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এর মধ্যে অবশ্য একজনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় সেখানে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের সাবেক এক অধ্যক্ষকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগ বোর্ড গঠনেও বিশেষজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে দু-একটি বিভাগ ছাড়া সব কটিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা প্রাধান্য পেয়েছেন।
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়কে উপেক্ষা করে সবকিছুতেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, এখানে বিশ্ববিদ্যালয় দেখে নিয়োগ দেওয়া হয় না, চাকরি দেওয়া হয় মেধা দেখে। প্রশাসনিক পদে নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রক্টর, প্রভোস্টসহ কিছু প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি উপাচার্যের নিজের এখতিয়ার।

নিয়োগে অনিয়ম
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে পৌনে ২০০ শিক্ষক আছেন। বর্তমান উপাচার্যের আমলে নিয়োগ পেয়েছেন প্রায় ৬০ জন। এর মধ্যে অন্তত ২৫ জন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। চারটি বিভাগে নিয়োগে অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। ইংরেজি বিভাগে উপাচার্যের ‘পছন্দের’ প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে বিজ্ঞাপনে অন্যান্য বিভাগের চেয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা কমিয়ে দেওয়া হয় বলে শিক্ষকেরা অভিযোগ করেছেন। চলতি বছরের এপ্রিলে প্রকাশিত ওই বিজ্ঞাপন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিজ্ঞাপনটি মোট আটটি বিষয়ে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা আছে। এর মধ্যে সাতটি বিভাগেই নিয়োগের ক্ষেত্রে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি বা জিপিএ বা সিজিপিএ ৩ দশমিক ৬০ বা ৩ দশমিক ৭০ চাওয়া হয়েছে। কিন্তু ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ন্যূনতম দ্বিতীয় শ্রেণি অথবা জিপিএ বা সিজিপিএ ৩ দশমিক ৩৫ থাকলেই হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাঁর স্নাতকে জিপিএ ৩ দশমিক ৩৭। অথচ আবেদনকারীদের মধ্যে আরও যোগ্য প্রার্থী থাকলেও তাঁদের বাদ দেওয়া হয়। একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করেছেন, যাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁর বাবা বর্তমান উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ। ফার্মেসি বিভাগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া এক প্রার্থীকে বাদ দিয়ে ফলাফলের দিক দিয়ে তাঁর চেয়ে কম থাকা আরেকজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁর বাড়ি কুমিল্লায়।
পরিসংখ্যান বিভাগে অনিয়মের অভিযোগে বাছাই কমিটির ছয়জনের মধ্যে বিভাগের চেয়ারম্যানসহ দুজন আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) দেন। বাংলা বিভাগে দুজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান শিক্ষাগত যোগ্যতায় এগিয়ে থাকলেও তাঁদের নেওয়া হয়নি। আরও কয়েকটি বিভাগেও শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্য আলী আশরাফ প্রথম আলোকে বলেন, এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভুল। মেধার ভিত্তিতে এখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

‘রাজনীতিমুক্ত’ ক্যাম্পাসে রাজনীতিই বেশি
কাগজপত্রে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রাজনীতি ও ধূমপানমুক্ত। এ জন্য প্রতিবছর ভর্তির সময় শিক্ষার্থীদের ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি রাজনীতি ও ধূমপানমুক্ত ক্যাম্পাস হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে সচেষ্ট থাকব’ বলে অঙ্গীকারনামায় সই করতে হয়।
কিন্তু ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুরুর দিকে বিষয়টি মানা হলেও ২০০৯ সালের পর ছাত্রলীগ প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু করে। ২০১২ সালে ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটি হয়। এখন ছাত্রদলও কমিটি গঠন করেছে, তবে ক্যাম্পাসে যেতে পারে না। এখন মূলত ছাত্রলীগই পুরো ক্যাম্পাসে একক আধিপত্য বিস্তার করেছে। গত বছরের ৩১ জুলাই দিবাগত রাতে ছাত্রলীগের দুই উপদলের সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়টির কাজী নজরুল ইসলাম হল শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ সাইফুল্লাহ মারা যান। কিন্তু কোনো বিচার হয়নি। গত মে মাসে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলনে উপাচার্য অতিথি হয়েছিলেন। ওই সময় ক্যাম্পাসে যাওয়া ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতিকে নিজের চেয়ার ছেড়ে দিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ হয়েছিলেন উপাচার্য।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ক্যাম্পাসের ভেতর ছাত্রীদের জন্য নির্মাণাধীন একটি আবাসিক হলের কাছে ছাত্রলীগের কার্যালয় খোলা হয়েছে। সম্প্রতি সরেজমিনে ওই কার্যালয়ের সামনে দলীয় পতাকা উড়তে দেখা গেছে। জানতে চাইলে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ইলিয়াস মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, এখানে তাঁরা অস্থায়ীভাবে বসেন। তবে যেহেতু এখানে ছাত্রীদের হল হচ্ছে, তাই হলটি হয়ে গেলে চলে যাবেন।
শুধু ছাত্ররাজনীতি নয়, ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষকদের দলাদলিও প্রকট। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেছেন, বর্তমান উপাচার্য নিজেই বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ক্যাম্পাসকে অনিরাপদ করে তুলছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েকটি বিভাগে বিভিন্ন মেয়াদে সেশনজট লেগেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন ছাত্র বলেন, রাজনীতির কারণেই আজ এমনটি হচ্ছে।

আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ
সরকারঘোষিত জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী, প্রেষণ ভাতা নেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু উপাচার্য আলী আশরাফ তা নিচ্ছেন। আগে ডেপুটেশন ভাতা নামে নিলেও এখন নাম পরিবর্তন করে ‘ভিসি অ্যালাউন্স’ হিসেবে প্রতি মাসে ১৫ হাজার ২৯৮ টাকা করে নেন। কোনো অনুষদের ডিন না থাকলে উপাচার্য সেই দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু এ জন্য তাঁর ভাতা নেওয়ার কথা নয়। কিন্তু উপাচার্য ‘চার্জ অ্যালাউন্স’ নামে তা-ও নিচ্ছেন। গত এপ্রিল থেকে কোষাধ্যক্ষের পদ শূন্য থাকায় এই পদে উপাচার্যই দায়িত্ব পালন করছেন। নিয়মিত ক্লাস না নিলেও তিনি সন্ধ্যাকালীন কোর্স নেন। আবার ওই সব কোর্স থেকে আলাদা টাকাও নেন। এর আগে কুমিল্লার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সিসিএনে ক্লাস নিতেন।
তবে উপাচার্য বলেছেন, এখন আর সিসিএনে ক্লাস নেন না। আর সন্ধ্যাকালীন কোর্সে ক্লাস নেওয়াকে দোষ হিসেবে দেখছেন না তিনি।
বর্তমান উপাচার্যবিরোধী হিসেবে পরিচিত বিজ্ঞান অনুষদের ডিন মো. আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে। এসবের জন্য মূলত উপাচার্যই দায়ী। তিনি উপাচার্যের পদকে অমর্যাদাকর করেছেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের কাছে কোনো অভিযোগ এলে তাঁরা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। তবে এর আগে একবার সমস্যা হলে তিনি নিজেই সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতায় বিশ্ববিদ্যালয়টির অন্যতম একটি সমস্যা হলো, এখানে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক একেবারেই কম।

সূত্রঃ প্রথম আলো

আরো পড়ুন