কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা!

আমাদের সময়ঃ গত ১৬ অক্টোবর (সোমবার) থেকে ২ সপ্তাহ ধরে চলছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির উপাচার্য বিরোধী আন্দোলন। নিজেদের ঘোষিত ১৪ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে উপাচার্য কার্যালয় তালাবদ্ধ করে আন্দোলন চালিয়ে আসছে শিক্ষক সমিতি। এ অবস্থায় উপাচার্য তার কার্যালয়ে প্রবেশ করতে পারছেন না। ফলে প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক কার্যক্রম নিজের বাস ভবনে করছেন। এছাড়াও সামনে ১৭ এবং ১৮ নভেম্বর পূর্ব নির্ধারিত ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক প্রথম বর্ষ ভর্তি পরীক্ষাও যথাসময়ে হবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তাদের মাঝে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

চলমান আন্দোলন ভর্তি পরীক্ষা প্রভাব ফেলবে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. মো: আবু তাহের বলেন, ‘আমরা কোনোভাবেই শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করতে চাই না। আমাদের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকবে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পক্ষে। তবে ‘দুর্নীতিবাজ’ এই উপাচার্যকে আর ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।’

ভর্তি পরীক্ষা প্রসঙ্গে উপাচার্য ড. মো: আলী আশরাফ বলেন, ‘শিক্ষক সমিতি অযৌক্তিক কিছু দাবি নিয়ে আমার শেষ সময়ে আমাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। এই অবস্থায় ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে যে অনিশ্চয়তার তৈরি হচ্ছে তার পুরোপুরি দায়ভার শিক্ষক সমিতিকেই নিতে হবে। কারণ ভর্তি পরীক্ষার আগে অনেক বিষয় নিয়ে বিভিন্ন স্কুল কলেজ, পুলিশ প্রশাসন, জেলা প্রশাসক, ভর্তি কমিটিতে যারা আছেন তাদের সাথে একাধিক সভা-মতবিনিময়ের প্রয়োজন হয়। চলমান এই পরিস্থিতিতে তার কতটুকু সম্ভব হবে তা নিয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি দপ্তরে যেতে পারছি না। ভর্তি পরীক্ষার সভা কি আমি বাসভবনে করবো? দপ্তরে যেতে পারলেই তো সভা করতে পারতাম। অনিশ্চয়তার মুখে পড়তো না ভর্তি পরীক্ষা। তবে দেখা যাক। সময়ই বলে দিবে সঠিক সময়ে ভর্তি পরীক্ষা হবে কি না।’

ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলী আশরাফের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ বাণিজ্য ও নিপীড়নমূলক কার্যক্রমের অভিযোগ তুলে গত ১৬ অক্টোবর থেকে উপাচার্যকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে না দিয়ে, তার কার্যালয় তালাবদ্ধ করে আন্দোলন করছেন শিক্ষক সমিতি। এর পর থেকে উপাচার্য তার দপ্তরে আসছেন না।

শিক্ষক সমিতির দাবির মধ্যে উপাচার্যকে দেওয়া বাড়তি ভাতা বিশ্ববিদ্যালয় কোষাগারে ফেরত, প্রক্টরের পদত্যাগ, অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধ করা, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে দুর্নীতি, ছাত্র হত্যার বিচার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সমিতির সভাপতি ড. মোঃ আবু তাহের বলেন, ‘আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো। উপাচার্য তার বাসভবনে রুটিন কার্যক্রমের বাইরে নতুন করে কোনো নিয়োগ কার্যক্রম চালালে বা রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে এ ধরনের কোনো প্রজ্ঞাপন উপাচার্যের নিকট গেলে আমরা রেজিস্ট্রার দপ্তরেও তালা দিতে বাধ্য হবো।’

জানা যায়, গত ১৫ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি নির্বাচন-২০১৭ কে কেন্দ্র করেই মূলত দু’পক্ষের (উপাচার্যপন্থী ও উপাচার্যবিরোধী) দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু পরিষদ ঘোষিত ‘নীল দল’ পূর্ণ প্যানেলে জয় লাভ করে। এরপর নির্বাচনে পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ উপাচার্যের অনেকটা প্রকাশ্য মদদেই ১৭ জানুয়ারি ২০১৭ নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটায় নতুন করে পৃথক ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’ নামের আরেকটি  সংগঠন করে। ঐ সময় নতুন বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ড. দুলাল চন্দ্র নন্দী দাবি করেন, ‘যে আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠিত হয়েছিল বর্তমান বঙ্গবন্ধু পরিষদ এখন আর সে জায়গায় নেই বলে আমরা নিজেরা নতুন করে ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’ গঠন করতে বাধ্য হয়েছি।’

এসব ঘটনায় শিক্ষকদের মাঝে স্পষ্টত বিভাজন তৈরি হয়। সময়ের পরিবর্তনে গত এক বছরে বিভিন্ন বিষয়ে মনোমালিন্য ও মতভেদের সৃষ্টি হয় দু’পক্ষে। শিক্ষক সমিতির বিভিন্ন দাবি-দফা উপাচার্য বারবার প্রত্যাখ্যান করেছেন। শিক্ষক সমিতি বিভিন্ন ঘটনার বিচার না পেয়ে উপাচার্যকে কয়েক দফা ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছেন। একাধিকবার তালাবদ্ধ হয়েছে উপাচার্য কার্যালয়, প্রশাসনিক ভবন। শিক্ষক সমিতি-উপাচার্যপন্থীদের বিরোধে বেশ কয়েকদিন ক্লাস-পরীক্ষাও বন্ধ ছিল। এতে করে শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এসব বিষয়ে গণমাধ্যমে দিনের পর দিন বিভিন্ন প্রতিবেদন এসেছে।

গত দু’সপ্তাহ ধরে শিক্ষক সমিতির উপাচার্য বিরোধী আন্দোলন চলমান থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম তথা ক্লাস-পরীক্ষায় তা কোনও প্রভাব ফেলছে না। শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা চলমান রেখেই উপাচার্য বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে নেওয়া হবে বলে জানান শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান।

প্রফেসর ড. মো: আলী আশরাফ ২০১৩ সালের ৩ ডিসেম্বর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ম উপাচার্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। আসছে ডিসেম্বরের শুরুতে তার মেয়াদ (০৪ বছর) শেষ হতে যাচ্ছে। মেয়াদের প্রথমদিকে সবকিছু অনেকটা স্বাভাবিক থাকলেও শেষের দিকে এসে একাধিক বিষয়ে বিতর্কিত হয়ে উঠছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো: আলী আশরাফ। উল্লেখিত অভিযোগগুলো ছাড়াও সাংবাদিক লাঞ্ছনা, বন্ধুর মেয়েকে নিয়োগ দিতে পরোক্ষ মদদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোগত উন্নয়নে অপারগতাসহ বেশকিছু অভিযোগ স্পষ্ট হয়ে উঠছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে। এতে করে তোপের মুখে আছেন উপাচার্য।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য জানান, ‘আজকে যারা আমার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে তাদের কাছে আমি প্রথম তিন বছর খুব ভাল ছিলাম। কিন্তু যখনই আমি তাদেরকে অন্যায়ভাবে কোনো সুবিধা দেওয়া থেকে বঞ্চিত করলাম তখনই তারা আমার বিরুদ্ধাচারণ শুরু করেছে। এসব করে তারা হয়তো আমার পরবর্তী উপাচার্যের কাছে সুপাত্র হতে চায়। এই ধারা বন্ধ হওয়া উচিত।’

বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে জ্ঞানের চর্চা হবে সবার আগে। সেখানে এখন রাজনীতি মুখ্য হয়ে উঠেছে। এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষার্থীরা আদৌ জ্ঞান অর্জনে উৎসাহ পাবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পড়াশোনা-গবেষণার চাইতে রাজনীতি বেশি হয়। তুচ্ছ ঘটনায় যেভাবে হুটহাট তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে বিভিন্ন অফিস তা অত্যন্ত দুঃখজনক। শিক্ষকদের যদি প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোনও ধরনের ক্ষোভ থাকে তবে তা জানানোর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় রয়েছে। তারা সেখানে তাদের দাবি উত্থাপন করতে পারেন। তা না করে কার্যালয় তালাবদ্ধ, উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে রাখা লজ্জাজনক।’

চলমান পরিস্থিতিতে ইউজিসি’র করণীয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উপাচার্যদের শেষ সময়ে এসে এমন পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে, তবে তা কোনভাবেই কাম্য নয়। ইউজিসি বিষয়গুলো নিয়ে ভাবছে। অচিরেই এসবের সমাধান হবে।’

আরো পড়ুন