কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ অস্থিতিশীলতার নেপথ্যে দুই চিকিৎসক!

ডেস্ক রিপোর্টঃ কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের (কুমেক) বিবদমান ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের নেপথ্যে কুমেক হাসপাতালে কর্মরত দুই চিকিৎসক রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আগে থেকে চলে আসা বিবদমান দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটছেন দুই অস্থানীয় চিকিৎসক। কুমেকের সাবেক শিক্ষার্থী ও স্বাচিপের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হান্নান ও পলাশ ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের নেতৃত্ব দিলেও দ্বন্দ্ব সংঘাতে মদত দিচ্ছেন মেডিকেলে কর্মরত দু’জন চিকিৎসক। ফলে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে একাধিকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল দেশের শীর্ষ এই সরকারি মেডিকেল কলেজে।

গত ২ দিন যোগাযোগ করে কুমেকের একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কাউন্সিল হয়। এর এক সপ্তাহ পর অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সনালকে স্বাচিপের সভাপতি ও অধ্যাপক ডা. এএম আজিজকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্রীয় কমিটি দেয় আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১৬ সালে স্বাচিপের ১৫১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হওয়ার পর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীদের মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। সেই দ্বন্দ্বেরই প্রভাব পড়েছে স্বাচিপের কুমিল্লা শাখা ও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ছাত্র রাজনীতিতে। রূপ নিয়েছে দুটি গ্রুপে। ছাত্র রাজনীতির ওই দুটি গ্রুপকে নেতৃত্বে দিয়ে আসছেন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের সাবেক ছাত্র স্বাচিপ কেন্দ্রীয় কমিটি ও কুমিল্লা শাখার কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ডা. আব্দুল হান্নান এবং ডা. হাবিবুর রহমান পলাশ। তারা দু’জনই ঢাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার হিসেবে নিয়োজিত। আব্দুল হান্নান অ্যানেসথেশিয়া বিভাগ এবং পলাশ ইএনটি বিভাগের চিকিৎসক।

সূত্র আরো জানা যায়, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে দলীয় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় মেডিসিন ক্লাবের আড়ালে ছাত্রলীগের রাজনীতি করে আসছিলেন হান্নান ও পলাশ। ২০০৮ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর হাবিবুর রহমান পলাশ কুমেকের মেডিসিন ক্লাবের সভাপতি হন। এর আগেই আব্দুল হান্নান কুমেক থেকে পড়ালেখা শেষ করে বের হন। তবে তাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব বা কোন্দল ছিল না। নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও কোন্দলের শুরু হয় ২০১৫ সালে স্বাচিপের কেন্দ্রীয় কমিটি এবং ২০১৬ সালে স্বাচিপের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর।

এরপর নেতৃত্বের আধিপত্য নিয়ে হান্নান এবং পলাশ পৃথকভাবে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করেন। যে কমিটিগুলোর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ এবং জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের স্বীকৃতি নেই।

কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আ ফ ম আহসান উদ্দিন টুটুল বলেন, কুমেক ছাত্রলীগের কোনো কমিটি বা স্বীকৃতি নেই। আমি জেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে থাকার সময় কুমেক ছাত্রলীগের খোঁজখবর নিয়েছি। তবে এখন কে বা কারা দেখাশোনা করছে সঠিকভাবে বলতে পারব না।

গত বছরের ১ নভেম্বর রাত ১টায় কথিত ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ৫ জন আহত হয় এবং ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ৩ জনকে আটক করে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাসে কলেজ কর্তৃপক্ষ মুচলেকা দিয়ে তাদের কলেজে নিয়ে আসে। ওই ঘটনায় ২ নভেম্বর কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মহসিন উজ জামান চৌধুরীর সভাপতিত্বে একাডেমিক কাউন্সিল সভায় ৮ ছাত্রকে বিভিন্ন মেয়াদে কলেজ ও হোস্টেল থেকে বহিষ্কার করে। ৫ জন ইন্টার্ন চিকিৎসককে সতর্ক করা হয়। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের সংগঠন মেডিসিন ক্লাবসহ সব ধরনের ছাত্র রাজনীতি ও সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ওই একাডেমিক কাউন্সিল সভায়।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে কুমেকের এক শিক্ষক জানান, কুমেকে সব সংগঠন ও রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও হান্নান এবং পলাশের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের দ্বন্দ্ব অব্যাহত রেখেছেন। এ ছাড়া ও হাসপাতালে কর্তব্যরত আবাসিক চিকিৎসক ডা. আব্দুল আউয়াল সোহেল এবং অ্যানেসথেশিয়ার চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ আলী টিপুর নেতৃত্বে আরো একটি গ্রুপ তৈরি হয়েছে বলে সূত্রটি জানিয়েছে। তাদের মদতের কারণেই হান্নান ও পলাশ গ্রুপের মধ্যে বার বার সংঘাতের সৃষ্টি হয় বলে তিনি জানান। মদত দেয়া সোহেল এবং টিপুর মূল লক্ষ্য গ্রুপ সৃষ্টি করে কুমেকে অবস্থান তৈরি করে নেতৃত্বে আসা।

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক, স্বাচিপের কুমিল্লা জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিএমএ কুমিল্লা জেলার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আউয়াল সোহেল জানান, আমি হাসপাতালে সরকারি চাকরি করি। আমি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। বরং আমি ছাত্রদের সংঘর্ষের খবর পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে ছুটে গিয়েছি। সব শিক্ষার্থীদের আমি ও কলেজের উপাধ্যক্ষ ডিপার্টমেন্টের হেডসহ অন্য শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করেছি। দু’জনের অবস্থা খারাপ দেখে আমরা তাদের একজনকে ঢাকা মেডিকেলে, অন্যজনকে মুন হাসপাতালে মেডিকেল বোর্ড করে চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করেছি। পরবর্তী সময়ে তাকে স্কয়ার ও পরে এ্যাপোলো হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু যারা গ্রুপিং করে তারা সেখানে আসেনি। আমি গ্রুপিং করলে হয়তো আমিও আসতাম না।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে অ্যানেসথেশিয়ার চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ আলী টিপুর ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি।

মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর হোসেন ভূইয়া জানান, গত কয়েক বছর ধরে নতুন শিক্ষার্থীদের বরণ করাকে কেন্দ্র করে আধিপত্য বিস্তারের ব্যাপারটি চলে আসছে। এরই ধারাবাহিকাতয় ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নিয়ে রাতে দু’পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটে। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের ছাত্ররা স্বাচিপের কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সনাল ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজের নেতৃত্বে রাজনীতি করছে বলে দাবি করেছেন তিনি। এ ব্যাপারে পলাশ গ্রুপের প্রধান হাবিবুর রহমান পলাশ জানান, আমি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সস্পৃক্ত নেই। আমি পেশাজীবী রাজনীতি করি। আমার নামে কেউ রাজনীতি করলে সেটা মিথ্যা, কেননা আমি আদর্শের রাজনীতি করি। কাউকে কখনো মেরে বা কলেজ থেকে বের করে দিয়ে রাজনীতি করার স্বপ্ন আগে দেখিন, এখনো কাউকে এ রকম পরামর্শ দেই না।

হান্নান গ্রুপের প্রধান আবদুল হান্নানের সঙ্গে মুঠোফোনে বহুবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

এ ঘটনায় কুমেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মহসিন উজ জামান চৌধুরী বলেন, কলেজ ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ। কোনো ছাত্র সংগঠন বা অন্য কোনো নামে এখানে রাজনীতি করা যাবে না, যা আগেই বলে দেয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটায় কুমেক শেখ রাসেল ছাত্রাবাসে ২৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের বরণ ও ছাত্রলীগের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ঘিরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে কুমেকের ২৩তম ব্যাচের ৫ম বর্ষের দুই শিক্ষার্থী তৌফিক আহমেদ ও ইরফানুল হকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ইরফানুল হক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। একই ব্যাচের ছাত্র তৌফিক ঢাকা এ্যাপোলো হাসপাতালে আইসিইউতে রয়েছে।

এর আগে গত বছরের ১ নভেম্বর রাত ১টায় কথিত ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে ৫ জন আহত হয় এবং ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ৩ জনকে আটক করে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাসে কলেজ কর্তৃপক্ষ মুচলেকা দিয়ে তাদের কলেজে নিয়ে আসে।

সূত্রঃ মানবকণ্ঠ

আরো পড়ুন