দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বাতিঘর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ

কাজী ফাহমিদা কানন
কলেজের তেমাথার রাস্তা আজ অপরিচিত
নতুনের আগমনে পুরনো কথা গুলো নগন্য।
খোঁজার খুব চেষ্টা করি পুরনো সব স্মৃতি কিন্তু সবই অযথা।

এইতো সেদিন মাত্র গুটি গুটি পায়ে হেঁটে গিয়েছিলাম রানীর দিঘীর পাড় দিয়ে। সাদা ক্যাডস পায়ে, সাদা স্কার্ফ গলায় আর বহু আকাঙ্ক্ষিত কলেজের ইউনিফর্ম গায়ে জড়িয়ে। পকেটের গায়ে লোগো লাগানো ছিলো যার জন্য অশ্রু বিসর্জন দেয় বহু শিক্ষার্থী। সেই আবেগের নাম কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ। সময় ছুটে চলেছিল সাথে তাল মিলিয়ে আমরা। ১৭-১৮ বছরের দুরন্তপনা যেন কলেজ প্রাঙ্গণকে সর্বদা জাগিয়ে রাখতো।

কলেজের সবচেয়ে প্রিয় জায়গাটি ছিল কাঁঠালতলা। যা শিক্ষার্থীদের কাছে ভিক্টোরিয়া পার্ক নামে খ্যাত। ক্লাসের ফাঁকে হোক, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে হোক কিংবা ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরার আগে কাঁঠালতলায় যাওয়ার তাড়া অনুভূত হতো সকল শিক্ষার্থীর মাঝেই।

ইট-সিমেন্টের মিশ্রণে তৈরি বসার জায়গা গুলোতে সিগারেটের ছাঁই, সিঙ্গারার বাদাম, বন্ধুদের কারও জন্মদিন উপলক্ষে কেকের ক্রিম যাই লেগে থাকুক না কেন, ঝেড়ে-মুছে দল বল নিয়ে বসে পড়তাম। ঝলসে যাওয়া রোদকেও তখন কাঁঠাল পাতার ফাঁক গলে আসতে হতো বলে কাঁঠালি রোদ মনে হতো। আড্ডারত ছেলেদের সিগারেটের কড়া গন্ধ কিছুই তখন আমাদের স্পর্শ করতে পারতো না।

কুমিল্লা কান্দিরপাড়ের কেন্দ্রভূমিতে অবস্থিত ভিক্টোরিয়া কলেজটি দ্যুতি ছড়াচ্ছে ব্রিটিশ আমল থেকে। এ কলেজ থেকে পড়াশোনা করেছেন কত নামী রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, লেখক ও সাংবাদিক। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনসহ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখে এ কলেজের শিক্ষার্থীরা।

১৯২১-১৯২৩ সাল পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলাম অবস্থান করেছিলেন কুমিল্লায়। তাঁর আড্ডা দেওয়া ও কবিতা লেখার স্থানটি ছিল ভিক্টোরিয়া কলেজের সামনেই রানীর দিঘীর পশ্চিম পাড়ে। কলেজ ছাত্রদের সাথে তাঁর ছিল দারুণ সখ্যতা। আড্ডা দেওয়া, গান গাওয়া ছিল তখন প্রতিদিনকার ব্যাপার। ১৯২৬ সালে ফেব্রুয়ারিতে কলেজ প্রাঙ্গণে এসে শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

উপমহাদেশের কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পী শচীন দেববর্মন, ভাষা আন্দোলনের সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, জাতীয় পতাকার রূপকার শিবনারায়ণ দাস এ কলেজের ছাত্র ছিলেন। বিখ্যাত ব্যক্তিদের আগমণ এবং এ কলেজের ছাত্র যারা পরবর্তী সময়ে শ্রেষ্ঠত্বের তালিকায় নিজেদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখেছে তাঁদের পদচারণা যেন এক বিশেষত্ব ও গৌরব দান করেছে ভিক্টোরিয়া কলেজকে।

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ এক শতকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সভ্যতার ধারক ও বাহক। যা দক্ষিণ পূর্ব বাংলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ নামে খ্যাত। এ সুখ্যাতির পেছনে রয়েছে কলেজটির সুদীর্ঘ সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

তৎকালীন জমিদার রায় বাহাদুর আনন্দচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে ১৮৮৬ সালে ‘রায় এন্ট্রাস স্কুল’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮৮ সালে মহারানী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের ৫০ বছরের সুবর্ণ জয়ন্তী স্মারক চিহ্ন স্বরুপ এর নাম পরিবর্তন করে ভিক্টোরিয়া স্কুল নামকরণ করা হয়।

বর্তমানে স্কুলটির নাম ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল।স্কুলটির সাফল্যে ও পূর্ব ভারতে ক্রমবর্ধমান উচ্চ শিক্ষার চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ১৮৯৯ সালে জমিদার রায় বাহাদুর আনন্দচন্দ্র রায় রানী ভিক্টোরিয়ার নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন।

কলেজ প্রতিষ্ঠার পর ব্রিটিশ সরকার এর জন্য তাকে রায় বাহাদুর উপাধি প্রদান করে। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে ভিক্টোরিয়া কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শাখার প্রধান ফটকে একটি সাদা রঙের ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে।

ঐতিহ্য মন্ডিত এ কলেজটির শিক্ষার্থীদের অবস্থান সর্ব মহলে বিদ্যমান। সৃষ্টি লগ্ন থেকেই শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে দক্ষিণ পূর্ব বাংলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ। ২০১৭ সালে জাতীয় পর্যায়ে কলেজ পারফরম্যান্স র‍্যাংকিং অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ। চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম সেরা ৫ কলেজ ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান অধিকার করে ভিক্টোরিয়া কলেজ।

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী জাহানারা ইসলাম বলেন, ছোট বেলা থেকেই দেশসেরা কিছু বিদ্যাপীঠে পড়ার স্বপ্নকে লালন করে আমার বেড়ে উঠা। এগুলির মধ্যে উচ্চমাধ্যমিকের জন্য আমার সেই স্বপ্নের বিদ্যাপীঠ ছিল কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজ।

এ কলেজ আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে দৃঢ়প্রত্যয়ী হতে হয়। কীভাবে নিজের দেখা স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করা যায়। এ মহান বিদ্যাপীঠের আমার শ্রদ্ধ্যেয় শিক্ষকদের কাছে আমি চিরঋণী।

১২১ বছরের পুরনো এ কলেজটির আছে বহু ইতিহাস। যা লিখতে গেলে কয়েকশ পাতা শেষ হয়ে যাবে। তিতাশ চৌধুরী লিখেছেন, প্রাচীনত্বের বিচারে এই কলেজটি বুড়োদের দলেই পড়ে। মূলত এই কলেজটিই ছিল এই অঞ্চলের অন্ধকার যুগের শিক্ষা-সংস্কৃতি ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। তবে পাকিস্তান সৃষ্টির পর এ কলেজের নাম পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়। ‘ভিক্টোরিয়া’ শব্দটি ছেঁটে ফেলে দেয়ার চিন্তা করা হয়। শেষ পর্যন্ত তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

সারা বিশ্বেই এ কলেজের শিক্ষার্থীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এ অঞ্চলের বাতিঘর ভিক্টোরিয়া কলেজ শিক্ষিত নাগরিকের পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করছে। বলা হয়ে থাকে ‘কীর্তিমানের মৃত্যু নেই’। কীর্তিমানদের অবদানে চিরঞ্জীব হয়ে থাকুক প্রিয় বিদ্যাপীঠ।

আরো পড়ুন