পরিত্যক্ত প্লাষ্টিক থেকে জ্বালানি তেল আবিষ্কার, কুমিল্লার বিজ্ঞানীর সাফল্য

ডেস্ক রিপোর্টঃ দিন দিন বাড়ছে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার, সেই সঙ্গে আমাদের চারপাশে জমছে প্লাস্টিক বর্জ্য। যা হয়ে ওঠেছে আমাদের পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। কারণ প্লাস্টিক পচনশীল নয়। গত দুই দশকে সারাবিশ্বে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় চিন্তিত পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। তারা প্লাস্টিকের আগ্রাসন থেকে ভবিষ্যতের পৃথিবীকে রক্ষা করতে চালিয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন গবেষণা, অনুসন্ধান করছেন দূষণ থেকে মুক্তির কৌশল।

আর এই মুক্তির কৌশলের চিন্তা করে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক ও পলিথিন থেকে ডিজেল, পেট্রোল ও এলপি গ্যাস উৎপাদনের কৌশল উদ্ভাবন করেছে কুমিল্লা দাউদকান্দি উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের চৌধুরীপাড়া গ্রামের বিজ্ঞানী ড. মইনউদ্দিন সরকার।

পরিবেশ দূষণের জন্য যখন বিশ্বজুড়ে যখন প্লাস্টিককে দায়ী করা হচ্ছে, এমনই একটা সময়ে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক ও পলিথিন থেকে উন্নতমানের জ্বালানি তেল উৎপাদন নতুন সম্ভাবনা আলো জ্বেলে দিয়েছে।

উদ্ভাবনে বিশ্বকে তাক লাগানো ড. মইনউদ্দিন সরকার জানান, প্লাস্টিক না পচার কারণে পরিবেশ ও মাটির ক্ষতি হয়। তার প্রজেক্টের মাধ্যমে প্লাস্টিক থেকে জ্বালানী তেল তৈরী সম্ভব। ফলে তেলের ঘাটতি কমবে ও পরিবেশ ও মাটি ক্ষতির হাত থেকে বাচবে। যত্রযত্রভাবে পলিথিন পড়ে থাকতে দেখে উদ্ভাবনের চিন্তা তার মাথায় আসে। এছাড়াও তিনি আরো বলেন ১টন পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে ৩৪০ গ্যালন জ্বালানি তেল অর্থাৎ ১৩০০ লিটার এলপি ১১৬ কেজি অর্থাৎ ১০ বোতল উৎপাদন করা যায়। যা বাজারজাত করা যাবে প্রতি লিটার ২০/৩০ টাকা। এই তেল সম্পূর্ণভাবে সালফারমুক্ত।

তার এই সাফল্যে খুশি তার বাবা মোঃ কামাল উদ্দিন সরকার, স্কুল জীবনের শিক্ষকরা। তারা জানায়, ছোট থেকেই ইমনের গবেষণার দিকে মনোযোগ ছিল। আজকে আমরা খুব আনন্দিত আমাদের ছাত্র মইনউদ্দিন বিজ্ঞানী হয়েছে। আমরা তার উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করি।

ড. মইনউদ্দিন সরকার নিউ ইয়ার্কের ব্রিজপোর্ট ও নিউজার্সিতে প্লান্ট গড়ে তুলেছেন। তার কোম্পানির নাম ‘ন্যাচারাল স্টেট রিসার্চ ইনকরপোরেশন’ (এনএসআর)। শুধু প্লাস্টিক থেকে তেল তৈরির কাজ করছে এই কোম্পানি। এই তেলের নাম এনএসআর ফুয়েল। ড. সরকার এই প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট, উদ্ভাবক ও বিজ্ঞানীদের প্রধান। তার কোম্পানির পাশাপাশি এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করে তেল উৎপাদন করছে আরও একটি কোম্পানি। তবে সরকার জানান, এনএসআর ফুয়েলের বিষেশত্ব এটি পরিবেশবান্ধব। এতে কোনো সালফার থাকবে না। অন্য যারা এই জ্বালানি তৈরি করছে তাতে সালফার রয়েছে। সালফার থাকার কারণে এগুলো যখন ব্যবহারিত হচ্ছে তখন বাতাসে সালফার-ডাই-অক্সাইড সরাচ্ছে। যা পরিবেশের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে উৎপন্ন ৯৫ শতাংশ তেল, বাকি ২ ভাগ হালকা গ্যাস, ৩ ভাগ অবশিষ্ট বর্জ্য থেকে যাবে। এই বর্জ্য যেন পরিবেশকে ক্ষতি না করে সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।

ড. মইনউদ্দিন সরকারের বাড়ি কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি। বাবা কামালউদ্দিন সরকার ছিলেন সরকারি কর্মচারী। ৬ ভাই ৩ বোনের মধ্যে বড় মইনউদ্দিন। তার ছেলেবেলা ছিল সংগ্রামমুখর। এমনকি কৃষি কাজও করেছেন তিনি। তিনি বলেন, আমি গৌরিপুর হাইস্কুলের তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। একদিন স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন স্থানীয় চেয়ারম্যান। তিনি জানতে চেয়েছিলেন যে, তোমরা কে কি হতে চাও। আমি বলেছিলাম, বড় হয়ে আমি বিজ্ঞানী হব। কথাটি আজও আমার মনে পড়ে। আব্বা-মা চেয়েছিলেন আমি যেন ডাক্তার হই। কিন্তু আমি নিজের ইচ্ছায় অটল ছিলাম। এ পর্যায়ে আসতে আমাকে অসম্ভব পরিশ্রম করতে হয়েছে।

মইনউদ্দিন সরকার ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এমএসসি পাস করে বিদেশে পাড়ি জমান। ১৯৯৬ সালে লন্ডনের ম্যানচেস্টার ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে পিএইচডি লাভ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘হাই টেম্পারেচার সুপার কনডাক্টিং অক্সাইড’। তিনি গবেষণা করেছেন যুক্তরাজ্যে (১৯৯১-১৯৯৬), তাইওয়ানে (১৯৯৬-১৯৯৯), বার্লিনে (১৯৯৯-২০০০) এবং ২০০১ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কাজ করেছেন কানাডা, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসে। তাইওয়ানে গবেষণার সময় তার গবেষণার সঙ্গী ছিলেন রসায়নে নোবেলজয়ী ড. ইউয়ান লি। ২০০৫ সালে গবেষনা শুরু করেন। ২০১০ সালে প্লাস্টিক থেকে তেল উৎপাদনের পেটেন্ট করেন। তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের দ্রুত বেড়ে ওঠা প্রযুক্তিগুলোর অন্যতম। পুনঃব্যবহার বা রিসাইক্লেলিংয়ের জন্য বর্জ্য সংগ্রহ করার ফলে যেমন কর্মসংস্থান বাড়বে তেমনি প্রয়োজনীয় জ্বালানি তৈরি করা যাবে। এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা গেলে মানুষের প্রয়োজনীয় গ্রিন টেকনোলজির চাহিদাও পূরণ হবে। দিন দিন আমাদের প্লান্ট প্রসারিত হচ্ছে। সুযোগ হলে বাংলাদেশেও এ রকমের প্লান্ট করতে চাই। তাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষা পাবে এবং ভবিষ্যত জ্বালানি নিরাপত্তা সুরক্ষিত হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীদের একজন ড. মইনউদ্দিন সরকার। নবায়নযোগ্য জ্বালানিবিষয়ক গবেষণায় অবদান রাখায় স্বীকৃতিস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের International Renewable Energy Innovator of the year ২০১০ সালে তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন। এছাড়া তিনি একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মান লাভ করেছেন। ড. মইনউদ্দিন সরকার সোসাইটি অব অটোমোবাইল ইন্টারন্যাশনাল, আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব নেভাব ইঞ্জিনিয়ারিং, আমেরিকান ক্যামিক্যাল সোসাইটি, আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি, আমেরিকান ইন্সটিটিউট অব ক্যামিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন পুর অ্যান্ড অ্যাপ্লাইড ক্যামিস্ট্রি, কানাডিয়ান সোসাইটি অব ক্যামেস্ট্রি, ক্যামিক্যাল ইন্সটিটিউট অব কানাডাসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানে যুক্ত আছেন। তার শতাধিক গবেষণাপত্র ছাপা হয়েছে আন্তর্জাতিক গবেষণা জার্নালে। বই ছাপা হয়েছে ১০টি। ইতিমধ্যে তার ৬টি নিজস্ব পেটেন্ট নিবন্ধিত হয়েছে। কীর্তিমান এই বাঙালির স্ত্রী আনজুমান আরা একজন বিজ্ঞানী। তারা ব্রিজফোর্টে বসবাস করছেন।

ড. মইন উদ্দিন সরকার একজন সফল গবেষক, তাঁর উৎপাদিত পরিত্যক্ত প্লাস্টিক থেকে ফুয়েল তৈরি সুদূর আমেরিকায় দারুণ সাড়া ফেলেছে। তাঁর গবেষণা নিয়ে বিভিন্ন দেশে আলোচনা হচ্ছে এবং এমন প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তাঁর গবেষণাটি সারা বিশ্বে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ও টিভিতে প্রদর্শিত হয়েছে। তিনি এ দেশের সন্তান। তাঁর চিন্তা বাংলাদেশকে কিছু দেওয়া। তাঁর ইচ্ছা বিশাল সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি বাংলাদেশে ব্যবহার করে পরিবেশ রক্ষা করা, বিপুল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা। তাই কাজ করার জন্য তিনি গত ১৩.০৯.২০১৮ইং তারিখে বাংলাদেশে আসে। ইতি মধ্যে ঢাকার মেয়র সহ বিভিন্ন ব্যাবসায়ীদের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং ২৮ বছরে মধ্যে দ্বিতীয় বারের মতো গত ২১.০৯.১৮ইং তারিখে তাহার নিজ গ্রামের বাড়িতে আসেন। এ আসাকে ঘিরে এবং তাকে দেখার জন্য এলাকার মানুষ ভিড় জমায়।

আরো পড়ুন