বিদেশে পাঠানোর নামে কুমিল্লায় বছরে ১০ হাজার যুবক প্রতারণার শিকার

কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জ ইউনিয়নের আলীয়াবাদ গ্রামের যুবক ফুলচাঁন মিয়া। ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে ৫ লাখ টাকা খরচ করে ছয় মাস আগে একই উপজেলার ফুলতলী গ্রামের ভিসা দালাল মহিউদ্দিনের মাধ্যমে তিনি সৌদি আরবের আল হাছা শহরে পৌঁছান। কথা ছিল গাড়ির শোরুমে তাকে চাকরি দেওয়া হবে।

কিন্তু ভ্রমণ ভিসায় তাকে সেখানে নিয়ে একটি কামরায় বন্দি করে রাখে দালাল। তার পরিবারের কাছ থেকে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করা হয়। সেখানে তাকে মারধর ও নির্যাতন করে সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রাখা হয়। দুই মাস আটকে রাখার পর তাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দেশে এসে দালাল মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে ফুলচাঁন মামলা করেন। চার মাস ধরে আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি।

একই ঘটনা ঘটেছে একই উপজেলার খয়রাবাদ গ্রামের ফরিদ মিয়ার ছেলে হুমায়ন মিয়ার ক্ষেত্রেও। আট মাস আগে ৬ লাখ টাকার বিনিময়ে তাকে সৌদি আরব নিয়ে যান বারেরা গ্রামের দালাল এনামুল হক। কোনো কাজ না দিয়ে দুই মাস পর তাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শেষ সম্বল এক বিঘা জমি বিক্রি করে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন নিয়ে ওই যুবক বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল। প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ না থাকায় দালালের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না ওই যুবক।

সৌদি আরব গিয়ে দেবিদ্বার উপজেলার গঙ্গানগর গ্রামের রিপন মিয়া একইভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এছাড়া দুবাই গিয়ে দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে দেশে ফিরেছেন একই উপজেলার ভিংলাবাড়ি গ্রামের খোকন মিয়ার ছেলে জাহের, জহির মিয়ার ছেলে জাহিদ, সিরাজ মিয়ার ছেলে রাসেল মিয়া।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিজেদের ভাগ্যের চাকা ফেরাতে গিয়ে প্রতি বছর কুমিল্লার প্রায় ১০ হাজার যুবক প্রতারণার শিকার হচ্ছে। কুমিল্লা থেকে সবচেয়ে বেশি যুবক বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। পাসপোর্ট তৈরি থেকে শুরু করে ভিসা, মেডিকেল চেকআপ, বিমানের টিকিট সর্বত্র জালিয়াতি করা হচ্ছে। কাক্সিক্ষত চাকরি না দিয়ে হাজার হাজার যুবককে খালি হাতে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সহায়-সম্পদ বিক্রি করে জাল ভিসায় বিদেশে গিয়ে তাদের মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে। এদিকে, প্রতারক চক্রের খপ্পর থেকে তাদের রক্ষায় দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়।

জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয় সূত্র জানায়, কুমিল্লা জেলা থেকে প্রতি বছর ৬০ থেকে ৭০ হাজার অভিবাসী বিভিন্ন দেশে যান। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ জেলার ৬৭ হাজার ২২৬ জন বিদেশে যাওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছে। তাদের মধ্যে ৬৫ হাজার ৬২৩ জন পুরুষ। ১ হাজার ৬০৩ জন নারী।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ-বছরে অন্তত ১০ হাজার বিদেশগামী প্রতারণা এবং নাজেহাল ও ভোগান্তির শিকার হন। এ ব্যাপারে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয় চুপ থাকে। বিশেষ করে অধিকাংশ বিদেশগামী দালালের মাধ্যমে সবকিছু করে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় দালালদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না।

সচেতন মহলের অভিমত-অভিবাসীদের হয়রানিমুক্ত সেবা প্রদান নিশ্চিত হলে এ খাত থেকে অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ে জরিপ কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, আমরা সব সময় চেষ্টা করি-বিদেশগামীদের যথাযথ সেবা এবং তাদের নিবন্ধনসহ বিভিন্ন ধরনের কাজকর্ম দ্রুত ও স্বচ্ছতার সঙ্গে নিশ্চিত করতে। এছাড়া কেউ প্রতারণার শিকার হলে আমরা তাদের আইনি পরামর্শসহ সব ধরনের সহযোগিতা করতেও প্রস্তুত আছি।

কুমিল্লা নগরীর দক্ষিণ চর্থা এলাকার ইদু মিয়ার ছেলে আরমান মিয়া জানান, চান্দিনা উপজেলার বাবুল মিয়ার হাতে ভিসা, মেডিকেল চেকআপ, বিমানের ভাড়া বাবদ ৫ লাখ টাকা তুলে দেন। বাবুল মিয়ার জামাতা ওমানে লোক নেন। আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকায় সরল বিশ্বাসে টাকা দেন।

একপর্যায়ে নির্দিষ্ট দিনে রওয়ানা করে ওমানের মাসকাট বিমানবন্দরে গেলে পুলিশ তাকে আটকে দেয়। জাল ভিসার কারণে সেখান থেকে তিনি ফেরত আসেন। এক বছর আগে ঘটে যাওয়া এই প্রতারণার ঘানি আজও টানছে তার পরিবার।

পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমরা প্রবাসীদের সেবা প্রদান করি। কেউ প্রতারণার শিকার হয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ করলে অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া প্রতারক এবং দালাল চক্রের বিরুদ্ধে পুলিশ সব সময়ই সোচ্চার।

আরো পড়ুন