নিজস্ব প্রতিবেদকঃ কুমিল্লায় কামরুন্নাহার নামের এক ভুয়া গাইনি ডাক্তারের অপচিকিৎসায় একইদিনে দুই নবাজাতকের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে জেলার চান্দিনা উপজেলার নবাবপুর বাজারে ‘নবাবপুর মেডিকেল সেন্টার’ নামে একটি ‘ক্লিনিকে’ এ ঘটনা ঘটে। তবে একটি দোকান ঘরে ওই নামে সাইন বোর্ড থাকলেও কথিত ডাক্তারের চিকিৎসাপত্রে ‘নাহার কন্সালটেশন সেন্টার’ নাম লেখা রয়েছে।
দুই নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় এলাকার বিক্ষুদ্ধ লোকজন কথিত ওই ক্লিনিকে ভাঙচুর চালায়। খবর পেয়ে চান্দিনা থানা পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দুই নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ভুয়া গাইনি ডাক্তার কামরুন্নাহারের সহযোগী ইয়াসমিনকে (৩৫) আটক করেছে। দুই নবজাতক হলো- চান্দিনা উপজেলার বিচুন্দাইর-করইয়ারপাড়া গ্রামের প্রবাসী সফিকুল ইসলামের পুত্র সন্তান এবং একই উপজেলার কংগাই গ্রামের ওমর ফারুকের পুত্র সন্তান।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার জোয়াগ ইউনিয়নের কৈলাইন গ্রামের ডিপ্লোমা চিকিৎসক খলিলুর রহমান পলাশ কামরুন্নাহার নামে এক নার্সকে বিয়ে করে প্রায় ১০ বছর পূর্বে নবাবপুর বাজারের একটি দোকান ঘর ভাড়া নিয়ে একটি ‘ক্লিনিক’ চালু করেন। ওই ক্লিনিকে তার স্ত্রীকে গাইনি ডাক্তার হিসেবে এলাকার লোকজনের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রায় চার বছর পূর্বে খলিলুর রহমানের সঙ্গে কামরুন্নাহারের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলেও ওই ক্লিনিক ব্যবসার নামে নানা অঘটন ও অপকর্ম অব্যাহত রাখেন কথিত ডাক্তার কামরুন্নাহার।
দোকান ঘরের শার্টারে ‘নবাবপুর মেডিকেল সেন্টার’ নামে সাইনবোর্ডে ডা. খলিলুর রহমানের নাম থাকলেও বিবাহবিচ্ছেদের পর তার স্ত্রী কামরুন্নাহার নিজের নামে চিকিৎসাপত্রে ‘নাহার কন্সালটেশন সেন্টার’ এবং নিজের নাম ‘ডা. আরএ কামরুন্নাহার’ লিখে চিকিৎসাপত্র ব্যবহার করে আসছিলেন। চিকিৎসাপত্রে কামরুন্নাহার নিজের নামের পাশে ‘সনোলজিস্ট, মেডিসিন, মা ও শিশু, গাইনি, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ’ বলে উল্লেখ করেন। সেখানে তিনি গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, অকাল গর্ভপাত, নরমাল ডেলিভারি, সিজার ডেলিভারিসহ বিভিন্ন চিকিৎসাসেবা চালিয়ে আসছিলেন। গত কয়েক বছরে তার অপচিকিৎসায় অনেক নবজাতক ও মায়ের মৃত্যু হলেও কেউ থানায় অভিযোগ করেননি। স্থানীয়ভাবে প্রভাব খাটিয়ে ম্যানেজ করে নেন।
এ বিষয়ে মৃত এক শিশুর বাবা ওমর ফারুক জানান, আমার স্ত্রীর প্রথম সন্তানধারণ করার পর এলাকার লোকমুখে ডাক্তার কামরুন্নাহারের নাম শুনে তারা কাছে প্রায়ই নিয়ে আসতাম। বুধবার বিকেলেও কথিত ডাক্তার কামরুন্নাহার আমার স্ত্রীর আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে বৃহস্পতিবার সকালে আসতে বলেন। তার কথামতো বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে তার চেম্বারে আসি। সেখানে আনার পর তিনি আমার স্ত্রীকে ইনজেকশন ও স্যালাইন দেন। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ছেলে সন্তান হয়েছে বলে আমাকে জানানো হয়। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পর আবারও জানানো হয়, সাইড সিজারে সন্তান ডেলিভারি হওয়ায় আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছে এবং সন্তান মারা গেছেন।
অপর মৃত শিশুর খালা কুলসুমা জানান, আমার ছোট বোনের প্রসব ব্যথা শুরু হলে সকাল ৯টায় আমরা কামরুন্নাহার ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে আসি। দুপুর ২টার দিকে আমার বোনের সন্তান প্রসব হওয়ার পর থেকে শিশুটির শরীর ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসছিল। বিষয়টি কামরুন্নাহারকে জানাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ডাক্তার না আপনারা ডাক্তার’ এ কথা বলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বিকেল ৪টার দিকে তিনি (ডাক্তার) আমাদের হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এই ইনজেকশনটি নিয়ে আসেন, বাচ্চার অবস্থা ভালো না’ আমরা বাজার থেকে ওই ইনজেকশন এনে দিলে তারা ওই ইনজেকশনটি শিশুটির শরীরে পুশ করার কিছুক্ষণের মধ্যে তার মৃত্যু হয়।
এদিকে মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে দুইটি বাচ্চার মৃত্যুর পর কামরুন্নাহার ‘বাজার থেকে আসছি’ বলে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে কথিত ওই চিকিৎসক কামরুন্নাহারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করলেও বন্ধ পাওয়া যায়।
এ ব্যাপারে চান্দিনা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আলী মাহমুদ জানান, খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে দুটি নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করেছে। কথিত ডাক্তার কামরুন্নাহার আত্মগোপন করায় তাকে পাওয়া যায়নি, তবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার সহযোগীকে আটক করা হয়েছে।
চান্দিনা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নাছিমা আক্তারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
রাতে কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন ডা. মুজিব রাহমান জানান, বিষয়টি সম্পর্কে আমার আগে জানা ছিল না, এখন যেহেতু জেনেছি তাই অনুমোদনহীন এই ভুয়া ক্লিনিক ও কথিত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মোবাইল: +৮৮০১৭১৭৯৬০০৯৭
ইমেইল: news@dailycomillanews.com
www.dailycomillanews.com