আবদুর রহমানঃ পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের প্রবেশদ্বার বলা হয় কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশনকে। কিন্তু দেশের ঐতিহ্যবাহী এই রেলওয়ে জংশন তাঁর জৌলুস হারিয়েছে। ‘কত লাকসাম কত বাত্তি’ খ্যাত এই জংশন এখন যাত্রীদের কাছে ‘বিষফোড়া’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগ রয়েছে ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল লাকসাম রেলওয়ে জংশনের স্টেশন মাস্টার হিসেবে যোগদান করেন মো.জালাল উদ্দিন। এরপর থেকে লাকসাম রেলওয়ে জংশনকে অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন তিনি। এক কথায় বলতে গেলে স্টেশন মাস্টাল জালাল উদ্দিন নিজেই বারোটা বাজিয়ে চলেছেন রেলওয়ের। যাত্রীদের কাছে রেলওয়ের সেবাকে ভোগান্তি আর অভিশাপে পরিণত করেছেন তিনি। সরেজমিন অনুসন্ধানে উঠে এসেঠে ওই স্টেশন মাস্টার দুর্নীতি ও অনিয়মের ভয়াবহ চিত্র।
বিক্রি শুরুর আধা ঘন্টার পরই টিকেট হাওয়া : লাকসাম রেলওয়ে জংশন হলো পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের প্রবেশদ্বার। যার কারনে এই স্টেশনে পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ে চলাচলকারী বেশিরভাগ ট্রেনের যাত্রাবিরতী রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, তুর্ণা নিশিতা, উদয়ন, উপকূল, মহানগর প্রভাতী, মহানগর গৌধুলি, পাহাড়িকা এক্সপ্রেস, বিজয়, চট্টলা একপ্রেসসহ বেশ কয়েকটি ট্রেন। লাকসাম স্টেশন থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে এসব ট্রেনের প্রায় ৩’শ টিকেট রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতিদিন সকাল ৮টায় লাকসাম স্টেশনে টিকেট বিক্রি শরু হলেও মাত্র আধা ঘন্টা পরেই আর কাউন্টারে টিকেট পাওয়া যায় না। এরপর থেকে টিকেট পাওয়া যায় কালোবাজারিতে। বাধ্য হয়ে যাত্রীদের চড়া মূল্যে টিকেট কিনতে হয় কালোবাজারিদের কাছ থেকে। অনেক ট্রেনের টিকেট দ্বিগুন দামেও কিনেন যাত্রীরা। তবে কালোবাজারিতে সবচেয়ে বেশি মূল্য সিলেটগামী আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ও ঢাকাগামী তুর্ণা নিশিতা এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকেটের। তুর্ণা নিশিতা ট্রেনের ২২৫ টাকা মুল্যের টিকেট ৪’শ থেকে ৬’শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় কালোবাজারিতে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, লাকসাম রেলওয়ে জংশনের স্টেশন মাস্টার হিসেবে জালাল উদ্দিল যোগদানের পর থেকেই গড়ে উঠেছে শক্তিশালী টিকেট কালোবাজারি সিন্ডিকেট। আর এই সিন্ডিকেটের মূলহোতা স্বয়ং স্টেশন মাস্টার নিজেই। স্টেশন মাস্টার জালাল উদ্দিন উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের সোহরাব হোসেন, রেলের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী নুরুল ইসলাম, মোবারক হোসেন ও শাহজাহানকে দিয়ে এই সিন্ডিকেট পরিচালনা করে আসছেন। রেল কর্মচারীরা চড়া দামে কালোবাজারির টিকেট বিক্রি করে স্টেশনের ভিতরেই। আর সোহরাব হোসেন বিক্রি করেন স্টেশনের বাইরে জংশন এলাকার আজমির হোটেলের ভিতরে বসে বা ওই হোটেলের পাশের বাদল নামের এক ব্যক্তির দোকানে বসে।
মনির হোসেন নামে একজন রেলযাত্রী অভিযোগ করেন, বর্তমান স্টেশন মাস্টার লাকসামে যোগদানের পর থেকেই কাউন্টারে টিকেট পাওয়া যায় না সকাল সাড়ে আটটার পর। তার নিযুক্ত লোকেরা জংশনের বিভিন্ন দোকানে বসে অতিরিক্ত মূল্যে ট্রেনের টিকেট বিক্রয় করে কালোবাজারিতে। যা অনেকটাই প্রকাশ্যে। আমি গত দু’দিন আগে আজমির হোটের পাশে বাদলের দোকান বসে থাকা সোহরাবের কাছ থেকে ৫’শ টাকায় তুর্ণা নিশিতা ট্রেনের একটি টিকেট কিনেছি।
মোজাম্মেল হক নামের একজন রেলযাত্রী বলেন, আমাকে চাকরির প্রয়োজনে প্রায় ঢাকা-চট্টগ্রাম আসা যাওয়া করতে হয়। তবে কখনো কাউন্টার থেকে টিকেট পাই না। বাধ্য হয়ে প্রায় সময় রেলের কর্মচারী নুরুল ইসলাম, মোবারক হোসেন ও শাহজাহানের কাছ থেকে অতিরিক্ত মূল্যে টিকেট কিনতে হয়। সড়ক পথে জ্যামসহ বিভিন্ন সমস্যা থাকায় নিরুপায় হয়ে এসব কালোবাজারিদের কাছে দর্ণা দিতে হয়।
যাত্রীদের বিশ্রামাঘার বন্ধ রাখা হয় : জালাল উদ্দিন লাকসামে যোগদানের কয়েক মাস পর থেকে স্টেশনের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বিশ্রামাঘারের দরজা প্রায় সময়ই তালা মেরে রাখেন। এতে যাত্রীদের বাধ্য হয়ে স্টেশনের মূল ফটকের বাইরের উত্তর-পশ্চিম দিকে থাকা পাবলিক টয়লেটে যেতে হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে স্টেশন মাস্টার পাবলিক টয়লেট পরিচালনাকারীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে টাকা পেয়ে থাকেন। এজন্য প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বিশ্রামাঘারের দরজা বন্ধ করে রাখেন তিনি। এতে বাধ্য হয়ে যাত্রীরা টাকার বিনিময়ে পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করছেন।
জোনায়েদ হোসেন, সালমা আক্তারসহ বেশ কয়েকজন যাত্রী জানান, লাকসাম রেল স্টেশন দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করি। কিন্তু কখনও যাত্রীদের বিশ্রামাঘারের দরজা খোলা দেখিনা। যার কারনে বাধ্য টাকার বিনিময়ে যাত্রীদের পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করতে হচ্ছে।
যাত্রীদের পদর্শন করা মনিটর বন্ধ রাখা হয়, বুকিং সহকারীরা থাকেন না কাউন্টারে : কালোবাজারের সুবিধার্থে স্টেশল মাস্টার জালাল উদ্দিন যাত্রীদের জন্য পদর্শন করা মনিটর বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ রাখেন। ওই মনিটরের মাধ্যমে যাত্রীরা লাকসাম থেকে ট্রেনের টিকেট আছে কিনা সেই তথ্য জানতে পারার কথা।
এদিকে, কালোবাজারিতে টিকেট চলে যাওয়ার কারনে লাকসাম স্টেশনের কাউন্টার প্রায় সময়ই থাকে বুকিং সহকারী শূন্য। এতে যাত্রীদের কাউন্টারে অপেক্ষা করে পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে।
পেনশনভোগীদের কাছ থেকে ‘ঘুষ’ আদায় : লাকসাম জংশন থেকে প্রায় ৭’শ পেনশনভোগী প্রতি মাসে ভাতা উত্তোলন করেন। স্টেশন মাস্টার জালাল সেই পেনশনভোগীদের কাছ থেকে প্রতি মাসেই টাকা আদায় করেন। আর টাকা না দিতে চাইলে তাঁদেরকে হয়রানি শুরু করেন তিনি। মাস্টার তার অফিসের কর্মচারী সামিনা আক্তার, বাচ্চু মিয়া ও অস্থায়ী গেইট কিপার শহীদের মাধ্যমে এসব পেনশনভোগীদের কাছ থেকে সুযোগ বুঝে ৫০ টাকা থেকে ৫’শ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন।
নাম প্রকাশ না শর্তে অন্তত ৫জন পেনশনভোগী জানান, স্টেশন মাস্টারের এমন ঘুষ বাণিজ্যের কারনে প্রতি মাসেই পেনশনভোগীদের সঙ্গে হট্টগোল বাধে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টাকা না দিলে তিনি আমাদের হয়রানি শুরু করেন। গত সপ্তাহে ঈদের অযুহাতে আমাদের কাছ থেকে ২’শ, ১’শ টাকা করে আরো বেশি টাকা আদায় করা হয়েছে।
ভুয়া ভাউচারে তেলের টাকা আত্মসাত : ২০১৫ সালে লাকসামে যোগদানের পর থেকে স্টেশন মাস্টার জালাল উদ্দিন প্রতি মাসে তেল খরচের নামে ৭ হাজার ৮’শ টাকা উত্তোলন করছেন। তিনি এই টাকা উত্তোলন করতে মেসার্স চৌধুরি ফিলিং স্টেশন নামে লাকসাম বাইপাস রোডের নশরতপুর এলাকার একটি পাম্পের ভাউচার ব্যবহার করছেন। তবে সরেজমিন অনুসন্ধানে ওই নামে কোন পাম্পের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
লাকসাম রেলওয়ে জংশনের কয়েকজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না শর্তে জানিয়েছে, মাস্টার নিজেই কাগজপত্রে ওই ভুয়া ফিলিং স্টেশন বানিয়েছেন। বাস্তবে যার কোন অস্তিত্ব নেই। প্রতি মাসে ৭ হাজার ৮’শ টাকা হিসেবে লাকসামে যোগদানের পর থেকে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন তিনি।
স্টেশনের দোকান ও হকারদের কাছ থেকে থেকে মাসিক চাঁদা আদায় : লাকসাম রেলওয়ে জংশন স্টেশনে অনুমোধিত ২৪টি দোকান রয়েছে। এসব দোকানের বেশিরভাগ অংশ থেকে প্রতি মাসে ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা হারে চাঁদা উত্তোলন করান স্টেশন মাস্টার জালাল উদ্দিন। বিনিময়ে ওইসব দোকানীদের স্টেশনের ফ্লাটফর্মে চুলাসহ বিভিন্ন মালামাল রাখার সুযোগ করে দেন তিনি। এতে যাত্রীদের চলাচলে সৃষ্টি হয় ভোগান্তি। এছাড়া স্টেশনে ভ্রাম্যমান হকার নিষিদ্ধ থাকলেও মাস্টার তার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অন্তত ২০জন হকার বসিয়েছেন । এসব হকারদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা হারে চাঁদা আদায় করা হয়। নাম প্রকাশ না শর্তে বেশ কয়েকজন হকার এবং ব্যবসায়ী এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
বুকিং ছাড়া মালামাল পাঠানো হয়, ট্রেন এলেও মাইকিং হয় না : স্টেশন মাস্টার কুলিদের মাধ্যমে বুকিং ছাড়াই মালামাল পাঠানোর ব্যবসাও শুরু করেছেন। লাকসাম-নোয়াখালী রুটে চলাচলকারী সমতট এক্সপ্রেস ট্রেনের মাধ্যমে এই ব্যবসা বেশি চালাচ্ছেন মাস্টার।
এছাড়া গত কয়েক মাস ধরে লাকসাম স্টেশনে ট্রেন আসার আগে মাইকিং হয় না। মাঝে মধ্যে স্টেশনে ট্রেন ডুকার পর মাইকিং হলেও বর্তমানে বেশিরভাগ সময়ই মাইকিং হয় না। এতে যে কোন সময় ঘটতে পারে বড় ধরণের হতাহতের ঘটনা। এছাড়া সঠিক সময়ে ট্রেন আসার খবর না পাওয়া কারনে যাত্রীদের চরম সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
লাকসাম স্টেশন দিয়ে চলাচলকারী অন্তত ১০জন যাত্রী বলেন, বর্তমান সরকার রেলের সেবা মানুষের জন্য সেখানে সহজ করে তুলছেন সেখানে রেলওয়ের বারোটা বাজিয়ে চলেছেন লাকসামের স্টেশন মাস্টার জালাল উদ্দিন। যদিও এটি রেলপথ মন্ত্রীর নিজের জেলা। ওই দুর্নীতিবাজ স্টেশন মাস্টারের এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকবে না।
অভিযুক্ত স্টেশন মাস্টার ও কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে লাকসাম রেলওয়ে জংশনের স্টেশন মাস্টার মো.জালাল উদ্দিন বলেন, আমার বিরুদ্ধে আসা এসব অভিযোগের একটাও সত্য না। এগুলো মিথ্যা, বানোয়াট এবং উদ্দেশ্য প্রনোদিত কথা। আমি এই ধরনের কোন অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত না।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক (সিসিএম) সর্দার শাহাদাত আলী খান বলেন, এসব অনিয়ম কোনভাবেই সমর্থন করার সুযোগ নেই। আমি ওই মাস্টারের বিরুদ্ধে আসা এসব অভিযোগগুলো তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি। আর টিকেট কালোবাজারির ব্যাপারে ভাম্যমান ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে জানাবো। এছাড়া মাস্টারের বিরুদ্ধে আসা অন্যান্য অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। সোজাকথা হলো আমি কোন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত না, তাই কেউ অনিয়ম-দুর্নীতি করলে তাকেও ছাড় দিবো না।
মোবাইল: +৮৮০১৭১৭৯৬০০৯৭
ইমেইল: news@dailycomillanews.com
www.dailycomillanews.com