আবদুর রহমানঃ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দিবাগত রাত ২ টার দিকে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার দাদঘর গ্রামের রশিদ মিয়ার বাড়ির সামনে থেকে কৃষক ইসমাইল হোসেন বাবুলের (৪৮) লাশ উদ্ধার করে মনোহরগঞ্জ থানা পুলিশ। উপজেলার দর্গাপুর গ্রামের অলি আহাম্মদের ছেলে বাবুল ছিলেন ৮ সন্তানের জনক। তিনি পরিবার নিয়ে গত প্রায় ১১ বছর ধরে দুর্গাপুর গ্রাম থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে বাইশগাঁও ইউনিয়নের লাকতমা এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। সেদিন রাতে উদ্ধার হওয়া বাবুলের মরদেহের বাম গালের আঘাতের দাগ ছিলো। এছাড়া শরীরের কোথাও আঘাত ছিলো না। সে সময় মরদেহ দেখে স্থানীয়দের ধারণা ছিলো ওই কৃষককে হত্যার পর ওই স্থানে লাশ ফেলে গেছে দুর্বৃত্তরা।
বাবুলের পরিবারের অভিযোগ ছিলো, সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে কৃষক ইসমাইল হোসেন বাবুলকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। লাশ উদ্ধারের পরদিন সকালে থানায় হত্যা মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। উল্টো পুলিশের এক সদস্যকে বাদী করিয়ে হত্যার ঘটনাকে সড়ক দুর্ঘটনা উল্লেখ মামলা নিয়েছিলেন থানার ওৎকালীন ওসি। এছাড়া খুনের ঘটনাকে সড়ক দুর্ঘটনা বানিয়ে আদালতে একটি ফাইনাল রিপোর্টও দিয়েছে তারা। তবে পুলিশের সেই রিপোর্টের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করেছেন বাবুলের স্ত্রী। আদালত সেই আবেদন আমলে নিয়ে ঘটনাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কুমিল্লাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। এছাড়া ঘটনার পাঁচ দিন পর ওই বছরের ৩০ আগস্ট তাঁর নিহতের স্ত্রী মরিয়ম বেগম আদালতে ৯ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু তাতেও পুলিশের কাছে সু-বিচার পাননি তারা।
জানা গেছে, চলতি বছরের ৩ এপ্রিল বাবুলের মৃত্যু হয়েছে অজ্ঞাত কোন গাড়ির ধাক্কায় এমন কথা উল্লেখ করে মনোহরগঞ্জ থানার তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো.নজরুল ইসলাম আদালতে একটি চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। গত ৭ আগস্ট পুলিশের দেওয়া সেই প্রতিবেদনের বিরদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করলে কয়েক দফা শুনানি শেষে আদালত মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশে গত ২ অক্টোবর মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান পিবিআই কুমিল্লার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো.শাহজাহান। এরপর মাত্র ১১ দিনের মধ্যেই কুমিল্লা জেলা পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো.ওসমান গনির নেতৃত্বে সংস্থাটির কুমিল্লা ইউনিটের সদস্যরা ওই কৃষকের মৃত্যুর রহস্য বের করতে সক্ষম হয়েছেন। অবাক করা ব্যাপার হলো পিবিআই’য়ের তদন্ত বের হয়ে আসে সড়ক দুর্ঘটনায় নয়, পরিকল্পিতভাবেই খুন করা হয়েছিলো কৃষক ইসমাইল হোসেন বাবুলকে। এরপর কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে এই খুনের ঘটনায় ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সংস্থাটি।
পিবিআই কুমিল্লা সূত্র জানায়, একটি জাতীয় দৈনিকে ‘পরিকল্পিত খুন’কে পুলিশ বানাল সড়ক দুর্ঘটনা!’ শিরোনামে অনুসন্ধানী একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় গত ৫ অক্টোবর। এরপর পিবিআই প্রধান পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার, চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল, কুমিল্লা জেলা পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো.ওসমান গনিসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে আসে বিষয়টি। পরে ওই কর্মকর্তারা সরাসরি মামলাটি তদারকি শুরু করেন। সংস্থাটির কুমিল্লা টিমের সদস্যরাও এই ঘটনার রহস্য বের করতে মাঠে নামেন। তদন্তের মাধ্যমে জানতে পারে সেদিন রাতে ( ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট) একটি ব্যাটারি চালিত অটোরিকশায় করে লাশটি ওই স্থানে ফেলা হয়েছিলো। ওইদিন রাতে স্থানীয় একজন ব্যক্তি অটোরিকশাটির চালকে চিনতে পেরেছিলেন। এরপর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে চট্টগ্রামের বন্দর থানাধীন ফকিরহাট এলাকার থেকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো.শাহজাহান গত ১৩ অক্টোবর রাতে অটো চালকে আটক করেন। ওই অটো চালকের নাম মো.নাসির। সে উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের আবুল খায়ের ছেলে। এরপর কুমিল্লায় এনে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ওই অটোচালক হত্যার ঘটনার বর্ণনা এবং হত্যাকারীদের নাম প্রকাশ করে। এরপর ১৫ অক্টোবর সোমবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলে আদালত ওই অটোচালকে জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন। এরপর সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে এই পরিকল্পিত খুনের ঘটনায় ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই সদস্যরা। গতকাল বুধবার দুপুরে গ্রেপ্তারকৃতদের কুমিল্লার আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন; উপজেলা সদরের দিশাবন্দ গ্রামের আবুল কালাম ওরফে কালু মেম্বার, দুর্গাপুর গ্রামের বর্তমান মেম্বার আবদুল হক, একই গ্রামের ইসমাইল হোসেন এবং মো.সুমন। এদের মধ্যে মেম্বার আবদুল হক ও ইসমাইল আদালতে বাবুলের স্ত্রীর দায়ের করা মামলার আসামী।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই কুমিল্লার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো.শাহজাহান বলেন, আমাদের পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার স্যার, চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল স্যার, কুমিল্লা জেলা পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো.ওসমান গনি স্যারের দিকনির্দেশনা এবং আমাদের কুমিল্লা টিমের সকল সদস্যদের আন্তরিকতা ও সহযোগিতার কারনে এতো অল্প সময়ের মধ্যে ওই কৃষকের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। ওই হতদ্ররিদ কৃষককে খুনের পর লাশ ওই স্থানে ফেলে রাখা হয়েছে এই বিষয়টি এখন পরিস্কার। তিনি জানান, সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে এই খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে আসামীদের কাছ থেকে জানা গেছে। এছাড়া গ্রেপ্তারকৃতদের আরো বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।
কুমিল্লা জেলা পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো.ওসমান গনি পিপিএম বলেন, ওই অটো চালকের কাছ থেকে গ্রেপ্তারকৃতরা ছাড়াও আরো বেশ কয়েকজনের নামে তথ্য পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে এটি একটি পরিকল্পিত হত্যা। এ ঘটনায় জড়িত অপর আসামীদের গ্রেপ্তারে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
বাবুলের ভাই ইউনুছের অভিযোগ, আসামিরা আমাদের সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে। এনিয়ে ২০০৭ সালে আমার ভাই বাবুল তাঁদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছিলেন। এরপর থেকে আসামিরা তাঁর ভাইকে খুনের হুমকি দিতে শুরু করে। যার কারণে তিনি অন্য গ্রামে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু তারপরও পরিকল্পনা করে খুন করা হয়েছে আমার ভাইকে। লাশ উদ্ধারের পরদিন আমরা থানায় হত্যা মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। উল্টো হুমকি দিয়ে আমাদের থানা থেকে বের করে দিয়েছে। সে সময়ের থানার ওসি সামছুজ্জামান, প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মিন্টু মোল্লা আর দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা ওসি (তদন্ত) নজরুল ইসলাম আমাদেরকে বেশি হয়রানি করেছে। থানায় গেলেই আমাদের গালমন্দ করতো, বের করে দিতো। গরীব বলে পাত্তা দিতো না। কারন তারা আসামীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে পুরো ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়েছে। আর বর্তমানে গ্রেপ্তার হওয়া আসামীদের লোকজনরা সন্ত্রাসীদের দিয়ে আমাদের হুমকি দিচ্ছে। মামলা তুলে নিতে চাপ দিচ্ছে। এক কথায় বলতে গেলে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই কৃষককে হত্যার ঘটনার সময় মনোহরগঞ্জ থানার ওসি ছিলেন মো.সামছুজ্জামান (বর্তমানে মিশনে সুদান রয়েছেন)। ওই কৃষকের লাশ উদ্ধারের পর মনোহরগঞ্জ থানার তৎকালীন এসআই মিন্টু মোল্লা প্রথমেই বিষয়টিকে সড়ক দুর্ঘটনা উল্লেখ করে একটি সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে লাশ মর্গে পাঠান। সে সময় পুলিশের লাকসাম-মনোহরগঞ্জ সার্কেলের দায়িত্বরত সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান তার দপ্তরে ছিলেন না। তিনি সরকারী কাজে কয়েকদিনের জন্য তখন ঢাকায় ছিলেন। নিহতের পরিবারও এই কথা স্বীকার করেছে। পরদিন থানার ওসির নির্দেশে এএসআই শেখ ফরিদ বাদী হয়ে ওই ঘটনায় একটি সড়ক দুর্ঘটনার মামলা করেন। যার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন এসআই মিন্টু মোল্লা। এরপর তিনি মনোহরগঞ্জ থানা থেকে বদলী হলে থানার তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো.নজরুল ইসলাম ওই মামলার দায়িত্বভার পান। এরপর চলতি বছরের ৩ এপ্রিল বাবুলের মৃত্যু হয়েছে অজ্ঞাত কোন গাড়ির ধাক্কায় এমন কথা উল্লেখ করে আদালতে একটি চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তিনি। নজরুল ইসলাম বর্তমানে লাকসাম থানায় পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। আর প্রতিবেদন দাখিলের সময় থানার বর্তমান ওসি মো.আনোয়ার হোসেন দায়িত্বে ছিলেন।
‘একটি পরিকল্পিত খুন কিভাবে সড়ক দুর্ঘটনা হলো’ এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ পরিদর্শক মো.নজরুল ইসলাম বলেন, আমি ছিলাম মামলাটির দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা। কোন স্বাক্ষ-প্রমান না পাওয়ার কারনে আমাদের মনে হয়েছে বিষয়টি সড়ক দুর্ঘটনা। তাই আমি সেভাবে প্রতিবেদন দিয়েছি। এছাড়া ঘটনার সময় আমি মনোহরগঞ্জ থানায় ছিলাম না। আমি এসে মামলাটি সড়ক দুর্ঘটনার মামলা হিসেবেই পেয়েছি। আমার আমার বিরুদ্ধে বাদী পক্ষের করা এসব অভিযোগ সত্য নয়। এছাড়া তারা আমাকে কোন স্বাক্ষ্য প্রমানও দিতে পারেনি।
বাদী পক্ষে এই মামলার আইনজীবি অ্যাডভোকেট মো.তৌহিদুর রহমান বলেন, ঘটনার প্রথম থেকেই আসামীদের সঙ্গে আতাঁত করে থানা পুলিশের সদস্যরা এই পরিকল্পিত খুনকে সড়ক দুর্ঘটনা বানিয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও বলা হয়নি মৃত্যুর কারন দুর্ঘটনা। আমি পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে দাবি জানাবো, খুনিদের পাশাপাশি সে সময় মনোহরগঞ্জ থানায় কর্মরত যেই পুলিশ কর্মকর্তারা বিষয়টি ধামাচাপা দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে যেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আর এতো দ্রুত হত্যার রহস্য বের করাসহ আসামীদের গ্রেপ্তারের জন্য পিবিআইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
মোবাইল: +৮৮০১৭১৭৯৬০০৯৭
ইমেইল: news@dailycomillanews.com
www.dailycomillanews.com