ডেস্ক রিপোর্টঃ কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে গত ১০ বছরে শিক্ষার্থীদের কাছে তিনটি মসজিদের নামে আদায় করা টাকার হিসাব গায়েব হয়ে গেছে। এ ছাড়া ২০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নানা খাত দেখিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে আদায় করা টাকার হিসাবও নেই কলেজটির। আদায় করা কোটি কোটি টাকার বিষয়ে সদুত্তর মিলছে না কলেজ কর্তৃপক্ষের। ফলে আদায় করা অর্থ কোথায় গেল, তা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু মসজিদের নামেই নয়, ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে আর্থিক অনিয়ম মহামারি আকার ধারণ করেছে। উন্নয়নের নামে নতুন নতুন খাত সৃষ্টির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের থেকে টাকা আদায়ের হার বেড়েই চলেছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে রেজুলেশনের বাইরেও শিক্ষার্থীদের থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। এসব কারণে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
পরিপত্রের বাইরে মসজিদ উন্নয়ন ফি, ব্যবহারিক ও ভাইভার জন্য আলাদা করে টাকা আদায় এবং যেসব উন্নয়নমূলক কাজ উচ্চমাধ্যমিক অথবা ডিগ্রি শাখার কিংবা বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, সেসব উন্নয়নমূলক কাজের নাম ভাঙিয়ে গড়পড়তা সব শিক্ষার্থী থেকে সমানতালে টাকা আদায়ের ঘটনায় সব মহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে অনুসন্ধানের মাধ্যমে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ডিগ্রি শাখা, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের নিউ হোস্টেলে কলেজের তিনটি মসজিদ রয়েছে। কলেজের আয়ের খাত অনুযায়ী ভর্তির সময় প্রতি শিক্ষার্থী মসজিদের উন্নয়নে ৫০ টাকা করে চাঁদা দেওয়ার কথা, যা আদায় করা হয় রসিদের মাধ্যমে।
কিন্তু প্রতি শিক্ষাবর্ষে বিনা রসিদে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মসজিদ উন্নয়নের নামে ভর্তি ও ফরম ফিলআপের সময় ১০০ টাকা করে মোট ২০০ টাকা আদায় করা হয়। শুধু তা-ই নয়, এক বিষয়ের ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষার ফরম ফিলআপের জন্যও ১০০ টাকা বাধ্যতামূলক।
এ ক্ষেত্রে মসজিদ উন্নয়নের নামে প্রতি শিক্ষাবর্ষে একজন শিক্ষার্থী থেকে ২৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বিনা রসিদে গড়ে ২০ হাজার ছাত্র থেকে এ টাকা আদায় করা হলেও কলেজের হিসাব শাখায় মাত্র সাত মাসের আয়-ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে।
বাকি সময়ে আদায়কৃত কয়েক কোটি টাকা কী কাজে ব্যয় করা হয়েছে, কোন বিভাগ থেকে কত টাকা নেওয়া হয়েছে, মসজিদে কী ধরনের উন্নয়ন করা হয়েছে, তার একটি এলোমেলো তথ্য থাকলেও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য মসজিদ কমিটি সংরক্ষণ করেনি।
কলেজের শিক্ষার্থীরা বলছেন, স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তরে ভর্তি হওয়া একজন শিক্ষার্থী নিয়মিতভাবেও যদি পরীক্ষা দিয়ে সব বিষয়ে উত্তীর্ণ হন, ওই শিক্ষার্থীকে সর্বনিম্ন ১০ বার (ভর্তি ও ফরম পূরণ মিলিয়ে পাঁচ শিক্ষাবর্ষ) এ টাকা বাধ্যতামূলক কলেজকে দিতে হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজের এক করণিক জানান, ‘১৮ বছর ধরে ভিক্টোরিয়া কলেজে চাকরি করছি। চাকরির শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রতিবছরই বিনা রসিদে মসজিদ উন্নয়ন ফি আদায় করা হচ্ছে।’
এদিকে আইসিটি খাতে কলেজের উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রি শাখার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৩০ টাকা করে আদায়ের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান ক্লাব ও বিসিসি ল্যাব নামে নতুন দুটি খাত সংযোজন করে প্রতি শিক্ষার্থী থেকে সর্বমোট ৮০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। বিজ্ঞান ক্লাব উচ্চমাধ্যমিকের ৮০০ শিক্ষার্থীর জন্য সীমাবদ্ধ হলেও চাঁদা দিতে হচ্ছে কলেজের ২৫ হাজার শিক্ষার্থীকে।
কলেজের একটি সূত্র বলছে, আইসিটি খাতে প্রতি মাসে সফটওয়্যার বিল ২৫ হাজার, ওয়াইফাই বিল ৪৫ হাজার ও ঢাকার অপর একটি সফটওয়্যার বিল বাবদ সাত হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শাখায় প্রবেশের সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়ার প্রয়োজনে সফটওয়্যার বিল দেওয়ার যৌক্তিকতা ছিল। বর্তমানে ফিঙ্গারপ্রিন্টের কোনো কার্যক্রম না থাকলেও সফটওয়্যার বিল কেন শিক্ষার্থীদের থেকে আদায় করা হচ্ছে, তার কোনো সদুত্তর মেলেনি।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, যুব রেড ক্রিসেন্টের নামে কলেজে আরেকটি খাত যুক্ত আছে। রেড ক্রিসেন্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক শিক্ষক ও প্রাক্তন ছাত্র জানান, রাষ্ট্রপতির নির্দেশনা অনুযায়ী রেড ক্রিসেন্টের কার্যক্রম উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকার কথা। কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শাখার প্রতি শিক্ষার্থী থেকে এ বাবদ ১৫ টাকা হারে চাঁদা নেওয়ার নিয়মও রয়েছে। যার ৪০ শতাংশ আবার কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা দেওয়ার শর্ত রয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে কলেজের অন্য শাখায় কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। তবে কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শাখায় এর কোনো কার্যক্রম নেই। কলেজের সব শিক্ষার্থী থেকে রেড ক্রিসেন্টের চাঁদা আদায় করা হলেও কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা হচ্ছে উচ্চমাধ্যমিকে আদায়কৃত টাকার ৪০ শতাংশ। ডিগ্রি শাখায় আদায়কৃত টাকার কোনো অংশই কেন্দ্রে জমা দেওয়া হচ্ছে না।
এ বিষয়ে রেড ক্রিসেন্টের কুমিল্লা জেলা যুব প্রধান মাসুম বিল্লাহ জানান, কলেজে যুব রেড ক্রিসেন্টের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তবে এখন পর্যন্ত মোট আয়ের ৪০ শতাংশ কলেজ কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রে জমা দিয়েছে কি না তা তার জানা নেই। যদি আদায় করা হয়, তাহলে ডিগ্রি শাখার একটি বিশাল অংশের টাকা কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা পড়ার কথা। রেড ক্রিসেন্টের দায়িত্বে থাকা দু-একজন শিক্ষক হয়তো কলেজ রেড ক্রিসেন্টকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন, তবে বাকিরা মিলে একে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে।
অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন শ্রেণিতে মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষার ফি বাবদ ৩০০ টাকা করে ভর্তি অথবা ফরম পূরণের সময় আদায় করা হয়। এর বাইরে টাকা আদায়ের নিয়ম না থাকলেও একাডেমিক কাউন্সিলে মিটিং করে ২০১৫-২০১৬ সালের ¯œাতকোত্তর শেষ পর্বের পরীক্ষার্থীদের থেকে ৩০০ টাকা করে আদায়ের রেজুলেশন করা হয়েছে। কোনো কোনো বিভাগে তার দ্বিগুণ-তিনগুণ অর্থ আদায় করছে বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠন থেকে কলেজের অধ্যক্ষ নিয়মিত সংবর্ধনা আদায় করছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে সংগঠনগুলো কলেজ ফান্ড থেকেই টাকা আদায় করছে। ওই টাকায় কলেজ অধ্যক্ষকে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে।
মসজিদ উন্নয়নের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি আদায়ের অভিযোগ সম্পর্কে ভিক্টোরিয়া কলেজ মসজিদ কমিটির আহ্বায়ক হাবীব আহ্সান উল্লাহর কাছে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি এখন কিছু বলতে চাই না। আপনি কলেজে আসেন, এ ব্যাপারে কথা বলব।’
ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ রতন কুমার সাহা বলেন, ‘ভিক্টোরিয়া কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শাখা, ডিগ্রি শাখা এবং নিউ হোস্টেল মসজিদসহ তিনটি মসজিদ রয়েছে। এগুলোর উন্নয়নের জন্য আমরা কাজ করছি।’
‘দীর্ঘদিন এই মসজিদগুলোর উন্নয়ন থেমে থাকলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়কৃত টাকা দিয়ে এগুলোর উন্নয়নকাজ অব্যাহত রয়েছে।’
এ ছাড়া আইসিটি, বিজ্ঞান ক্লাব, বিসিসি ল্যাব ও বিজ্ঞান ক্লাবে অতিরিক্ত ফি আদায় এবং যুব রেড ক্রিসেন্টে দুর্নীতির অভিযোগের বিপরীতে অধ্যক্ষ বলেন, ‘নির্ধারিত ফির বাইরে অতিরিক্ত ফি এবং যুব রেড ক্রিসেন্টে দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে আমি খোঁজ নেব।’
সূত্রঃ ঢাকা টাইমস
মোবাইল: +৮৮০১৭১৭৯৬০০৯৭
ইমেইল: news@dailycomillanews.com
www.dailycomillanews.com