ডেস্ক রিপোর্টঃ ঢাকার সঙ্গে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে ছয় লেনের একটি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। ২১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সড়কটি বর্তমানের ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশেই নির্মাণ করা হবে। এর জন্য রাস্তার পাশের বিভিন্ন স্থাপনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বসত-ঘর স্থানান্তরের প্রয়োজন পড়বে।
ফের সামনে আসছে ঢাকা-চট্টগ্রাম ছয় লেন কন্ট্রোল অ্যাকসেস এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের দ্রুত যোগাযোগের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনার নতুন সরকার গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটিকে অগ্রাধিকার দিতে যাচ্ছে।
জানা গেছে, মার্চের মধ্যে প্রকল্পটির ভূমি অধিগ্রহণ, ইউটিলিটি রি-সেটেলমেন্ট কাজের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুমোদন হবে। জুলাইয়ের মধ্যে বিনিয়োগকারী বাছাই করতে রিকোয়েস্ট ফর কোটেশন (আরএফকিউ) আহ্বান করবে পিপিপি কর্তৃপক্ষ। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের যোগাযোগ উন্নত করতে চার লেন মহাসড়ক করা হয়েছে।
তবে ত্রুটিপূর্ণ নকশা, সমন্বয়হীন দুই লেনের সেতু আর অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে দুর্ভোগ কমেনি, মেলেনি পণ্য পরিবহনের কাক্সিক্ষত সুবিধা। এখন সেতুগুলোকে চার লেনে উন্নীত করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও প্রতিদিনই বাড়ছে যানবাহনের চাপ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিদিন ১৭ হাজার যানবাহন চলাচলের বাস্তবতা নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন সড়ক নির্মাণ করা হয়। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের সমীক্ষা মতে, বর্তমানে এই রুটে গাড়ি বৃদ্ধির হার ৮ থেকে ১০ শতাংশ। এই হিসাবে আর দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যায় গাড়ি চলবে এই মহাসড়কে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এক সমীক্ষায় জানিয়েছে, ২০২০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে এ রোডে যানবাহনের চাপ বেড়ে প্রতিদিন ৬৬ হাজারে পৌঁছবে। তখন চার লেনের বিদ্যমান সড়কে সৃষ্টি হবে অচলাবস্থা। এ অচলাবস্থা কাটাতেই সরকার এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্পটিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ হলে চট্টগ্রামের সঙ্গে রাজধানীর বাণিজ্যিক যোগাযোগ আরও সহজ হবে। মাত্র আড়াই ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
সূত্র জানায়, বিগত সরকারের সময়ই প্রকল্পটির কাজ শুরুর কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ নিয়ে টানাপোড়েন আর প্রশাসনিক অনুমোদনসহ ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। জানা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এই এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণের লক্ষ্যে ভূমি অধিগ্রহণসহ রাস্তার পাশে বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ, টেলিফোন লাইন এবং ঘরবাড়ি সরিয়ে পুনঃস্থাপনের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করে তার ডিপিপি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল গত বছর। তবে প্রশাসনিক অনাপত্তি চেয়ে ওই সময় ডিপিপি ফেরত পাঠায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।
ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) রুহুল আমীন বলেন, ‘প্রকল্পটি অনুমোদনের আগে জেলা প্রশাসন, বন বিভাগ এবং পরিবেশগত ছাড়পত্র চাওয়া হয়েছে। এই প্রকল্প পাঁচটি জেলার মধ্যদিয়ে বাস্তবায়িত হবে। এরই মধ্যে আমরা চার জেলার এনওসি (অনাপত্তিপত্র) পেয়ে গেছি।
চট্টগ্রামেরটা বাকি আছে। আশা করছি আগামী মাসের মধ্যে সেটি পাওয়া যাবে। এ ছাড়া বন ও পরিবেশগত এনওসি পাওয়ার বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে এসব ছাড়পত্র সংযুক্ত করে পুনরায় ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি রি-সেটেলমেন্টের ডিপিপিটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
আশা করছি মার্চের মধ্যে এর অনুমোদন পাওয়া যেতে পারে। সূত্র জানায়, ভূমি অধিগ্রহণ প্রকল্প পাসের পাশাপাশি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের মূল কাজের জন্য বিনিয়োগকারী খোঁজার প্রক্রিয়া চলছে। এর আগে এই প্রকল্পটিতে অর্থায়নে আগ্রহী ছিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। কিন্তু দেশের দীর্ঘতম এই এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি নির্মাণে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর এবং সেতু বিভাগের মধ্যে টানাটানিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় গত বছর এই ঋণপ্রক্রিয়া থেকে সরে যায় এডিবি। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সওজকে দায়িত্ব দেন। আর বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ ও অন্যান্য কাজে সহায়তা এবং তদারকির জন্য স্বতন্ত্র প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠান নিয়োগসহ বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করতে সাপোর্ট টু ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি পিপিপিতে পাঠানো হয়। এখন পিপিপি এই প্রকল্পে আগ্রহী বিনিয়োগকারী খুঁজতে আরএফকিউ (রিকোয়েস্ট ফর কোটেশন) আহ্বান করবে। আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই শেষে একটি শর্টলিস্ট করা হবে। সেখান থেকেই চূড়ান্ত বিনিয়োগকারী বেছে নেওয়া হবে।
প্রকল্পের পিডি আশা করছেন, আগামী মার্চের মধ্যেই আরএফকিউ আহ্বান করা সম্ভব। তবে পিপিপি কর্তৃপক্ষ বলছে, এ জন্য অন্তত ছয় মাস সময় লাগবে। জানতে চাইলে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটির মহাপরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) ফারুক আহমেদ বলেন, প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে ২০০৪ সালে। ওই সময় নির্মাণব্যয় যা ধরা হয়েছিল, সেটি দিয়ে তো এই সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ কারণে সম্ভাব্যতা যাচাই হালনাগাদ করার পর আরএফকিউ আহ্বান করা হবে। আগামী জুলাইয়ের মধ্যে এটি সম্ভব হবে বলে জানান পিপিপির এই ডিজি।
সূত্র জানায়, এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য হবে ২১৭ কিলোমিটার। সড়কের ১৯ কিলোমিটার এলিভেটেডওয়ে ও ১৯৮ কিলোমিটার হবে এক্সপ্রেসওয়ে। কাঁচপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্পটির আওতায় সার্ভিস রোড, সাতটি ইন্টারচেঞ্জ, তিনটি সার্ভিস স্টেশন, ৬৪টি ওভারপাস, ৪৪টি ভেহিকল আন্ডারপাস, চারটি মাঝারি সেতু ও ২৮টি ছোট সেতু নির্মাণ করা হবে। এর আগে প্রস্তাবিত প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় ১০ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা।
প্রকল্পটির মেয়াদকাল নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। হালনাগাদ ফিজিবিলিটি স্টাডিতে ব্যয় প্রাক্কলন ও প্রকল্পের নির্মাণকাল নতুন করে নির্ধারণ করা হবে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হতে পারে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণসহ ইউটিলিটি রি-সেটেলমেন্ট বাবদ ব্যয় হতে পারে ১৭ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, আগে যে মূল্যে ভূমির দাম ধরা হয়েছিল, এখন তার চেয়ে তিনগুণ বেশি দামে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। ফলে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ যে ডিপিপি চূড়ান্ত করা হচ্ছে সেখানে ১৭ হাজার কোটি টাকার ব্যয় প্রাক্কলন করা হচ্ছে। তিনটি প্যাকেজে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রথম প্যাকেজের আওতায় ঢাকার কাঞ্চনপুর থেকে কুমিল্লা, দ্বিতীয়টি কুমিল্লা থেকে ফেনী ও শেষ প্যাকেজটি হবে ফেনী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত। এটি হবে কন্ট্রোল অ্যাকসেস এক্সপ্রেসওয়ে।
মূল সড়ক হবে চার লেনের, বাকি দুই পাশে থাকবে দুই লেনের সার্ভিস রোড। সার্ভিস রোড দিয়ে স্থানীয় ধীরগতির যানবাহন চলাচল করবে। আর চারলেনের কন্ট্রোল অ্যাকেসেস রোড দিয়ে ন্যূনতম ১০০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন যানবাহনগুলোই চলাচলের সুযোগ পাবে। এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠা-নামার ব্যবস্থা থাকবে নির্ধারিত কিছু এলাকায়। দীর্ঘ ওই পথে যাতায়াত করতে টোল দিতে হবে। এ পথে সাতটি স্থানে যাত্রী ওঠা-নামা করতে পারবে।
যেসব জায়গায় যানবাহন থামবে সেগুলো হচ্ছে- নারায়ণগঞ্জের মদনপুর, কুমিল্লার দাউদকান্দি, ময়নামতি ও পদুয়ার বাজার, ফেনী, চট্টগ্রামের বারইয়ারহাট ও সলিমপুর। প্রকল্পের পিডি রুহুল আমীন বলেন, কন্ট্রোল অ্যাকসেস এক্সপ্রেসওয়ের মানেই হচ্ছে সেখানে ধীরগতির যানবাহন প্রবেশ করতে পারবে না। যানজটবিহীন বাধামুক্তভাবে দ্রুতগতির যানবাহন চলাচলের সুবিধার্থে এই এক্সপ্রেসওয়ে বাস্তবায়িত হলে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াতের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পাবে।
মোবাইল: +৮৮০১৭১৭৯৬০০৯৭
ইমেইল: news@dailycomillanews.com
www.dailycomillanews.com