ডেস্ক রিপোর্টঃ কুমিল্লা শহর ও শহরতলির যে কোনো এলাকায় মাদকের ব্যবহার বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে। বিভিন্ন স্থানে মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে পড়েন তরুণ থেকে বয়স্করাও। এদের মধ্যে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই বেশি। মাদকের টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে কেউ কেউ পকেটমার, ছিনতাই, চুরিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। একাধিক পরিবারের বাবা-মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, মাদকাসক্ত সন্তানের উত্পীড়ন ও কর্মকাণ্ডে সামাজিকভাবে তারা হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন এবং লোকলজ্জায় মুখ দেখাতে পারছেন না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কুমিল্লা নগরীর ছোটরা এলাকার এক প্রকৌশলীর ছেলে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে ছিলেন প্রথম। তিনি ১৯৯৫ সালে কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে এসএসসিতে সম্মিলিত মেধাতালিকায় ১৮তম স্থান অর্জন করেন। কিন্তু এইচএসসিতে ভর্তি হওয়ার পর তিনি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। এক রাতে কুমিল্লা শহরতলির দৌলতপুর এলাকায় মাদক সেবন করতে গেলে পুলিশ তাকে ধাওয়া দিলে তিনি পুকুরে ঝাঁপ দেন। পরদিন সকালে ঐ পুকুরে তার লাশ ভেসে ওঠে। এছাড়া গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি মুখে কাপড় বেঁধে হাতে ছুরি নিয়ে কুমিল্লার আদালতে প্রবেশ করেন নারী ও শিশু নির্যাতন আদালতের এক পাবলিক প্রসিকিউটরের মাদকাসক্ত ছেলে। নেশায় বুঁদ হয়ে ঐ তরুণ বিচারকের দিকে ছুরি নিয়ে তেড়ে যান। পরে পুলিশ এসে তাকে আটক করে। এমন আরো অনেক মাদকসেবী আছেন কুমিল্লা শহরে। এই সন্তানদের নিয়ে অতিষ্ঠ অভিভাবক ও পরিবারের সদস্যরা। নগরীর কান্দিরপাড় এলাকার একজন শিক্ষক বলেন, ‘প্রায় ১০ বছর আগে আমি আমার ভাইকে হারাই। নেশার টাকার জন্য সে পাগল হয়ে যেত। এক দিন রাতে অতিরিক্ত নেশা করে সে মারা যায়। সেই শোক ও দুঃখ আমরা আজও ভুলতে পারছি না।’ একজন নারী অভিভাবক বলেন, ‘ছেলের বাবা প্রবাসে থাকেন, শহরের একটি স্কুলে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ছেলেটি ভালো ছাত্র ছিল। কখন যে পাড়ার মাদকাসক্ত ছেলেদের সঙ্গে জড়িয়ে ফেনসিডিলে আসক্ত হয়ে পড়ল টেরই পেলাম না। নিরুপায় হয়ে এখন তাকে একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করে সংশোধনের চেষ্টা করছি।’ শহর ও শহরতলির অন্তত ১২টি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে মাদকাসক্ত সন্তানের জন্য তাদের অসহায়ত্বের নানা তথ্য জানা গেছে।
কুমিল্লায় বিজিবি, র্যাব, ডিবি ও থানা পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ গত বছরের জুনে ১৪ জন, গাড়ি চাপায় একজন এবং গত ২৮ আগস্ট একজনসহ মোট ১৬ জন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। কিন্তু এতেও যেন থামছে না মাদকের প্রসার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লার মাদকাসক্তি চিকিত্সা কেন্দ্রগুলোতে যারা চিকিত্সা (সংশোধন) নিচ্ছেন কিংবা ভর্তি হতে আসছেন তাদের মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগই ইয়াবাসেবী। দর্পণ মাদকাসক্তি চিকিত্সা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের পরিচালক গোলাম মহিউদ্দিন জানান, ‘মাদকসেবীর বেশির ভাগই ইয়াবায় আসক্ত।
ইয়াবার আসক্তিতে নানা বয়সের মানুষের স্বপ্নময় জীবন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে।’ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মহাদেব চন্দ্র মন্ডল বলেন, ‘প্রতিমাসে এক-দুই বার আমি ঢাকা থেকে কুমিল্লায় একটি মাদকাসক্তি চিকিত্সা কেন্দ্রে রোগী দেখতে আসি। এখানে তরুণ-যুবকরা ইয়াবায় সবচেয়ে বেশি আসক্ত। যাদের অনেকেই শিক্ষার্থী।’ সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লার সভাপতি বদরুল হুদা জেনু বলেন, ‘মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা ও অনিয়ন্ত্রিত পারিবারিক জীবন-যাপনের কারণে মাদকাসক্তের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। মাদকের এ ভয়াবহতা প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন জোরদারের বিকল্প নেই।’ কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পদোন্নতিপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার) আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘মাদকের উত্সমুখ বন্ধ করতে হবে। সীমান্ত দিয়ে যেন কোনোভাবেই মাদক ঢুকতে না পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। মাদক প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী জিরো টলারেন্স দেখিয়ে দায়িত্ব পালন করছে। তবে সন্তানকে মাদকের ছোবল থেকে রক্ষা করতে সবার আগে পরিবার ও অভিভাবকদের ভূমিকা রাখতে হবে।
সূত্রঃ ইত্তেফাক
মোবাইল: +৮৮০১৭১৭৯৬০০৯৭
ইমেইল: news@dailycomillanews.com
www.dailycomillanews.com