ডেস্ক রিপোর্টঃ ১২০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ভিক্টোরিয়া কলেজ দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে প্রতিষ্ঠানটি গৌরবময় স্থান দখল করে আছে। ১৮৯৯ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজের যাত্রা শুরু হলেও এর গোড়াপত্তন আরও আগে।
নগরীর রানীর দীঘির পশ্চিমপাড়ে ১৮৮৬ সালে লাকসামের তৎকালীন জমিদার রায় বাহাদুর আনন্দ চন্দ্র রায় এন্ট্রাস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৮ সালে এটি ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে রূপান্তরিত করেন মহারানী ভিক্টোরিয়া। ১৮৯৯ সালে তা পূর্ণাঙ্গ কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯১৮ সালে এখানে অনার্স কোর্স চালু হয়। ১৯৪২ সালে বিএসসি এবং ১৯৫৬ সালে বিকম কোর্স চালু হয়। ১৯৫৮ সালে নৈশকালীন পাঠদান কর্মসূচি চালু হয়। ১৯৬২ সালে মূল কলেজ ভবন থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে শহরতলীর ধর্মপুর এলাকায় কলেজটির ডিগ্রি শাখা খোলা হয়। ১৯৮৪-৮৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মর্যাদা লাভ করে ভিক্টোরিয়া কলেজ। ৩২ একর জমির উপর ১৮৯৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ১০৭ জন ছাত্র এবং সাতজন শিক্ষক নিয়ে যাত্রা শুরু করা ভিক্টোরিয়া কলেজের বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা ২৭ হাজার ছাড়িয়েছে। বর্তমানে শিক্ষকের সংখ্যা ১৬৪ জন।
কলেজটির উচ্চ মাধ্যমিক শাখা কুমিল্লা মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র রানীর দীঘির পশ্চিমপাড়ে প্রায় সাত একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে কয়েকটি টিনশেড ঘর, অধ্যক্ষের চেম্বার, দুটো নতুন ভবন, মসজিদ, স্মৃতিসৌধ প্রভৃতি রয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক শাখার শিক্ষার্থীদের জন্য টমছম ব্রিজের কাছে শেরেবাংলা ও রবীন্দ্রনাথ ছাত্রাবাস রয়েছে। ডিগ্রি শাখাটি মূল শহর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ধর্মপুরে ২৫ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে রয়েছে- কলাভবন নামে বৃহত্তর ভবন, বাণিজ্য অনুষদ, অর্থনীতি ভবন, বিজ্ঞান ভবন, গণিত ভবন, মোতাহার হোসেন লাইব্রেরি, মসজিদ, শহীদ মিনার ও দৃষ্টিনন্দন বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, প্রশাসনিক ভবনসহ বেশ কয়েকটি ভবন। ডিগ্রি শাখার ছাত্রদের জন্য ২০০ আসনবিশিষ্ট কবি নজরুল ইসলাম হল, ছাত্রীদের জন্য ৪০০ আসনবিশিষ্ট নবাব ফয়জুন্নেছা হল রয়েছে। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য ছয়টি বাস রয়েছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চায় বিএনসিসি, বিতর্ক পরিষদ, ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটার ও রোভার স্কাউটস রয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় শিক্ষার আলো ছড়ানো ভিক্টোরিয়া কলেজ শিক্ষা বিস্তারে এখনও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে কলেজটি সেরা ফলাফল করছে। চট্টগ্রাম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক শাখায় কয়েকবার সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে কলেজটি। এ কলেজের সাবেক সেরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন- আ ন ম ইউছুফ, এমএ আজিজ, আলী ইমাম মজুমদার, ডা. আরিফ মোর্শেদ খান, আমেরিকান প্রবাসী ডা. শরীফুজ্জামান ও কবিরুল ইসলাম।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ভিক্টোরিয়া কলেজের ৩৩৪ জন ছাত্র অংশ নেন। তাদের মধ্যে ৩৫ জন দেশমাতৃকার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। এ কলেজের স্বনামধন্য ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন- প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মূসা, বিজ্ঞানী আবদুল জলিল, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল, কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার, টিভি উপস্থাপক হানিফ সংকেত প্রমুখ। এছাড়া এ বিদ্যাপীঠের অনেক শিক্ষার্থী দেশ-বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছেন।
বিশিষ্ট নাগরিকদের অভিযোগ, শিক্ষার মানের দিক দিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক শাখায় ভিক্টোরিয়া কলেজ সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করলেও ডিগ্রি শাখার শিক্ষার মান উন্নয়ন হচ্ছে না। নানা সমস্যা ও অনিয়মে কলেজটি ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। পরিবহন সংকট, ক্লাস রুম ও হোস্টেল সমস্যা, লাইব্রেরি ও অডিটোরিয়াম জরাজীর্ণ, শৌচাগারের সমস্যা দীর্ঘদিনের। পানি নিষ্কাশন সমস্যায় জলাশয়ে রূপ নিয়েছে খেলার মাঠ। এতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে হতাশা নেমে এসেছে।
কুমিল্লার মানবাধিকার কর্মী আলী আকবর মাসুম বলেন, যুগোপযোগী শিক্ষার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না ভিক্টোরিয়া কলেজ। শিক্ষার্থীদের জীবনমান উন্নয়নে শিক্ষকরা ভূমিকা রাখতে পারছেন না। কুমিল্লা সনাক সভাপতি বদরুল হুদা জেনু বলেন, সরকারি হওয়ার আগে এ কলেজের শিক্ষকমণ্ডলীর গুণগত মান ছিল নজরকাড়া। তাদের যোগ্যতা ও মেধার সঙ্গে এখনকার শিক্ষকদের ব্যবধান আকাশ-পাতাল। অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে পড়লেও লেখাপড়ার গুণগত মান আগের জায়গায় নেই। তবে ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক ভিপি আবদুল হাই বাবলু বলেন, শিক্ষার মান আগের মতোই আছে। তিনি বলেন, আমাদের সময় স্বতন্ত্র পরীক্ষা হল নির্মাণের দাবি ছিল। এ দাবি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পূরণও করেছেন। কিন্তু এখন আবার শুনছি পরীক্ষার হলগুলো ক্লাস রুম বানিয়ে ফেলা হয়েছে। কলেজের সাবেক জিএস আবদুল্লাহ আল-মাহমুদ সহিদ বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে কলেজের শিক্ষার গুণগত মান পর্যায়ক্রমে উন্নতি হয়েছে। বর্তমানেও লেখাপড়ার মান অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ১৯৯১-৯২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ডা. আরিফ মোর্শেদ খান বলেন, আমাদের সময় ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার মান অনেক ভালো ছিল। শিক্ষকরা অনেক আন্তরিক ছিলেন। তাদের জন্যই তৎকালীন কুমিল্লা বোর্ডে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সম্মিলিত মেধা তালিকায় আমি চতুর্থ স্থান অর্জন করতে পেরেছি। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আরিফ মোর্শেদ খান বলেন, ভিক্টোরিয়া কলেজের সুনাম শুনলে নিজের কাছেও ভালো লাগে।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরী জানান, প্রতিষ্ঠার পর ৬০ দশক পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থায় স্বর্ণযুগ ছিল। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার মান ও ব্যবস্থাপনা উদ্বেগজনক। ফলাফল ও মানের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি পিছিয়ে পড়ছে।
কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর রুহুল আমীন বলেন, শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করে ক্লাস রুমকে প্রাণবন্ত করে তোলা হচ্ছে। শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রশাসনও কাজ করছে। তবে জলাবদ্ধতাসহ কলেজের কিছু সমস্যা ও সংকট রয়েছে। শিক্ষার্থীদের আবাসন ও কলেজের অবকাঠামোগত উন্নয়নে কিছু সমস্যা রয়েছে।
সূত্রঃ যুগান্তর
মোবাইল: +৮৮০১৭১৭৯৬০০৯৭
ইমেইল: news@dailycomillanews.com
www.dailycomillanews.com