তৈয়বুর রহমান সোহেল: করোনা দুর্যোগের আঁচ ভালো করে পড়েছে প্রবাসী অধ্যুষিত কুমিল্লা জেলায়। গ্রামের বাড়িঘর ছেড়ে সন্তানদের ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর জন্য যারা কুমিল্লা শহরে বাসা নিয়েছেন, করোনার প্রভাবে স্বামীর কম উপার্জন বা উপার্জনহীনতায় ওইসব বাসাবাড়ি ছেড়ে তারা আবার ফিরে যাচ্ছেন গ্রামে। অনেকে আবার টিকে থাকার জন্য কম ভাড়ার বাসা খুঁজছেন। অনেকে টিকে থাকার আশা ছেড়ে দিয়ে মালামাল নিয়ে চলে গেছেন গ্রামে। আবার বাসা বাড়ির ভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল দিয়ে কতদিন জীবন চালিয়ে নিতে পারবেন, তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ঘোর অনিশ্চয়তা।
কুমিল্লা নগরীর নজরুল এভিনিউতে ১৩হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিয়ে থাকেন এক নারী। সন্তান কুমিল্লা জিলা স্কুলে পড়ার সুবাদে কাছাকাছি বাসা নিয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দে দিন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু ওমান প্রবাসী স্বামীর আয় একেবারে কমে যাওয়ায় তিনি বাসা ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। তিনি জানান, হয় কম ভাড়ার বাসা নিব, তাতে সুবিধা করতে না পারলে চলে যাব গ্রামে।
ঠাকুরপাড়ার আরেক নারীর স্বামী কুয়েত প্রবাসী। তিন সন্তান নিয়ে কোনোভাবে দিন কাটে। দুই সন্তান পড়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ও নবাব ফয়জুন্নেছা স্কুলে। স্বামীর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগে। লুকিয়ে কাজ করেন। করোনার এ সময়ে লুকিয়ে কাজ করে কতদিন সন্তান-সন্ততির জন্য অন্ন জোগাড় করবেন, এ চিন্তায় ঘুম হয় না ওই নারীর। এদিকে বাসা ছেড়ে গ্রামে চলে গেলে অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে সন্তানদের ভবিষ্যত। এমন দোদুল্যতায় দিন কাটছে তার। তবে আর দুই-একমাস এভাবে চলতে থাকলে বাসা ছেড়ে গ্রামে চলে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
অপরদিকে কুমিল্লা নগরীতে করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকায় সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও এ বছর সন্তানদের স্কুলে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন কেউ কেউ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কুমিল্লা নগরীতে প্রবাসী পরিবার, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারী, শিক্ষক ও বাড়ির মালিক ছাড়াও নানা পেশার মানুষ বসবাস করে। পুরো জেলার প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষের বসবাস কুমিল্লা শহরে। তার মধ্যে এ তিন শ্রেণির মানুষের সংখ্যা শহরের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের মতো। করোনার এ দু:সময়ের প্রভাব অনেক বেশি পড়েছে প্রবাসী পরিবার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক,হোটেল রেস্তোরাঁয় কাজ করা শ্রমিক ও বাসা মালিকদের ওপর। এতে প্রবাসী পরিবার ও বেসরকারি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ইতিমধ্যে বাসা ছেড়ে দিয়ে গ্রামে পাড়ি জমিয়েছেন। সে সাথে বিভিন্ন বাসায় ফ্ল্যাট নিয়ে থাকা ব্যাচেলরদের বড় একটি অংশ বাসা ছেড়ে চলে গেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরীর বাগিচাগাঁও, ঠাকুরপাড়া, রানীর দিঘীর পাড়, রেসকোর্স, ঝাউতলা ও নজরুল এভিনিউসহ অভিজাত শহরের এলাকায় সবচেয়ে বেশি বাসা খালি হয়েছে। তুলনামূলক বেশি আয়-রোজগার করা মানুষের বসবাস ছিলো এসব এলাকায়। কিন্তু পরিস্থিতির সাথে তাল না মিলাতে পারায় বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন ভাড়াটিয়ারা। জীবনযাত্রার ব্যয় অনুসারে আয় কম হওয়ায় এবং করেনা সঙ্কটের কারণে অন্য কোথাও বাসা না পাওয়ায় বাসা ছেড়ে দিয়েছেন তারা।
এদিকে প্রবাসী পরিবার ও ইপিজেড শ্রমিকদের ভরসাস্থল হিসেবে খ্যাত আশ্রাফপুরে সবচেয়ে বেশি বাসা খালি হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
ঠিক কতসংখ্যক ভাড়াটিয়া শহর ছেড়ে চলে গেছেন এর সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলেও প্রায় প্রতিটি ভবন থেকে এক বা একাধিক ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়েছেন। এ সব বাসা বাড়িতে ঝুলছে বাসা ভাড়া দেওয়া হবে অথবা টু লেট নামক সাইন বোর্ড।
ক্ষুদ্র ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক ব্যবসায়ীর আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারাও বাসা-ব্যবসা ছেড়ে আপাতত নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা ব্যাংকারদের বেতন কমে যাওয়ায় তাদের একটি বড় অংশ বাসা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কেটে নেওয়ায় পরিবারদের গ্রামে পাঠিয়ে তারা অন্যভাবে শহরে বসবাস করছেন।
সব মিলিয়ে জুলাই-আগস্টে খালি হয়ে যেতে পারে নগরীর বিপুল সংখ্যক বাসা।
বাগিচাগাঁও নিলয় সোসাইটির মামুন আহমেদ নামে এক বাসার মালিক বলেন, আমার ১৯টি ফ্ল্যাটের মধ্যে সাতটি ফø্যাটের ভাড়া নিয়মিত পাচ্ছি। দুটি ফ্ল্যাটে আমি ও পরিবারের সদস্যরা থাকি। করেনাকালীন সময়ে একটি খালি হয়ে গেছে। কোনো কোনো ভাড়াটিয়ার কাছে চার মাসের ভাড়া পাই। আবার অনেকে বাসা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ অবস্থায় তাদেরকে যেমন চাপ দেওয়া যাচ্ছে না, আমরাও আছি বেকায়দায়। নানামুখী খরচের চাপ সামাল দিতে হচ্ছে আমাকে। অথচ বাসা ভাড়া আমার আয়ের উৎস।
নজরুল এভিনিউর শাখওয়াত হোসেন নামের অপর এক বাসার মালিক জানান, আমার পাঁচতলা বাসার অনেক ভাড়াটিয়াই বাসা ছেড়ে যাওয়ার কথা বলে দিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পেশাজীবীর সাথে কথা বলে জানা যায়, কুমিল্লা নগরীতে এমন অনেক বাড়ির মালিক আছে যারা অনেক সামর্থ্যবান। ইচ্ছে করলে সংকটের এই সময়ে ভাড়াটিয়াদের ভাড়া কিছুটা কমাতে পারেন। কিন্তু ভাড়াটিয়াদের শত অনুরোধেও তাদের মন নরম হচ্ছে না। তাদের মনোভাব এমন,প্রয়োজনে বাসা খালি থাকবে তারপরেও ভাড়া কমানো হবে না। কিছু মালিক রয়েছেন,তারা ভাড়াটিয়াদের অনুরোধে কিছু কিছু ভাড়া কমিয়েছেন।
জানা যায়,আবদুল হালিম (ছদ্মনাম) নামে এক ব্যক্তি ঢাকা ধানমন্ডিতে এক বিলাস বহুল হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট কাম ফাস্ট ফুড দোকানের ম্যানাজার পদে চাকুরী করতেন। মাসে সব কিছু মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার টাকা পেতেন। তার স্ত্রীসহ ২ সন্তান কুমিল্লায় বাসা ভাড়া করে থাকতেন। ছেলে জিলা স্কুলে নবম শ্রেণীতে আর মেয়ে ইবনেতাইমিয়া স্কুলে ৫ম শ্রেণীতে পড়তেন। ২৬ মার্চে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর তার হোটেল বন্ধ হয়ে যায়। এপ্রিল মাসে মার্চের বেতন দিয়ে মালিক জানিয়ে দিয়েছে হোটেল খোলা না হলে আর বেতন দেওয়া যাবে না। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (২৫ জুন)তার হোটেল খুলেনি। সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়া আবদুল হালিম মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সপরিবারে শহর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন গ্রামে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,মধ্যবিত্ত এই পরিবারটি সেখানেও আছে চরম আর্থিক সংকটে। এই চিত্র শুধু আবদুল হালিমের না। অসংখ্য হালিমরাই আজ চরম সংকটে শহর ছেড়ে যাচ্ছে গ্রামে।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লার সভাপতি বদরুল হুদা জেনু বলেন, এধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য বাসা মালিক ও ভাড়াটিয়াদের মধ্যে ভালো সমন্বয়ের দরকার হয়। কিন্তু লোন নিয়ে বিল্ডিং তৈরি করা মালিকরা এক্ষেত্রে কোনো প্রকার ছাড়া দিবেন বলে আমার মনে হয় না। অনেক বাসা মালিকের আয়ের উৎস বাসা ভাড়া। নতুন ভাড়াটিয়াদের জন্য হয়তো তারা সামান্য ছাড় দিবেন, তবে ভাড়া কমাবেন না। সংকটের শুরু। ক্রমশ আমরা গভীর সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছি।
মোবাইল: +৮৮০১৭১৭৯৬০০৯৭
ইমেইল: news@dailycomillanews.com
www.dailycomillanews.com