বালু ও মাটি খেকো হিসেবে চিহ্নিত ডাকাতদের কবলে পড়ে অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে এক সময়ের খরস্্েরাতা ডাকাতিয়া নদী। প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রতিনিয়ত তারা এই অপকর্মটি করে চললেও নামকাওয়াস্তে কয়েকটি লোক দেখানো অভিযান ছাড়া আর কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখছে না কেউ।
মেঘনা নদীর উপ-নদী ডাকাতিয়া নদী। দক্ষিণ কুমিল্লার মানুষের কাছে এই নদীটি এক সময় আশা জাগানিয়া ছিল। জোয়ার ভাটায় খরস্্েরাতা ডাকাতিয়া নদীটিকে বাঁধ দিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। বালু দস্যুদের কবলে পড়ে ডাকাতিয়া নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে বার বার। স্তব্ধ হয়ে গেছে ১৪১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর ডাকাতিয়া নদী। এককালের খর¯্রােতা ডাকাতিয়া নদীটি এখন প্রভাবশালীদের দখলদারিত্বের কারণে মৃতপ্রায়।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, নদীতে নেই জোয়ার-ভাটার উত্তাল ঢেউ। দক্ষিণ কুমিল্লার অংশের চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম, নাঙ্গলকোট, মনোহরগঞ্জ, লালমাই উপজেলার বিভিন্ন অংশে প্রভাবশালীদের কারণে অবৈধ দখল আর দূষণে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে নদীটি। ড্রেজার দিয়ে চলছে অবৈধভাবে মাটি কাটা। নদীর দুই পাড়ের মানুষ প্রশাসনের কাছে বারবার অভিযোগ করেও মিলেনি কোন প্রতিকার। এই বিষয় জানতে চাইলে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসুদ রানা বলেন, ডাকাতিয়া নদীতে আমাদের অভিযান চলমান আছে।
নাঙ্গলকোট উপজেলার নির্বাহী অফিসার লামইয়া সাইফুল বলেন, আমাদের এখানে এই ব্যাপারে অভিযোগ আসলে আমরা সাথে সাথে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করি। কিছুদিন পূর্বে আমরা নাঙ্গলকোট উপজেলার বাগড্ডা, আদরাসহ বেশ কিছু এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করেছি। অবৈধভাবে মৎস্য চাষ নামে ব্যক্তি ও সরকারি জমি দখল করে নদীতে অবৈধ বাঁধ সৃষ্টির বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, নদী খালে বাঁধ সৃষ্টি করে সরকারি ভাবে অনুমতি দেওয়া হয় না।যারা নদীতে অবৈধভাবে ভেসাল ব্যবহার বা মৎস্য খামার সৃষ্টি করছে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অভিযোগের ভিত্তির গ্রহন করা হবে।
ড্রেজার দিয়ে অপরিকল্পিত বালু ও মাটি উত্তোলনের ফলে ডাকাতিয়া নদীপাড়ের নাঙ্গলকোট ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলার রায়কোট ও কনকাপৈত ইউনিয়েনের শত শত একর ফসলি জমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অর্ধশতাধিক ড্রেজার দিয়ে প্রতিনিয়ত নদীরপাড়ের কৃষি জমি থেকে মাটি উত্তোলন করছে কয়েকটি স্থানীয় এইসব চক্র।
নাঙ্গলকোট উপজেলার উত্তর রায়কোট ইউনিয়নের চেয়ারম্যার মাষ্টার রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের উপজেলার অংশে বিষয় গুলো নিয়ে আমরা সবসময় সতর্ক থাকি। উপজেলা প্রাশসন সহ আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মিলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করি। কিন্তু ডাকাতিয়া নদীতে বিভিন্ন অভিযান চালানোর কয়েকদিন পর আবারও স্থানীয় কয়েকটি চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। যেহেতু প্রভাবশালী মহলটি অন্য উপজেলার তাতে আমাদের কিছু করা থাকে না।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ডাকাতিয়া অংশে নদীর পাড়ের বাসিন্দারা বলেন, প্রভাবশালীরা নদীতে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলছেন। এতে কয়েক দিনের মধ্যে নদীর পাড়ের বাড়িঘর ড্রেজারের গর্তে বিলীন হতে পারে। চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মুন্সিরহাট ইউনিয়নের, ছাতিয়ানী, বৈলপুর, কনকাপৈতের, মরকটা, তারাশাইল, জাগজুর, দূর্গাপুরা, বুদ্দিন, পান্নারা, আগুনশাল চিওড়া চিলপাড়া, মলিয়ারা, গুনবতীর পরিকোটসহ নাঙ্গলকোট উপজেলার উপজেলার বাঙ্গড্ডা, রায়কোট উত্তর, দক্ষিণ, মৌকরা, ঢালুয়া, বক্সগঞ্জ ও সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ডাকাতিয়া নদী এখন বালু ও উত্তোলন মাটি খননের রাজ্যে পরিণত হয়েছে। রুপাবেরী, নুরপুর, শ্যামপুর রায়কোট ও শরীফপুর ব্রিজের আশপাশে, ঘাসিয়াল, পূর্বখাঁঘর, ,ঝাটিয়াপাড়া, নগরিপাড়া, নারান্দিয়া, পূর্ব বামপাড়া, মোড়েশ্বর, চারিতুপা ও নাইয়ারা ব্রিজসংলগ্ন এলাকা,পুঁটিজলা, উরকুটি, খাজুরিয়া, চরজামুরাইল, বাকিহাটি, দক্ষিণ আলিয়ারা ও সাতবাড়িয়া বাজারসংলগ্ন এলাকায় মাসের পর মাস ধরে ডাকাতিয়া নদী থেকে বালু উত্তোলন করে আসছে প্রভাবশালীরা ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক জেলে জানান, চৌদ্দগ্রাম অংশের কনকাপৈত এক যুবলীগ নেতা একাধিক ড্রেজারের মালিক। তিনি ডাকাতিয়া নদীতে ড্রেজার বসিয়ে প্রতিবছর নদী থেকে বালু উত্তোলন ও মাটি খনন করলেও প্রশাসন এই ব্যাপারে কোন ভূমিকা নিচ্ছে না।
এছাড়া নাঙ্গলকোট উপজেলা অংশের বেশিরভাগ ড্রেজারের মালিক উত্তর রায়কোট পিঁপড্ডা গ্রামের বিএনপি নেতা মিজান মিয়া,দক্ষিণ রায়কোট বামপাড়া গ্রামের মো: নবী হোসেনসহ অনেকেই। এরা নাঙ্গলকোট অংশে বালু উত্তোলন করে। ডাকাতিয়া নদীতে প্রভাবশালীদের আধিপত্য বিস্তারের কারনে বর্ষা মৌসুমে মূলত এ নদীর মাছই বিভিন্ন চর, ছোট নদী, পুকুর, জলাশয়সহ সকল জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে বংশ বিস্তার করে। অপ্রতিরোধ্য ভেসালের ব্যবহারের কারণে এ সম্ভাবনাময় নদীর মাছের বংশ বিস্তার ধ্বংসপ্রায়। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ডাকাতিয়া নদীর চৌদ্দগ্রাম উপজেলা অংশের চিওড়া কনকাপৈত ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে নদীর জুড়ে ২৫-৩০ টি বাঁশ আর জাল দিয়ে বাঁধ সৃষ্টি করে অবৈধভাবে মৎস্য খামার সৃষ্টি করছে কয়েকটি চক্র। আবার বিভিন্ন স্থানে নদীর দুই পাশে রয়েছে ভেসাল ব্যবহার, কারেন্ট জাল ও অন্যান্য জাল। যত্রতত্র জালের কারণে নদীর এক অংশ থেকে আরেক অংশে একটি ছোটমাছও পার হতে পারে না। যদিও মৎস্য সংরক্ষণ আইনে ভেসাল, চুঙ্গিজালসহ স্থায়ী মাছ ধরার স্থাপনা বসানো নিষিদ্ধ। কিন্তু এ নিষেধকে তোয়াক্কা না করে প্রতিবছরই ডাকাতিয়ার বুকে এভাবেই প্রভাবশালীরা ভেসাল ও কারেন্ট জাল ব্যবহারের মাধ্যমে মাছের প্রজনন ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
নদীর এই দূরাবস্থার কারনে নাঙ্গলকোট ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ডাকাতিয়া অংশের মাঝবর্তী চর এলাকার চান্দেরবাগ জেলে পাড়ার তেমন একটা অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। অনেক জেলে বাপ-দাদার মাছ ধরার ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে ভিন্ন পেশা বেঁছে নিয়েছে। তেমনি একজন হলেন চান্দেরবাগের বাসিন্দা স্বপন মিয়া। তিনি বলেন, ছোট বেলা থেকে আমরা ডাকাতিয়াতে নৌকা দিয়ে মাছ ধরতাম,কিন্তু স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীরা নদীতে বাঁশ ও জাল দিয়ে অবৈধভাবে ছোট ছোট বাঁধ সৃষ্টি করে অবৈধভাবে মাছ চাষ করছে। এতে নদীতে এখন আর নৌকা চলার অবস্থা নেই।
এই বিষয় জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী মো.আব্দুল লতিফ জানান নদী শাসনের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড এর পক্ষ থেকে সম্প্রতি ডাকাতিয়া অংশে নদী খননের কাজ শুরু করেছে। আমরা কাউকে বালু বা মাটি উত্তোলনের অনুমোদন দেই না। যদি কেউ খনন কাজ করেও থাকে তবে এই ব্যপারে আমরা জানি না। এই বিষয়টি জেলা প্রশাসকের নলেজে দেওয়া আছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)কুমিল্লা আ লিক শাখার সভাপতি ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অবৈধভাবে মাটি ও বালু উত্তোলনের ফলে নদীর স্বাভাবিক ¯্রােতধারা পরিবর্তন ও বিপন্ন হচ্ছে। এতে নদীর দুই পাড়ের সৌন্দর্য দিন দিন নষ্ট হচ্ছে।ঐতিহ্যবাহী ডাকাতিয়া নদী যে ভাবে দখল হচ্ছে আর বাঁধ সৃষ্টি করে যে ভাবে বালু উত্তোলন করছে এক সময় দেখা যাবে ডাকাতিয়ার গোটা অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে । সুতরাং যা হওয়ার হয়ে গেছে। প্রশাসনের উচিত এই বিষয়ে এখনি কঠোর হওয়া।
মোবাইল: +৮৮০১৭১৭৯৬০০৯৭
ইমেইল: news@dailycomillanews.com
www.dailycomillanews.com