ধীরে ধীরে ভরাট করে ফেলা হয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্যের কুমিল্লা নগরী ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকার অনেক পুকুর ও ছোট-বড় জলাধার। আইন অমান্য করে এসব জলাধার ভরাটের পর নগর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নকশা অনুমোদন নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসিক ও বাণিজ্যিক বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এবার জেলা পুলিশ সুপারের সরকারি বাংলো ও সার্কিট হাউজ সীমানা লাগোয়া নগরীর ৩০০ বছরের পুরনো ‘উজির দিঘি’ ভরাটের চেষ্টা করছে একটি চক্র।
গত কয়েক দিন ধরে পানি নিষ্কাশনের কয়েকটি মেশিন লাগিয়ে দিঘির পানি অপসারণ করে শুকিয়ে অর্ধেকে নিয়ে আসা হয়। বিষয়টি জানার পর পরিবেশবাদী ও স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পরে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে শনিবার বিকালে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন দিঘির পানি সেচের মেশিন বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে একের পর এক পুকুর-জলাধার ভরাটের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবিদসহ নগরীর নানা শ্রেণি-পেশার নেতৃবৃন্দ।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালের ২২ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন মুখ্য সচিব এস এ সামাদ স্বাক্ষরিত এক স্মারকপত্রের মাধ্যমে বলা হয়, ‘কোনো অবস্থাতেই খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের স্বাভাবিক গতি ও প্রকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না। এমনকি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে খালবিল, পুকুর, নালাসহ প্রাকৃতিক জলাশয় বা জলাধার বন্ধ করা যাবে না।’ কিন্তু আইন অমান্য করে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকার প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো উজির দিঘি ভরাটের চেষ্টা চলছে।
নগরীর ভাষাসৈনিক শহিদ ধীরেন্দ নাথ দত্ত স্টেডিয়াম থেকে ১০০ গজ পূর্ব দিকে উজির দিঘি। এর পশ্চিম পাড়ে জেলা পুলিশ সুপারের বাংলো, উত্তর পাড়ে কুমিল্লা সার্কিট হাউজ, পূর্ব ও দক্ষিণ পাড়ে জনগণের বসতি। দক্ষিণ পাড়ের সড়ক দিয়ে আদর্শ সদর উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অফিস, উপজেলা ভূমি অফিস, কুমিল্লা কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও রাজগঞ্জ বাজারে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে। দীর্ঘ পরিসরের দৃষ্টিনন্দন এই দিঘিতে মাছের চাষ হয়।
জানা যায়, সম্প্রতি নগরীর মোগলটুলী এলাকার বাসিন্দা এক ব্যবসায়ী দিঘিটি নিয়েছেন। পরে তিনি এটি ভরাটের জন্য পানি কমানোর উদ্যোগ নেওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মাহবুবুল আলম নামের এক ব্যক্তি গত কয়েক দিন আগে থেকে দিঘির দক্ষিণ পাড়ে মেশিন বসিয়ে পানি অপসারণের কাজ শুরু করেন। খবর পেয়ে শনিবার বিকালে পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপপরিচালক শওকত আরা কলি ও আদর্শ সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মৌসুমী আক্তার ঘটনাস্থলে গিয়ে তারা পানি সেচের কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। এর আগে গত বছর নগরীর ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড় এলাকার শতবর্ষের একটি পুকুর ভরাট করা হয়। এখন সেখানে একটি বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। কুমিল্লা পুলিশ লাইন্সের দুটি পুকুরও ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।
এর আগে পুলিশ লাইন্সের ভেতরের একটি পুকুর ভরাট করা হয়। নগরীর নতুন চৌধুরীপাড়ার একটি, চকবাজার এলাকার একটিসহ অনেকগুলো পুকুর ভরাট করা হয়। এছাড়া নগরীর টমছমব্রিজের পূর্ব পাশের আদর্শ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবনের উলটো পাশের বড় একটি পুকুর ভরাট করে সেখানে সিটি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নকশা অনুমোদন নিয়ে দশতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা শাখার সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, একের পর এক পুকুর ও দিঘি ভরাট করে নগরীর পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপপরিচালক শওকত আরা কলি বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের নির্দেশে উজির দিঘির পাড়ে গিয়ে পানি সেচের মেশিন বন্ধ করে দিয়েছি। দিঘির মালিককে নোটিশ করেছি। বিনা অনুমতিতে এভাবে দিঘির পানি কমানোর কোনো সুযোগ নেই।’
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কু বলেন, ‘দুই ব্যক্তি কয়েক দিন আগে আমার কাছে এসে দিঘির পানি কমানোর কথা বলেন। তারা সেখানে কফি হাউজ ও পূর্ব পাড়ে রাস্তা করবেন বলে জানান। আমি তাদের বলে দিয়েছি, কোনো অবস্থায় দিঘি ভরাট করা যাবে না এবং দিঘিতে কোনো স্থাপনাও করা যাবে না। পরে তারা আইন অমান্য করে কার্যক্রম চালান। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
কুমিল্লা জেলাপ্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, ‘জলাধার আইনে দিঘি-পুকুর ভরাটের কোনো সুযোগ নেই। মেশিনে দিঘির পানি অপসারণের খবর পাওয়ামাত্রই আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছি।’
মোবাইল: +৮৮০১৭১৭৯৬০০৯৭
ইমেইল: news@dailycomillanews.com
www.dailycomillanews.com