কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলার শ্রীমদ্দি গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবারেরও বেশি বাঁশিশিল্পের সাথে জড়িত হয়ে পাল্টে দিয়েছে গ্রামের দৃশ্যপট। একমাত্র বাঁশি তৈরি করে এখানকার অনেকেই এখন স্বাবলম্বী। হোমনা উপজেলা সদরে থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে শ্রীমদ্দি গ্রামটির অবস্থান। বাঁশি তৈরি করে এখন স্বচ্ছল জীবন যাবন করছে তারা। তবে বাংলার নববর্ষকে সামনে রেখে তারা এখন ব্যস্ততম সময় পার করছেন বাঁশি শিল্পের সাথে জড়িত পরিবারগুলো। ১ লা বৈশাখ গ্রাম বাংলার মেলায় বাঁশি বিক্রির জন্য এখন বাঁশি তৈরিতে নিয়োজিত রয়েছেন।
শ্রীমদ্দি পুরো গ্রামটি ঘুরে চোখে পড়েনি বেকার কোন যুবক-যবতীর চেহারা। গ্রামের প্রায় সব বাড়িই দোচালা ঘরের। গ্রামের অধিকাংশ অধিবাসীই হিন্দু। সারা গ্রামে দেখা যায়, প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনা ও অলিগলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন ডিজাইনের বাঁশি। নারী-পুরুষ শিশুসহ সব বয়সের মানুষই বাঁশিশিল্পের বিভিন্ন ডিজাইন তৈরি করতে নিয়োজিত। গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীর পাশাপাশি তাদের সন্তানেরাও পিছিয়ে নেই। প্রত্যেকে নিজ কাজের ফাঁকে ফাঁকে সময় অনুযায়ী বাঁশি তৈরি করছেন। এভাবে কাটছে শ্রীমদ্দি গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের জীবণধারা। এখান থেকেই বিভিন্ন ডিজাইনের বাঁশি চলে যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় বড় মার্কেটগুলেতে।
শ্রীমদ্দি গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ল একজন সে গাছের নিচে বসে বাঁশি তৈরীতে ব্যস্ত। তবে তার কাছেই এলাকার বাঁশিশিল্পের কাজ সম্পর্কে পাওয়া গেলো নানান তথ্য। সে মানুষটি হলো হোমনা উপজেলার শ্রীমদ্দি গ্রামের লিটন চন্দ্র পাল। সে বললো বাঁশিশিল্পের কথা। তাদের গ্রামে বাঁশি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে সে থেকে এ বাঁশিশিল্পের সাথে জড়িত আমরাও। তাছাড়া এ কাজ খুব সহজ। ফাল্গুন মাস থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত অধিক বাঁশি তৈরি ও বিক্রি হলেও শ্রীমদ্দি গ্রামের শিল্পীরা সারা বছরই বাঁশি তৈরি করে।
শ্রীমদ্দি গ্রামের আরেক বাঁশি তৈরিকারক যতীন্দ্র বিশ্বাস জানালেন, আমরা চট্রগ্রাম, ফটিকছড়ি, সীতাকুন্ড, মিরাসরাই থেকে মুলি বাঁশ কিনে ট্রাক যোগে নিয়ে আসি শ্রীমদ্দি গ্রামে। পরে বিভিন্ন মাপ অনুযায়ী মুলি বাশঁ কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। এরপর টুকরোগুলো রোদে শুকিয়ে ফিনিস করে লোহা কয়লা ধারা গরম করে মাফ অনুযায়ী বাঁশে ছিদ্র করা হয় এবং মান্দাল কাঠ দিয়ে কডি তৈরি করে বাঁশের মাথায় আটকিয়ে দেওয়া হয় এবং বাঁশের কভারে রং দ্বারা বিভিন্ন ডিজাইন করে বাজারজাত করা হয়।
বাঁশিশিল্লীদের তৈরি প্রতিপিস মোহনা বাঁশি ৮ টাকা, আর বাঁশি ১২টাকা, মুখ বাঁশি ৬ টাকা, নাগিনী বাঁশি ৫ টাকা, ক্যালেনের বাঁশি ৬ টাকা, পাখী বাঁশি ৫ টাকা, সোহন বাঁশি ৪ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে। তবে লম্বা, মোটা নিঁখুত কাজের ওপর বাঁশির দাম নির্ভর করে। কিন্তু বাচ্চাদের মুখবাঁশি তৈরি ও বিক্রি হয় বেশি। শ্রীমদ্দি গ্রামের যতীন্দ্র বিশ্বাসের স্ত্রী রিণা বিশ্বাস নকশী করা বাঁশি তৈরি করেন। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলেই নকশী করা বাঁশি তৈরি করে বিভিন্ন এনজিও এক্সপোর্টের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর, বৃটেন, জাপান, কানাডা, জার্মান, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে রফতানী করে বলে তারা জানায়। দশম শ্রেণী পাস করার পর বিয়ে হয়ে যায় রিণা বিশ্বাসের। আর স্বামীর বাড়িতে এসেই শিখে নেয় বাঁশি তৈরির কাজ। তারপর থেকেই শুরু নকশী করা বাঁশি তৈরি করা। রিণা বিশ্বাস ৩ সন্তানের জননী। সারাক্ষণ গৃহ ও বাঁশি তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকেন। তবুও তার মুখে হাসি।
বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখের বৈশাখী মেলা ছাড়াও হোমনার মিরাশের মেলা, শ্রীমদ্দি কালীবাড়ীর মেলা, কচুয়ার সাচারের রথ মেলা, ধামরাইয়ের রথমেলা, মতলবের বেলতুলীর লেংটার মেলা, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার খরমপুরের মেলা, চট্রগ্রামের জবাবারের বলি খেলা, নাঙ্গলবব্দের অষ্টমী স্নান, সাতক্ষীরার পূজার মেলা, কুষ্টিয়া, গাজীপুরের মৌসুমী মেলায় বাঁশি বিক্রি ছাড়াও প্রায় সারা বছরই দেশের বিশ্বদ্যিালয়ের শহর, বন্দর, হাট- বাজারে তারা তাদের বাঁশি বিক্রয় করে থাকে।
বাঁশিশিল্পী আবদুল খালেক জানান, পূর্বে ১ হাজার ২শ’৮০টি কাউন বাঁশের মূল্য ছিল ১ হাজার ৫শ’ টাকা বর্তমানে ২ বছর যাবত ১ হাজার ২শ’৮০টি বাঁশের মূল্য ২ হাজার টাকারও বেশি। রং, কয়লা ও স্প্রিটসহ বাঁশি তৈরি সকল উপকণের দামই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাঁশি ২ বছর পূর্বে যে দাম ছিল চলতি বছরেও একই দাম। তবে এ বিষয়ে হোমনা উপজেলা চেয়ারম্যান রেহানা মজিদ বলেন, শ্রীমদ্দি গ্রামের সকল মানুষ বাঁশিশিল্পের সাথে জড়িয়ে থাকার কারণে এ এলাকায় চুরি-ডাকাতিসহ অন্যান্য সমাজবিরোধী কোন কাজ হয় না। সবাই যার যার কাজ নিয়েই ব্যস্ত।
মোবাইল: +৮৮০১৭১৭৯৬০০৯৭
ইমেইল: news@dailycomillanews.com
www.dailycomillanews.com