উপজেলা চেয়ারম্যান আজাদের ভাই মাসুদকে বাঁচাতে রাজনৈতিক অপতৎপরতা
কুমিল্লার তিতাস উপজেলার যুবলীগ নেতা জামাল হোসেন হত্যা মামলায় প্রকৃত মাস্টার মাইন্ডের আসবে কিনা এ নিয়ে ধোঁয়াশা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি কুমিল্লার আওয়ামী দলীয় রাজনৈতিক বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মী সমর্থকসহ আদালত পাড়া থেকে জনপদ পর্যন্ত নানা আলোচনার জন্ম দিয়ে চলছে এ মামলাটি।
আলোচিত এ হত্যা মামলাটির অন্যতম মূল পরিকল্পনাকারীসহ সংশ্লিষ্ট আসামিদের বিচার ও শাস্তি প্রক্রিয়ায় কোনো অতৎপরতা বাধা হয়ে দাঁড়ানোর আশঙ্কা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না বাদীপক্ষসহ তাদের স্বজনরা।
হত্যাকাণ্ডটি সংগঠিত হওয়ার পর মাস্টারমাইন্ড হিসেবে যখন তিতাসের আওয়ামী লীগ নেতা সোহেল সিকদারের নামটি সামনে আসে। আর ঠিক তখন দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের ভাই মো. মাসুদের নাম অন্তরালে থেকে যায়। আর তার পরপরই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা ৩টি বিদেশি পিস্তলসহ ৯ মে রাতে কুমিল্লার বুড়িচংয়ের নিমসার বাজার এলাকা থেকে মো. মাজহারুল ইসলাম সৈকত গ্রেপ্তার হন। মাজহারুল ইসলাম সৈকত দেবিদ্বারের বরকামতা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং তিনি দেবিদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যনের আবুল কালাম আজাদের আস্থভাজনদের অন্যতম একজন। ছাত্রলীগের এই পদটি সৈকত চেয়ারম্যান আজাদের সমর্থনেই পেয়েছে বলে কথিত আছে। এছাড়া গ্রেপ্তার হওয়া সৈকত চেয়ারম্যান আজাদের ভাই মাসুদের ঘনিষ্ঠ কর্মী বলেও জানা যায়।
চেয়ারম্যান আজাদ ও তার ভাই মাসুদ এবং সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতা সৈকতসহ গ্রেপ্তারকৃত সোহেল সিকদারের ঘনিষ্ঠ কিছু ছবি ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গেছে।
অন্যদিকে, চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রোশান আলী মাস্টারের ফাঁস হওয়া ফোনালাপে আজাদকে বলতে শোনা গেছে, আসামি সোহেল সিকদারকে সামনে এগিয়ে আনতে হবে। অর্থাৎ সোহেল সিকদারকে প্রাধাণ্য দেওয়ার জন্য রোশান আলী মাস্টারকে অনুরোধ করেন চেয়ারম্যান আজাদ।
এছাড়া ওই ফোনালাপে তিতাস উপজেলা চেয়ারম্যান পারভেজ হোসেন সরকারকে ক্ষতি করার কথাও বলেন, দেবীদের উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ। এই ঘটনায় উপজেলা চেয়ারম্যান পারভেজ হোসেন সরকার থানায় জিডি করেন। এদিকে, সৈকত গ্রেপ্তার হওয়ার পর চেয়ারম্যান আজাদের ভাই মাসুদ গা ঢাকা দেন। গোপনে মালদ্বীপ পালানোর সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গত ১১ মে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে গ্রেপ্তার হন মাসুদ। পরদিন দুপুরে মাসুদকে আদালতে পাঠানো হয়। অবশ্য এ বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদকর্মীরা জানতে পারেনি বা জানতে দেওয়া হয়নি। শুরু হয় আদালতে বিচারিক কার্যক্রমের প্রথম ধাপ। রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর করে আদালত, আবার পরদিন একই আদালত সেই রিমান্ড বাতিলের আদেশ দেন। একইভাবে রিভিশনের আদেশ দানের পর আদালত কর্তৃক আবার বাতিলের আদেশ প্রদানেরও দৃষ্টান্ত রয়েছে এ মামলায়।
মাসুদের আপনজন সৈকত অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়া, মাসুদের গোপনে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা, আবার গ্রেপ্তার হওয়ার পর গোপনীয়তা অবলম্বনে করে আদালতে পাঠানো, সংবাদ মাধ্যমকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি এড়িয়ে চলাসহ সব বিষয়গুলো এ হত্যাকাণ্ডে মাসুদের সম্পৃক্ততার গুরুত্ব বাড়লোবই কমছে না বলে বাদী পক্ষের স্বজনরা দাবি করছেন।
প্রথমে নিম্ন আদালতে মাসুদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের পর তা স্থগিত করেন একই আদালত। পরবর্তীতে উচ্চ আদালত সেই স্থগিতাদেশ বাতিল করে দেন। এরপর উচ্চ আদালতে আসামি পক্ষের আইনজীবী মো. মাসুদের রিমান্ডের বিষয়ে রিভিশন আবেদন করলে তা বাতিল করে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
এতে যুবলীগ নেতা জামাল হোসেন হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রের মালিক, হত্যা পূর্বের প্রশিক্ষণের স্থান ও আসামিদের গা ঢাকা দেওয়াসহ বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়গুলো আইনি প্রক্রিয়ায় বেড়িয়ে আসবে বলে প্রত্যাশা করেছেন বাদী পক্ষের আইনজীবী মাসুদ সালাউদ্দিন।
এছাড়া হত্যাকাণ্ডের পর আসামিরা ১ মে থেকে ৩ মে পর্যন্ত নোয়াখালিতে অবস্থান করেন। এখন প্রশ্ন, নোয়াখালিতে তারা কোথায় ছিল? এ বিষয়টি র্যাবের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে না থাকলেও একাধিক সূত্র জানায়, নোয়াখালির সুবর্ণচরে দেবিদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান আজাদের (মাসুদের বড় ভাই) মুরগীর খামার আছে। সেখানেই আসামিরা আত্মগোপনে ছিলেন বলে সূত্র দাবি করে।
অনেকের মতে, এ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড মাসুদকে বাঁচাতে বেশ তৎপর উপজেলা চেয়ারম্যান আজাদ। আজাদের ভাই মাসুদের পক্ষে আদালতে আইনজীবী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন কুমিল্লা-৫ সংসদীয় আসনের (বুড়িচং-বি পাড়া) সংসদ সদস্য এডভোকেট হাশেম খান। একজন খুনির পক্ষে একজন সংসদ সদস্যের আইনি লড়াইয়ের বিষয়টি বেশ সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
এদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানায়, মাসুদকে বাচাঁতে এখন রাজনৈতিক অপতৎপরতা চলছে। ফলে মাসুদের রিমান্ডে অনেক কিছুই অজানা থেকে যাবার সম্ভাবনা রয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে মাসুদকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হতে পারে বলে আশঙ্কায় রয়েছেন বাদীপক্ষ।
সূত্র আরো জানায়, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার হওয়া অস্ত্রগুলো মাসুদের। চেয়ারম্যান আজাদ তার ভাই মাসুদকে রক্ষা করার জন্য ছাত্রলীগ নেতা সৈকতকে বলির পাঠা বানানোর চেষ্টা হিসেবে অস্ত্রগুলো দিয়ে গ্রেপ্তার করান বলে এমন তথ্য উঠে এসেছে। সূত্র মতে, আর এই অস্ত্রগুলো কুমিল্লার প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের লোকজন থেকে কিনে নেন আজাদের ভাই মাসুদ।
এসব তথ্যগুলো পুলিশ রিমান্ডে আনার যথেষ্ট আবশ্যকতা থাকলেও তা উদ্ঘাটন নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায় বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করছে।
সব মিলিয়ে যুবলীগ নেতা জামাল হত্যা মামলার মূল মাস্টারমাইন্ড শেষ পর্যন্ত বিচারের আওতায় পড়বে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন স্থানীয়রা।
গত ৩০ এপ্রিল দাউদকান্দির গৌরীপুর বাজারে যুবলীগ নেতা জামাল হোসেনকে বোরকা পড়ে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ঘটনায় এখন পর্যন্ত আলাদা কয়েকটি অভিযানে একজন শ্যুটারসহ মোট ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র্যাব।
এছাড়া, বিগত ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার কংশনগর এলাকায় দেবিদ্বারের বর কামতা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী, যুবলীগ নেতা হারুনের হাতের আঙ্গুল কেটে ফেলে দেয় এবং পুরো শরীরে রক্তাক্ত আঘাত করে উপজেলা চেয়ারম্যান আজাদের ভাই মাসুদের লোকজন। এই ঘটনায় আহত হারুনের বাবা মো. ইউনুছ মিয়া বাদী হয়ে মো. মাসুদসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন। ওই মামলা কুমিল্লা ডিবি পুলিশ তদন্ত করছে।
সূত্রঃ ইত্তেফাক