কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. আবু জাফর খানসহ সাতজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। গত ২৩ মে দুদকের সেগুনবাগিচার প্রধান কার্যালয়ে দুদক চেয়ারম্যানের কাছে কলেজের শিক্ষক ক্লাব ও আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান শিক্ষা ইউনিট এ অভিযোগ দায়ের করে।
দুই পাতার লিখিত অভিযোগের সঙ্গে ১৪ পাতার প্রমাণপত্র চেয়ারম্যানের কাছে দাখিল করেছেন অভিযোগকারীরা। অতিরিক্ত সংযুক্তিতে, ২০১৬ সালে গণিত বিভাগের প্রধান পদে থাকাকালীন ড. আবু জাফর খানের বিরুদ্ধে ‘প্রাকটিকালের টাকা না দিলে ফেল’ শিরোনামে সংবাদের কাটিং জমা দেওয়া হয়।
অভিযোগে আরও চার শিক্ষকের নাম রয়েছে। তারা হলেন উপাধ্যক্ষ প্রফেসর মৃণাল কান্তি গোস্বামী, সদ্য সাবেক শিক্ষক পরিষদ নেতা ও সমাজকর্ম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈন উদ্দীন, সমাজবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক তপন ভট্টাচার্য। এ ছাড়া অভিযোগপত্রে আরও কলেজের তিনজন কর্মচারীর নাম রয়েছে। তারা হলেন হিসাবরক্ষক সাইফুদ্দিন সুমন, হিসাব সহকারী ইয়াছিন মিয়া, কলেজ এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (সিইডিপি) প্রজেক্টের কম্পিউটার অপারেটর স্বপন কুমার।
মোট ১৪ পাতার প্রমাণপত্র ও দুই পাতার অভিযোগ থেকে জানা যায়, বর্তমান অধ্যক্ষ যোগদানের পর ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কলেজে ৪৩টি ব্যাংক হিসাব থেকে প্রায় ১৩ কোটি টাকার ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে নিজেরাই বিলের বই ছাপিয়েছেন। ব্ল্যাংক বিলে নিজেদের ইচ্ছেমতো টাকা বসান তারা। প্রতিটি প্রোগ্রামে অধ্যক্ষ ৩০ শতাংশ, উপাধ্যক্ষ ১৫ শতাংশ, শিক্ষক পরিষদ সম্পাদক ১৫ শতাংশ, কমিটির সদস্য/পরিষদের সদস্য ৭ দশমিক ৫ শতাংশ কমিশন ভোগ করেন। সরকারি পরিপত্রে অধ্যক্ষ যে কোনো পাবলিক পরীক্ষায় সবোর্চ্চ ১০ হাজার টাকা সম্মানী গ্রহণের কথা থাকলেও ৭০ হাজার থেকে লাখ টাকা না দিলে স্বাক্ষর করেন না অধ্যক্ষ আবু জাফর।
বনবিভাগের ছাড়পত্র না নিয়ে ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সরকারি ফি পরিশোধ না করেই কলেজের ১১টি গাছ কেটে গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উপজেলার ঠাকুরচরে নিয়ে যান এ অধ্যক্ষ।
এ ব্যাপারে কুমিল্লা বন বিভাগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান সহকারী মো. জাকির হোসেন বলেন, আমি নতুন জয়েন করেছি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অর্ধশত বছরের পুরোনো কয়েকটি গাছ কেটে ফেলার ব্যাপারে তারা কিছু জানেন না বলে জানান।
তিনি আরও বলেন, আমি যতটুকু জানি গাছগুলো কাটার ব্যাপারে বন বিভাগের অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের গাছ অপসারণের প্রয়োজন হলে তা প্রথমে বন বিভাগকে লিখিতভাবে জানাতে হয়। বন বিভাগ কাটার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু, তা জানতে সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করে।
কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের তৎকালীন উপপরিচালক শওকত আরা কলি বলেন, সরকারি কলেজের গাছ কাটতে গেলে পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানানোর কথা; কিন্তু কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ প্রশাসন বিষয়টি জানায়নি।
ল্যাবরেটরি ও বিসিসি ল্যাব ফি আদায় হলেও বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবগুলোতে কোনো কেমিক্যাল দেওয়া হয় না। কলেজের ২২টি ডিপার্টমেন্টের শিক্ষা সফরের ফি প্রদানের পর, সে টাকা থেকে ৩০ শতাংশ কর্তন করা হয়। একই সঙ্গে সেমিনারে অধ্যক্ষ প্রায় চাঁদা দাবি করেন। ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে অডিট কাজে ঘুষ প্রদানের নামে ১৮টি ডিপার্টমেন্ট থেকে ৬০ হাজার টাকা গ্রহণ করেছেন অধ্যক্ষ। এ ছাড়াও সেমিনারের বই কেনার ভাউচার করে সে টাকায় পিঠা উৎসব করেছেন তিনি। কলেজের ৩টি মসজিদে মুসল্লিরা জুমার দিন যে টাকা দান করেন তা মসজিদ একাউন্টে জমা দেওয়া হয় না। গত ২৮ বছর ছাত্র সংসদের কার্যক্রম নেই। সরকারি পরিপত্র না মেনে ছাত্র সংসদ, ম্যাগাজিন, আন্তঃক্রীড়াসহ এমন ৯টি হিসাব থেকে কোনো কার্যক্রম না থাকলেও ব্যাংক থেকে অন্য খাত দেখিয়ে টাকা উত্তোলন করা হয়। অধ্যক্ষ জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটির সদস্য হিসেবে অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করেন। দুদকে এমন অভিযোগও করা হয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক প্রফেসর সোমেশ কর চৌধুরী সোমবার (৩ জুন) কালবেলাকে বলেন, দুদক প্রধান কার্যালয়ে আবু জাফর খানকে নিয়ে অভিযোগ সম্পর্কে আমার জানা নেই। আমি বেশ কয়েকজন সাংবাদিকদের কাছে শুনেছি। এ ব্যাপারে এখনো কোনো অভিযোগ পাইনি আমরা।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষক ক্লাবের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা দুদকের ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে কলেজের অধ্যক্ষ সম্পর্কে ১৫টি অভিযোগ দিয়েছি। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অত্যাবশকীয় বাড়তি ফি, পরিবহন খাত এবং ছাত্র সংসদের বেশ কয়েকটি দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে।
২০১৬ সালে আবু জাফর খান যখন গণিত বিভাগের প্রধান ছিলেন তখন ছাত্রদের কাছ থেকে ফরম ফিলাপ বাবদ বিপুল ফি আদায়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান শিক্ষা ইউনিটের এক শিক্ষিকা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রিন্সিপাল স্যার মিটিংয়ে আমাকে অপমান করেছেন। ওনি মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটা আসলে সহ্য করতে পারেন না। আমরা সরকারি চাকরি করি, তাই মিডিয়াতে বেশি কথা বলতে পারি না।
কুমিল্লা কোতোয়ালি থানার ওসি মো. ফিরোজ হোসেন বলেন, এটা তো পুলিশের কাজ নয় তারপরও আমরা লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে রোববার (২ জুন) সন্ধ্যায় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. আবু জাফর খান কালবেলাকে বলেন, দুদক প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ করা হয়েছে কিনা এ বিষয়ে আমার জানা নেই। ২০১৬ সালে স্থানীয় দুটি দৈনিক পত্রিকায় আপনার দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি? উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা আমার মনে নেই।’
মোবাইল: +৮৮০১৭১৭৯৬০০৯৭
ইমেইল: news@dailycomillanews.com
www.dailycomillanews.com