রিকশাচালক থেকে ধনকুবের শ্রমিক লীগ নেতা
ভাগ্য বদলের আশায় প্রায় ৩০ বছর আগে গাজীপুর এসেছিলেন শেরপুরের কামাল হোসেন ওরফে কমল। জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম কামাল হোসেন হলেও সবাই তাকে ডাকেন কমল নামে। কমলের পৈতৃক ভিটা শেরপুরে হলেও গাজীপুরে থাকার সুবাদে ভোটার আইডি কার্ডে ঠিকানা গাজীপুর সিটি করপোরেশন মধ্যপাড়া এলাকায়। গাজীপুরে এসে প্রথমে থাকার জায়গা না থাকলেও এখন তিনি থাকেন নিজস্ব দোতলা বাড়িতে। জীবিকার তাগিদে প্রথমে রিকশা চালালেও পরে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) গাজীপুর সার্কেলে দালালি করে বনে গেছেন বাড়ি, গাড়ি, জমির মালিক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কমল প্রথমে নব্বইয়ের দশকে গাজীপুরে আসেন। তখন গাজীপুর শহরের রথখোলা শহিদ বরকত স্টেডিয়াম এলাকায় থাকতেন তিনি। সেখানে থেকে স্টেডিয়াম সংলগ্ন বাবলার গ্যারেজের রিকশা চালাতেন। পরে সিটি করপোরেশনের ভুরুলিয়া এলাকার কলম খাঁর দ্বিতীয় সংসারের মেয়েকে বিয়ে করেন। ২০০০ সালের দিকে কমল বাসের হেলপারি শুরু করেন। পরে হেলপারি ছেড়ে বাসের কন্টাক্টারি শুরু করেন। কয়েক বছর পর আবার বাসের ড্রাইভার হন। এরপর যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখন ড্রাইভারি ছেড়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে রাজবাড়ী সিএনজি স্ট্যান্ডের সিরিয়াল মাস্টারের দায়িত্ব পালন শুরু করেন। এরপর গাজীপুর মহানগর ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতার সহানুভূতি পেয়ে কমল বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। সে সময় রাজবাড়ী স্ট্যান্ড থেকে সিএনজি অটোরিকশা চালাতে হলে কমলের মাধ্যমে ভর্তি ফি হিসাবে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা দিতে হতো। এছাড়া রাজবাড়ী স্ট্যান্ডের সামনে কেউ ভাসমান দোকান দিতে চাইলেও কমলকে টাকা দিতে হতো। পরিবহণ স্ট্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুবাদে কমল গাজীপুর বিআরটিএ অফিসে যাতায়াত শুরু করেন। এরপর যখন দেখলেন বিআরটিএ অফিসে দালালি করলে আয় আরও বেশি তখন স্ট্যান্ডের দায়িত্ব ছেড়ে বিআরটিএ অফিসে দালালি শুরু করেন। এরপরই ভাগ্য বদলে যায় কমলের। তথ্যসূত্রে জানা যায়, কমলের নামে একটি এলিয়ন গাড়ি (যার রেজিস্ট্রেশন নং ঢাকা মেট্রো গ-৩৬-১০০৪) রয়েছে, যার বাজার মূল্য ৪০ লাখ টাকা। সিএনজি অটোরিকশা রয়েছে আটটি। গাড়ি ছাড়াও কমলের রয়েছে মহানগরীর ভুরুলিয়া এলাকায় একটি দোতলা বাড়ি, যার বর্তমান মূল্য অন্তত ৭০ লাখ টাকা। এছাড়া গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ধীরাশ্রম বাইপাস সড়ক মাই ওয়ান কারখানার লাগোয়া আনুমানিক ৪০ লাখ টাকা মূল্যের তিন কাঠার একটি প্লট রয়েছে কমলের।
আরও জানা যায়, জয়দেবপুর রেলক্রসিং কলাপট্টি সড়কে চলাচল করা কমলের কয়েকটি অটোরিকশা রয়েছে। শুধু বিআরটিএতে দালালি নয়, আ.লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন গাজীপুর সদর মেট্রো থানা শ্রমিক লীগের যুগ্ম সম্পাদক পদও বাগিয়ে নেন। পদ পাওয়ার পর কমল আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বলেন, পদ পাওয়ার পরই কমল শহরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যানার ফেস্টুন টানিয়ে দেন। পদ পাওয়ার পর নিজের নাম এবং ফোন নম্বর দিয়ে ভিজিটিং কার্ড ছাপান কমল। এরপর গাজীপুর বিআরটিএসহ নিজের ভিজিটিং কার্ড বিভিন্ন স্ট্যান্ডের সিএনজি অটোরিকশচালকদের কাছে ছড়িয়ে দেন। পূর্বে স্ট্যান্ডে কাজ করার পরিচিতি এবং শ্রমিক লীগের পদ পাওয়ায় কমলের ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস এবং মালিকানার কাজও বেড়ে যায়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কমল প্রতিদিন গাজীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সোনালী ব্যাংক সংলগ্ন চায়ের দোকানের পাশে অবস্থান করেন। এছাড়া সার্বক্ষণিক গাজীপুর বিআরটিএ অফিস এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রুম দাপিয়ে বেড়ান। প্রতিদিনই দেখা যায় কমল গাড়ির বিভিন্ন কাগজপত্র নিয়ে বিআরটিএ অফিসে যাতায়াত করেন। এছাড়া চায়ের দোকানের পাশেই এসব কাজের লেনদেন করেন। কমলের সিএনজি অটোরিকশার কাগজ করে দেওয়ার একটি ভিডিও এসেছে প্রতিবেদকের কাছে।
ভিডিওতে দেখা যায়, শহরের রাজদীঘি পাড়ে একজন চালকের কাছ থেকে সিএনজি অটোরিকশার কাগজপত্র হাতে নিয়ে দেখছেন। পরে কত টাকায় করবেন সে বিষয়ে ফয়সালা করে কাগজ নিয়ে চলে যান বিআরটিএ অফিসে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরকার পরিবর্তন হলেও কমলের দাপট রয়েছে আগের মতোই। প্রতিদিন বিভিন্ন কাজ নিয়ে কমলের বিআরটিএ অফিসে যাতায়াত চলছেই।
জানতে চাইলে কমল বলেন, ‘আমার ভোটার আইডি কার্ড ব্যবহার করে কিশোরগঞ্জের একজন সিএনজি অটোরিকশার নম্বর করে নিয়ে গেছেন।’
বিপুল সম্পদ থাকার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে তিনি বলেন, শেরপুরে মায়ের জমি বিক্রি করে বাড়ি করেছেন আর ব্যাংক লোন নিয়ে এলিয়েন গাড়ি কিনেছেন।