কালের সাক্ষী কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ
ডেস্ক রিপোর্টঃ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ। শিক্ষানুরাগী রায় বাহাদুর আনন্দ চন্দ্র ১৮৯৯ রানী ভিক্টোরিয়ার নামে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ অবিভক্ত ভারতবর্ষের অন্যতম সুপ্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দেশবিভাগের পূর্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যে কয়টি অ্যাফিলিয়েটেড কলেজ ছিল তার মধ্যে ত্রিপুরা জেলার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ছিল অন্যতম। প্রতিষ্ঠাতা রায় বাহাদুর ঠিকাদার পেশায় যুক্ত থাকলেও ছিলেন শিক্ষা-অনুরাগী। কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি প্রদান করে। তার স্মৃতি রক্ষার্থে ভিক্টোরিয়া কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শাখার প্রধান ফটকে একটি সাদা রঙ্গের ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই নানা বির্বতন ও বিকাশের মধ্য দিয়ে কলেজটি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের একটি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ এর প্রথম অধ্যক্ষ পদে ছিলেন প্রফেসর সতেন্দ্রনাথ বসু এবং বর্তমানে অধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুর রশীদ।
কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় সংলগ্ন রানী দিঘির পাড়স্থ মূল কলেজ (উচ্চ মাধ্যমিক শাখা) থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পশ্চিমে ধর্মপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় ডিগ্রি শাখা। যা ১৯৬২-৬৩ সালে কলেজটি দু’টি শাখায় বিভক্ত করা হয়। কলেজের দু’টি শাখা (উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি শাখা)। পৃথক ক্যাম্পাসে অবস্থিত হলেও তা একই প্রশাসনিক দায়িত্বে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। বর্তমানে এ কলেজে ২০টি বিষয়ে অনার্স এবং ১৭টি বিষয়ে মাস্টার্স প্রথম ও শেষ পর্ব চালু রয়েছে।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নয়, এটি বিগত এক শতাব্দিরও বেশি সময় ধরে বিস্তৃত অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশকে প্রভাবিত ও সমৃদ্ধ করছে। অনেক পণ্ডিত ও দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদগণ এ কলেজের অধ্যক্ষের পদটি অলংকৃত করেছেন। ১৯৫০ সালে অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন সমাজবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. আখতার হামিদ খান। ১৯২৬ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরর পদার্পণে ধন্য হয়েছিল এ কলেজ প্রাঙ্গন। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও যৌবনে অর্থ্যাৎ ১৯২১ সালে এরপর ১৯২৩ সালে সর্বশেষ ১৯২৪ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজ সংলগ্ন রাণীর দিঘির পাড়ে বসে তার অনেক বিখ্যাত কবিতা লিখেছেন। এছাড়াও রচিত হয়েছে অনেক লেখা, চিঠি ও বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন সম্পদ। যা স্বাধীন বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের যুগ যুগ ধরে মুগ্ধ ও আনন্দের খোরাক জুগিয়ে যাবে। যুগ যুগ ধরেই মহা মানবদের পদচারণায় মুখরিত ছিল এবং এখনো তা বিদ্যমান রয়েছে।
কলেজটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৯ হাজার ৯শ’, শিক্ষক পদ সংখ্যা ১৫০ জন, কর্মরত ১৪৫ জন, জমির পরিমাণ ৩২ একর, কর্মচারী সংখ্যা ১৭১ জন, একাডেমিক ভবন ১১টি, প্রশাসনিক ভবন ২টি, হোস্টেল ভবন ১০টি, মসজিদ ভবন ৩টি, অডিটরিয়াম ১টি, শিক্ষক মিলনায়তন ২টি, খেলার মাঠ ২টি, হোস্টেলে সিটের সংখ্যাঃ ছাত্রবাস ৬৩৫টি, ছাত্রীনিবাস ৪০০টি, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ২টি, মাইক্রোবাস ২টি ও বড় বাস ৫টি।
অনুষদ ও বিষয়ঃ কলা অনুষদ- বাংলা, ইংরেজি, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ইতিহাস, দর্শন, আরবী ও ইসলামী শিক্ষা।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ- অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজকর্ম, সমাজবিজ্ঞান।
বিজ্ঞান অনুষদ- পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান, প্রাণিবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, গণিত, পরিসংখ্যান।
ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ- হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, ফিন্যান্স ও মার্কেটিং।
অন্তর্ভুক্ত- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়েব সাইট- www.cvgc.edu.bd
উল্লেখ্য, ১৯৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ২৮ জন শিক্ষার্থী শহীদ হন। শতাব্দীর প্রাচীন দক্ষিণ বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জ্ঞান বিস্তারের পাশাপাশি ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান সহ এদেশের মানুষের প্রতিটি আন্দোলনে একাত্ম হয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের বাণিজ্য অনুষদের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র শহীদ মো. জয়নাল আবেদীন বুকের তাজা রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীনতায় অবদান রেখেছে। বাঙালি জাতিকে পাকহানাদার বাহিনীর এ অমানবিক নির্যাতন, মানুষ হত্যা থেকে উদগীরণ করার জন্য কুমিল্লা শহরের ঢুলি পাড়া গ্রামের সন্তান এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র শহীদ এ.কে.এম. মোজাম্মেল হক মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেন। তিনি পাকহানাদার বাহিনীর হাতে কসবা থানার চারগাছ নামক স্থানে ১৯৭১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভোর রাতে শহীদ হন। কুমিল্লা জেলার নৈয়রা গ্রামের সস্তান এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র শহীদ আবু তাহের কুমিল্লা কোতয়ালি থানার ভারত পাকিস্তান সীমান্ত এলাকায় হানাদার বাহিনীর বুলেটের আঘাতে শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ২৮ জন ছাত্র পাকহানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হলেও বর্তমান প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রীরা এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কিছুই জানে না এবং কর্তৃপক্ষ এমন কোনো স্মৃতির অ্যালবামও রাখেনি যাতে এই বীর সেনানিদের জীবনী জানতে পারবে। এই ২৮ জন বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পুরো জীবনী সংরক্ষণ করার জন্য তাই কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে আকুল আবেদন। যাতে করে তারা চিরস্মরণী ও বরণী হয়ে থাকে ভিক্টোরিয়া কলেজের সব নবীন প্রবীণ প্রাক্তন ছাত্রসহ আগামী দিনের আলোকিত ছাত্র-ছাত্রীদের হৃদয়ে স্থান পায় এবং তারা যে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনকাহিনী থেকে দেশ প্রেমের অনুপ্রেরণা পায়।