ভালো বেতনে আরামের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে আর্থিক প্রতারণা ও মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রবিজুল ইসলামকে (৪২) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
আজ রবিবার (২০ জুলাই) সকালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করেছে। তার বিরুদ্ধে মানবপাচার ও আর্থিক প্রতারণার বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ইবি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান।
গ্রেপ্তার রবিজুল ইসলাম কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ইবি থানার পাটিকাবাড়ী ইউনিয়নের পাটিকাবাড়ী গ্রামের মিয়াপাড়ার আয়নাল মণ্ডলের ছেলে। সাতজন নারীকে বিয়ে করা ও একসঙ্গে ঘর-সংসার করায় রবিজুল ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত ছিলেন।
পুলিশ জানায়, রবিজুল ১৫ বছর লিবিয়ায় ছিলেন। তিনি মানবপাচার চক্রের সদস্য। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছেন তিনি। বিদেশে ভালো বেতনে চাকরির কথা বলে লিবিয়ায় পাঠিয়ে মানুষকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিদেশে পাঠানোর নামে প্রতারণার শিকার বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগ ও মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রবিজুলের প্রলোভনে পড়ে ভালো বেতনে চাকরির জন্য লিবিয়ায় যান কুষ্টিয়ার তানজির শেখ (২২)। এরপর লিবিয়ার মানবপাচার চক্রের কাছে তাকে বিক্রি করে দেন রবিজুল। লিবিয়ায় মানবপাচার চক্রের টর্চার সেলে দীর্ঘ ৯ মাস বন্দি করে রাখা হয়। তখন বিবস্ত্র করে বেধড়ক মারধরের ভিডিও পরিবারকে পাঠিয়ে মুক্তিপণ দাবি করা হতো। অবশেষে মুক্তিপণ নিয়ে তানজিরকে ছেড়ে দিয়েছে মানবপাচার চক্র। গত ৯ জুলাই দেশে ফিরেছেন তানজির শেখ।
তানজির কুষ্টিয়া পৌরসভার ২০ নম্বর ওয়ার্ডের জগতী স্টেশন বাজার এলাকার সিরাজ শেখের ছেলে। আড়াই বছর আগে কুষ্টিয়ার রবিজুল দালালের মাধ্যমে ট্যুরিস্ট ভিসায় লিবিয়ায় গিয়েছিলেন তিনি। ভুক্তভোগী পরিবারের কাছে থেকে দফায় দফায় ৩৪ লাখ টাকা নিয়েছেন রবিজুল। সেসব টাকা ফেরত ও রবিজুলের শাস্তি দাবি করেছে ভুক্তভোগী পরিবার।
লিবিয়ায় দীর্ঘ ৯ মাস বন্দিশালায় নির্যাতনের শিকার তানজির শেখ বলেন, ‘রবিজুল লিবিয়াতে দীর্ঘ ১২ বছর ছিলেন। মাফিয়া চক্রের সাথে রবিজুলের সুসম্পর্ক। আমার বাবা রবিজুলের মাধ্যমে আমাকে লিবিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার পর মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেন রবিজুল। মুক্তিপণের দাবিতে আমাকে তারা ৯ মাস বন্দি করে রেখেছিল। বেঁধে রাখত, তিন বেলা রড ও লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটানো হতো। খাবার দিত না, তিন বেলা শুধু মারত। মারতে মারতে শরীর ফাটিয়ে ফেলত। ক্ষত জায়গায় ইনফেকশন হয়ে পচে যেত। কোনো ওষুধ দিত না। ভাত দিত না। সারা দিনে ৫ টাকা দামের একটা পাউরুটি ও অল্প একটু লবণাক্ত পানি খেতে দিত। লবণাক্ত পানি খাওয়ার কারণে শরীর আরো বেশি পচে যেত। না খাওয়ার কারণে শরীর একদম শুকিয়ে যায়। সব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে যায়। এ জন্য মার খাইতে খাইতে অনেকে মরে যায়। মনে হতো আমিও মারা যাব। রবিজুল দালালের খপ্পরে পড়ে আমি মরতে বসেছিলাম। রবিজুল আমাদের কাছে থেকে ৩৪ লাখ টাকা নিয়েছেন। আমি টাকা ফেরত চাই, একই সাথে রবিজুলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
এই চক্র সম্পর্কে তানজির আরো বলেন, লিবিয়ার ওই মাফিয়া চক্রে ১৫-২০ জন সদস্য রয়েছে। তাদের মধ্যে ৫-৭ জন লিবিয়ার নাগরিক। প্রধান মাফিয়া লিবিয়ার আলী। তিনি ওসামার ভাগ্নে বলে পরিচিত। মাফিয়া চক্রের সাথে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন যুক্ত আছে। তাদের বাড়ি মাদারীপুর, সিলেট ও শরীয়তপুর। তাদের মধ্যে একজনের নাম পিচ্চি সোহেল, তার বাড়ি মাদারীপুর আর কুষ্টিয়ার রবিজুল।
তানজিরের বাবা সিরাজ শেখ বলেন, ‘ভালো চাকরি ও ভালো বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে আমার ছেলেকে লিবিয়ায় পাঠায় রবিজুল। তার সাথে ১১ লাখ টাকার চুক্তি ছিল। প্রথমে ৫ লাখ টাকা দিই, এরপর আমার ছেলেকে লিবিয়াই পাঠিয়ে দেয়। এরপর বাকি ৬ লাখ টাকা পরিশোধ করি। এরপর ইতালি পাঠানোর কথা বলে আমার ছেলেকে মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। ছেলে বন্দি থাকা অবস্থায় রবিজুল আরো ২৫ লাখ টাকা দাবি করে। এর কিছুদিন পর রবিজুল বাড়ি থেকে পালিয়ে আত্মগোপনে যায়। এরপর নলখোলা গ্রামের আলামিন নামে একজন আমাদের সাথে যোগাযোগ করে এবং আমার ছেলেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করবে বলে প্রলোভন দেয়। সে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা নেয়। এতে কোনো কাজই হয়নি। এরপর মাফিয়াদের পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে আমি আমার ছেলেকে ছাড়িয়ে এনেছি। রবিজুল ও আলামিনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। একই সাথে আমি আমার টাকা ফেরত পেতে চাই।’
তানজিরের মতো অসংখ্য মানুষের সাথে প্রতারণা করে টাকা হাতি নেন রবিজুল। তার গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে ভুক্তভোগী ১২টি পরিবারের লোকজন ইবি থানায় এসেছেন। তাদের মধ্যে মাহাবুল আলম নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমার ভাগিনা আসিফকে সাড়ে ১৫ লাখ টাকায় ইতালিতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে যায় রবিজুল। সেখানে নির্যাতন করে মুক্তিপণ নিয়ে আবার দেশে ফেরত পাঠায়। রবিজুল ৬০ থেকে ৭০ জনের সাথে এমন প্রতারণা করেছে। প্রতারণার শিকার প্রত্যেকের আত্মীয়স্বজন থানায় ভিড় জমাচ্ছেন। আরো অনেক ভুক্তভোগী আসছেন।’
বিষয়টি নিশ্চিত করে ইবি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান বলেন, ‘লিবিয়ায় ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দিয়ে আর্থিক প্রতারণা ও মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রবিজুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। আর্থিক প্রতারণা ও মানবপাচারের অভিযোগে দেশের বিভিন্ন থানায় তার নামে মামলা রয়েছে। ইবি ও সদর থানায় ৫-৬টি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া আলমডাঙ্গা, কুমারখালীসহ বিভিন্ন থানায় মামলা রয়েছে। সব অভিযোগ আমরা তদন্ত করে দেখছি। তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
মোবাইল: +৮৮০১৭১৭৯৬০০৯৭
ইমেইল: news@dailycomillanews.com
www.dailycomillanews.com