গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে ভারত সরকার। প্রায় এক বছর ধরে চলমান এ পরিস্থিতিতে রীতিমত ধস নেমেছে কলকাতার পর্যটননির্ভর অর্থনীতিতে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ‘মিনি বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত নিউ মার্কেট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট এবং মারকুইস স্ট্রিট সংলগ্ন অঞ্চলটি। শুধু এই এলাকাতেই ১ হাজার কোটি রুপি আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। আর সামগ্রিকভাবে ব্যবসায়িক এ ক্ষতি ছুঁয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি রুপি।
সম্প্রতি এমনই তথ্য প্রকাশ করেছে ভারতের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের জুলাইয়ে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কে শুরু হয় টানাপোড়েন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। যদিও খুব সীমিত পরিসরে এখনো কিছু জরুরি ক্ষেত্রে ভিসা দেওয়া হচ্ছে, তবে সেটা খুব নগণ্য।
করোনাকালের ক্ষতি কাটিয়ে যখনই কলকাতার পর্যটন খাত কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল, তখনই এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা নতুন করে বড় আঘাত হানে অর্থনীতিতে। এক বছর আগেও যেসব রাস্তাঘাট ছিল বাংলাদেশি পর্যটকে মুখর, আজ সেগুলো সব প্রায় জনশূন্য। কম খরচে থাকার হোটেল, ওপার বাংলার স্বাদবহুল খাবার এবং নিকটস্থ হাসপাতালের জন্য বিখ্যাত এই এলাকাগুলো পর্যটকদের অভাবে এখন নিস্তব্ধ।
কলকাতার ব্যবসায়ীদের সংগঠন ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন জানায়, পর্যটন, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ট্র্যাভেল এজেন্সি, মানি এক্সচেঞ্জ, চিকিৎসা সেবা এবং পরিবহন—সব মিলিয়ে এই অঞ্চলে প্রতিদিন প্রায় ৩ কোটি রুপির লেনদেন হতো। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হায়দার আলী খান বলেন, শুধু নিউ মার্কেট ও বড়বাজার অঞ্চল যুক্ত করলে এই ক্ষতির পরিমাণ ৫ হাজার কোটি রুপি ছাড়িয়ে যাবে।
পর্যটকের অভাবে বর্তমানে কলকাতায় অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। আর যারা টিকে আছে, তারাও বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে। স্থানীয় এক ট্র্যাভেল কোম্পানির ব্যবস্থাপক প্রবীর বিশ্বাস বলেন, আগে দিনের মধ্যেই একাধিক বাসভর্তি পর্যটক আসত, এখন অনেক দিন একটিও দেখা যায় না।
মুখ থুবড়ে পড়েছে মুদ্রা বিনিময়ের ব্যবসাও। মারকুইস স্ট্রিটের কারেন্সি এক্সচেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন–এর সম্পাদক মোহাম্মদ ইন্তেজার বলেন, আমরা সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশি পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। এখন টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
বেশ কিছু ছোট ও মাঝারি রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে। বড় রেস্তোরাঁগুলোর ব্যবসাও অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। রাঁধুনি রেস্তোরাঁর মালিক এন সি ভৌমিক বলেন, আমাদের আয় মাত্র ২০ শতাংশে এসে ঠেকেছে। এই অবস্থা বেশিদিন চললে আমাদের টিকে থাকাও অসম্ভব হয়ে পড়বে।
শুধু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই নয়, পর্যটননির্ভর অনেক অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষের জীবনেও আঘাত হেনেছে প্রায় এক বছর ধরে চলা এই ভিসা সংকট। হোটেল কর্মী, গাইড, রাঁধুনি, গাড়িচালক থেকে শুরু করে হোম-স্টে অপারেটররাও উপার্জন হারিয়ে দিশেহারা। এলিয়ট রোডের বাসিন্দা ফারহান রসুল বলেন, কোভিড পরবর্তী চাহিদা দেখে আমি দুটি গাড়িতে বিনিয়োগ করেছিলাম। মাসে এখন পাঁচ-ছয়জনের বেশি বুকিং হয় না। অথচ প্রতি মাসে আমাকে দেড় লাখ রুপি কিস্তি পরিশোধ করতে হয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মহামারি-পরবর্তী ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই আবারও এমন সংকট তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাকেই কঠিন করে তুলেছে। দ্রুত পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের আশায় প্রহর গুনছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা।
মোবাইল: +৮৮০১৭১৭৯৬০০৯৭
ইমেইল: news@dailycomillanews.com
www.dailycomillanews.com