‘চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহন’ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ডিপোর সব কার্যক্রম হবে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়। তেল গ্রহণ থেকে বিতরণ পর্যন্ত কোনো হাতের স্পর্শ থাকবে না। এতে ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাধুনিক পিএলসি সিস্টেম প্রযুক্তি, যা দেশের পেট্রোলিয়াম জ্বালানি খাতে নতুন মাইলফলক হিসেবে গণ্য হবে। নতুন ডিপোর চালু হওয়ার সঙ্গে বিপিসির পেট্রোলিয়াম জ্বালানি বিপণন নেটওয়ার্কে ডিপোর সংখ্যা বেড়ে ২৮ হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন ডিপোতে বিপিসির তিনটি বিপণন প্রতিষ্ঠান—পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল পিএলসি—নিজ নিজ ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটরের মধ্যে ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেন সরবরাহ করবে। পুরো ডিপো তত্ত্বাবধান করবে পদ্মা অয়েল পিএলসি।
চট্টগ্রামের প্রধান স্থাপনা থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল নেবে ডিপোটি। এটি কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও নোয়াখালিসহ চার জেলায় তেল সরবরাহ করবে। এতে স্থানীয় জ্বালানি সরবরাহে সময় ও খরচ দুটোই কমবে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে তেল চুরি ও অনিয়মের মতো সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আসবে।
সূত্র জানায়, ডিপোটি কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে কুমিল্লা-চাঁদপুর মহাসড়কের পাশে বরুড়া উপজেলার মগবাড়িতে অবস্থিত। ১৬ দশমিক ১৬৪ একর জায়গাজুড়ে ডিপোটি চট্টগ্রাম-ঢাকা পাইপলাইনের ইন্টারমিডিয়েট পিগিং স্টেশন থেকে ৪৬৫ মিটার দূরে নির্মাণ করা হয়েছে। ডিপোটি ১০ ইঞ্চি পাইপের মাধ্যমে মূল পাইপলাইনের সঙ্গে সংযুক্ত। প্রাথমিকভাবে পিগিং স্টেশন থেকে চাঁদপুরে পাইপলাইন নেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও পরবর্তীতে বর্তমান অবস্থানে ডিপো নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ডিপোটিতে ১৯,৩০০ মেট্রিক টন ডিজেল, ১,৫০০ মেট্রিক টন পেট্রোল ও ১,৫০০ মেট্রিক টন অকটেন সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এজন্য ছয়টি ডিজেল ট্যাংক, ছয়টি ডিজেল সার্ভিস ট্যাংক, তিনটি পেট্রোল ট্যাংক ও তিনটি অকটেন ট্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। প্রত্যেক কোম্পানি দুটি ডিজেল ট্যাংক, একটি ডিজেল সার্ভিস ট্যাংক এবং একটি করে পেট্রোল ও অকটেন ট্যাংক ব্যবহার করবে।
কুমিল্লায় দেশসেরা স্বয়ংক্রিয় জ্বালানি ডিপো:
ডিপোটিতে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আধুনিক ফায়ার সেফটি সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। এতে রয়েছে ফায়ার ডিটেকশন, ফায়ার অ্যালার্ম, ফায়ার ওয়াটার ও ফোম সাপ্রেশন সিস্টেম। পাশাপাশি সার্বক্ষণিক নজরদারির জন্য ৩০টি উচ্চ ক্ষমতার সিসিটিভি সংযুক্ত করা হয়েছে।
পদ্মা অয়েল পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মফিজুর রহমান জানিয়েছেন, “এই ডিপোর কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে বিপিসির ইতিহাসে নতুন একটি মাইলফলক তৈরি হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করবে নিরাপদ ও দ্রুত তেল সরবরাহ।” বিশ্লেষকরা মনে করেন, ডিপোটি কেবল অপারেশনকে স্বয়ংক্রিয় করবে না, বরং তেলের চুরি ও অনিয়মের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং মনিটরিং সিস্টেমের কারণে যেকোনো দুর্ঘটনা বা জরুরি পরিস্থিতিতেও দ্রুত প্রতিক্রিয়া সম্ভব হবে।
কুমিল্লার নতুন অটোমেটেড পেট্রোলিয়াম ডিপো দেশের পেট্রোলিয়াম খাতে প্রযুক্তির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ডিপোতে তেলের অপারেশন, সংরক্ষণ ও বিতরণ সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হবে। ডিপোতে রয়েছে একটি প্রশাসনিক ভবন, যেখান থেকে তিনটি বিপণন কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালিত হবে। পাশাপাশি কন্ট্রোল বিল্ডিং, গার্ড রুম, ৫০০ কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন, ৪০ কিলোওয়াট ক্ষমতার সৌর বিদ্যুৎ প্যানেল এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৫০০ কেভি ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর রয়েছে।
তেলের সরাসরি ব্যবস্থাপনার জন্য ডিপোতে রয়েছে লুব গোডাউন, মেনটেন্যান্স রুম, পাম্প হাউজ (যেখানে ২১টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে), ৪০টি ট্যাংকলরি পার্কিং এলাকা এবং ১২টি আধুনিক লোডিং-বে সম্পন্ন ফিলিং পয়েন্ট। ডিপোর প্রযুক্তি অংশে সংযোজন করা হয়েছে পিএলসি (প্রোগ্রামেবল লজিক কন্ট্রোলার) সিস্টেম। এটি জ্বালানি তেলের সংরক্ষণ, পরিবহন, পরিমাপ ও সরবরাহ প্রক্রিয়া নিরাপদ ও নির্ভুলভাবে পরিচালনা করে। পিএলসি সিস্টেমের মাধ্যমে ব্যবহার করা হচ্ছে ট্যাংক ফার্ম ম্যানেজমেন্ট, লোডিং-আনলোডিং সফটওয়্যার, কিউ ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার, অ্যাক্সেস কন্ট্রোল এবং ব্যাচ কন্ট্রোলড ফ্লো-মিটার।
পিএলসি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাম্প চালু ও বন্ধ করে, ট্যাংকের লেভেল কন্ট্রোল করে, তেলের উচ্চতা পর্যবেক্ষণ করে এবং ওভারফ্লো বা লিকেজ হলে অ্যালার্ম দেয়। ইনলেট ও আউটলেট ভাল্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ হয়। আগুন, অতিরিক্ত চাপ বা কোনো ত্রুটি ধরা পড়লে সিস্টেম নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। তেল গ্রহণ ও সরবরাহের তথ্য স্কাডা সিস্টেমে রিয়েল টাইমে প্রদর্শিত হয়। ফলে কন্ট্রোলরুমে বসেই তেলের গ্রহণ ও বিপণন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ট্যাংকের অবস্থান, তাপমাত্রা ও তেলের পরিমাণ রাডার গেজ ও সেন্সরের মাধ্যমে তৎক্ষণিক জানা যায়। এতে অপচয় রোধ হয়, দুর্ঘটনা ও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমে যায় এবং ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন মনিটরিং সম্ভব হয়।
প্রযুক্তি ও গ্রাহক সুবিধায় নতুন যুগ:
ডিপোতে গ্রাহকদের সুবিধার্থে আরএফআইডি (রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন) কার্ড ব্যবহার করা হবে। ডিলাররা পে-অর্ডারের বিপরীতে ইউনিক আরএফআইডি কার্ড পাবেন। ওই কার্ড নির্ধারিত মেশিনে প্রদর্শন করে ট্যাংক-লরি ডিপোতে প্রবেশ করবে। ব্যাচ কন্ট্রোলারের মাধ্যমে তেল গ্রহণ করা হবে, যা পুরো প্রক্রিয়াকে নিরাপদ ও স্বয়ংক্রিয় করে।
ডিপোর মাধ্যমে কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, ফতুল্লা এবং কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় দ্রুত এবং নিরবিচ্ছিন্ন তেল সরবরাহ সম্ভব হবে। আগে বৃহত্তর কুমিল্লার ফিলিং স্টেশনগুলোকে চাঁদপুর, ফতুল্লা-গোদনাইল থেকে তেল সংগ্রহ করতে হতো, যা সময়, শ্রম এবং খরচ বাড়াত। কুমিল্লা ডিপো স্থাপনের ফলে যানজট, টোল খরচ এবং সময়ের উল্লেখযোগ্য সাশ্রয় হবে।
পদ্মা অয়েল পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মফিজুর রহমান জানিয়েছেন, “চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইন প্রকল্পের আওতায় কুমিল্লা ডিপো নির্মাণ করা হয়েছে। এটি দেশের প্রথম অটোমেটেড পেট্রোলিয়াম ডিপো। প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিপোর অপারেশন কার্যক্রম সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হবে। ধীরে ধীরে সারাদেশে পেট্রোলিয়াম অপারেশন অটোমেশনের আওতায় আনা হবে।” ডিপোর মাধ্যমে বছরে ৫০ লাখ টন জ্বালানি তেল সরবরাহের সক্ষমতা অর্জন সম্ভব হবে। এটি তেলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, পরিবহনের সিস্টেম লস কমাবে এবং নৌপথে তেল পরিবহনের বিপুল খরচ সাশ্রয় করবে। দ্রুততম সময়ে তেল পৌঁছানোর জন্য চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার ফতুল্লা পর্যন্ত আড়াইশ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রকল্পটির ইতিহাস দীর্ঘ। ‘চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহন’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৫ সালের জুনে সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করে বিপিসি। পরের বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেডকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে একনেক অনুমোদন দেয়। ২০১৭ সালের ২৯ নভেম্বর প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল দুই হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের সময় বহুমাত্রিক জটিলতা এবং প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের বাধার কারণে ডিপিপি সংশোধন করা হয়। সবশেষ পদ্মা অয়েল কোম্পানির তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন হয় এবং মোট ব্যয় নির্ধারিত হয় তিন হাজার ৬৯৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কুমিল্লা ডিপো শুধুমাত্র স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির উদাহরণ নয়, এটি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা, সরবরাহের নির্ভরযোগ্যতা এবং গ্রাহক সুবিধার ক্ষেত্রে একটি নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে।
মোবাইল: +৮৮০১৭১৭৯৬০০৯৭
ইমেইল: news@dailycomillanews.com
www.dailycomillanews.com