মো. জাকির হোসেনঃ কুমিল্লার ঐতিহাসিক লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ে আবিস্কৃত শালবন বৌদ্ধ বিহার ও রানী ময়নামতি প্রাসাদের খননকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শণ সংরক্ষণ প্রকল্পের অধীনে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলছে ।
অভিযোগ উঠেছে এসকল বিশেষায়িত কাজ করার সময় কর্মস্থলে প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের সার্বক্ষনিক উপস্থিতির কথা থাকলেও অজ্ঞাত কারণে এক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হচ্ছেনা। ফলে দেখা গেছে দিনভর শ্রমিকরা কাজ করছে। নেই কোন প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বা ঠিকাদারের দায়িত্বশীল লোকজনও।
সরেজমিন ঘুরে বিভিন্ন সুত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়,দেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহাসিক সভ্যতার নিদর্শন রয়েছে কুমিল্লার লালমাই-ময়নামতি পাহাড় এলাকায়। ৮ম থেকে ১২তম শতাব্দির বহু নির্দশন রয়েছে এই পাহাড়ের বিভিন্নস্থান জুড়ে। বিগত শতাব্দির ৫০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই পাহাড়ের বিভিন্নস্থানে খনন শুরু করে। এতে আবিস্কৃত হয়েছিল প্রায় ৫০টি ঐতিহাসিক নিদর্শন। তবে ২৫টি নিদর্শন অক্ষত থাকলেও বাকীগুলো ধ্বংসের কারণে খননের আশা ছেড়ে দেয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। প্রায় ২১ কিলোমিটার উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত ও আড়াই থেকে দেড় কিলোমিটার প্রস্থের এই পাহাড়ের বিভিন্নস্থানে সর্বপ্রথম ১৯৫৫ সালে খনন হয় শালবন বৌদ্ধ বিহার এলাকায়। সেখানে আবিস্কৃত হয়েছে ৮ম থেকে ১২তম শতাব্দির স্থাপনা। উদ্ধার হয়েছে বিভিন্ন প্রাচীন নিদর্শন,পোড়ামাটির চিত্র ফলক,স্বর্ণ মুদ্রাসহ অনেক কিছু। এরপর একে একে আবস্কিৃত হয়েছে কোটিলা মুড়া, ইটাখোলা মুড়া,রূপবান মুড়া,চন্ডিমুড়া,ভোজবিহার,আনন্দ বিহার,রানী ময়নামতি প্রাসাদ,লতিকোট মুড়া,চারপত্রমুড়াসহ ১৩ টি নিদর্শন। যা এরই মাঝে খনন হয়েছে ব্যাপকভাবে কিছু কিছু স্থানে এখনো চলছে খননসহ সংস্কার কাজ। প্রতিদিন দেশ-বিদেশের অসংখ্য ভ্রমণকারী আসেন ঐতিহাসিক এসব নিদর্শন দেখতে। রাজস্ব হিসেবে প্রতিবছর সরকারের আয় হচ্ছে কোটি টাকা।
সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর শালবন বৌদ্ধবিহার,ভোজবিহার,আনন্দ বিহার ও রানী ময়নামতি প্রাসাদ এলাকায় খননে উম্মোচিত অংশ সংস্কারের কাজ শুরু করে। দায়িত্বশীল সুত্র মতে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারী থেকে চলছে এই সংস্কারের কাজ। এরমাঝে রানী ময়নামতি প্রাসাদ এলাকায় সীমানা প্রাচীর ছাড়াও ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে খননের ফলে আবিস্কৃত গোপন রাস্তা, প্রথম নির্মান যুগের ৫টি দেয়াল ও পরবর্তীতে দ্বিতীয়,৩য় ও ৪র্থ নির্মান যুগের প্রাচীরগুলোর সংস্কার কাজ হচ্ছে। একইসাথে চলছে শালবন বৌদ্ধ বিহারের খননের ফলে আবিস্কৃত হওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সংস্কারের কাজ।
সরেজমিন ময়নামতি রানী প্রাসাদ ও শালবন বৌদ্ধ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে শুধুমাত্র শ্রমিকরা কাজ করছে। ময়নামতি রানী প্রাসাদ এলাকায় কর্মরত শ্রমিকদেও সাথে কথা বলে জানা যায়, দৈনিক মুজুরীর ভিত্তিতে তারা একাজ করছেন। তারা আরো বলেন,আমাদেরকে এসে কাজ করার নির্দেশনা দিয়ে অফিসাররা চলে যান। আমরা সকাল ৮ টায় কর্মস্থলে এসে ৯ টা পর্যন্ত কাজ করি। এরপর ১ ঘন্টা টিফিন পরবর্তীতে দুপুরে ১ টায় আবারো এক ঘন্টার বিরতি। এরবাইরে ৮ ঘন্টা কাজ করতে হয়।
শ্রমিকরা জানান, এখানে ঠিকাদারের লোকজন থাকার কথা থাকলেও অধিকাংশ সময় তারা এখানে থাকেন না। সরেজমিন ঘুরে কর্মকর্তা বা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল লোকজনের অনপুস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। সেখানে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও দেখা মিলেনি কোন প্রত্নতাত্ত্বিক বা সংশ্লিষ্ট কাজের ঠিকাদারের কোন দায়িত্বশীল লোকজনদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুত্র জানায়, এই সংস্কার কাজে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২জন শিক্ষার্থীর কথা শোনা গেলেও সংস্কার কাজ স্থলে তাদেরও দেখা মিলেনি।
প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের বিভিন্নস্থানে। এই পাহাড়ের সর্ব দক্ষিনের পাহাড় চূড়ায় আছে চন্ডিমুড়া আর সর্ব উত্তরের জনপদ ময়নামতিতে আছে রানী ময়নামতির প্রাসাদ। ইতিহাসবিদদের ধারণা ৮ম থেকে ১২তম শতাব্দির এই সকল স্থাপনা দেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন। সম্প্রতিক সময়ে রানী ময়নামতি প্রাসাদ এলাকায় দু’দফা খনন কাজ হয় । এসময় উত্তর পশ্চিম কোনে আবিস্কৃত হয় একটি গুপ্ত পথ। এছাড়াও বেশ কিছু মাটির তৈরী পাত্রের ভগ্নাংশ। সর্বশেষ গত ২৮ ফেব্রুয়ারী শালবন বৌদ্ধ বিহার,ভোজবিহার ,আনন্দ বিহার ও রানী ময়নামতি প্রাসাদের খনন কাজে উন্মোচিত নিদর্শনের সংস্কারে হাত দেয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।
ঢাকার নিকুঞ্জ খিলক্ষেত এলাকার মেসার্স ঢালী কনষ্ট্রাকশন নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অধীনে এখানে কাজ চলছে। তবে ঘটনাস্থলে গিয়ে ঠিকাদারের কোন দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যায়নি। এব্যাপারে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন উজ্জল এর সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান,আমি কয়েকদিন হলো এসেছি। এছাড়া কর্মস্থলে অনপুস্থিতির বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন। শনিবার দুপুরে ময়নামতি রানী প্রাসাদ ও শালবন বৌদ্ধ বিহার এলাকায় গিয়েও তেমনি কাউকে পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শালবন বৌদ্ধ বিহার সংস্কাওে নিয়োজিত একাধিক শ্রমিক জানান,বৃষ্টির জন্য শনিবার কোন কাজ হয়নি। এসময় তারা আরো বলেন,মোবাইল ফোনে ঠিকাদারের লোকজন তাদের কাজ করতে নিষেধ করায় এটা হয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের কাজে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের উপস্থিতির প্রয়োজন থাকলেও লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের শালবন বৌদ্ধ বিহার ,রানী ময়নামতি প্রাসাদ এলাকায় সংশ্লিষ্টদেও না থাকায় কাজের মান নিয়েও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল একটি সুত্র প্রশ্ন তুলেছেন।
তবে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও বর্তমান উন্মোচিত খননের সংস্কার কাজে বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্বপালন করা ড. সফিকুল আলম জানান,আমার কাজে সরকার ভরসা করার কারণেই চাকুরী শেষে আবারো এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের দেখভালোর দায়িত্ব দিয়েছেন। এখানে কোনই অনিয়ম হচ্ছেনা। যদি সুনির্দিষ্ট অনিয়মের কোন অভিযোগ থাকে তবে আমাদে জানালে সেটার ব্যবস্থা গ্রহন করবো।
উল্লেখ্য শালবন বৌদ্ধ বিহার,রানী ময়নামতি প্রাসাদ,আনন্দ বিহার ও ভোজবিহারের বর্তমানে সংস্কার কাজ হচ্ছে। তার মাঝে আনন্দ ও ভোজ বিহার দুটি ময়নামতি সেনানিবাস এলাকায় অবস্থানের কারণে সেটা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত না হওয়ায় এসংক্রান্তে কোন তথ্য জানা সম্ভব হয়নি।
মোবাইল: +৮৮০১৭১৭৯৬০০৯৭
ইমেইল: news@dailycomillanews.com
www.dailycomillanews.com