কুমিল্লা মুরাদনগরের ঐতিহাসিক জাহাপুর জমিদার বাড়ি

মমিনুল ইসলাম মোল্লাঃ হাতিশালায় হাতি নেই, আস্তাবলে ঘোড়া নেই, সিংহ দরজায় সিংহ নেই দালানগুলোই শুধু স্মৃতি বহন করছে ৪০০ বছর আগের এ জমিদার বাড়িটির। কুমিল্লার মুরাদনগরের জাহাপুরে এর অবস্থান। গোমতি বিধৌত এ জাহাপুর। গোমতির কল কল ঢেউয়ের তালে তালে এক সময় বয়ে চলত জমিদারদের ‘গয়না’ নৌকা।তাদের ব্যাপারে বাংলার বার ভূঁইয়ার একভূইয়া কেঁদার রায় নাকি বলেছিলেন, মেঘনার পূর্ব পাড়ে কোন বড় জমিদার নেই। শাকের মধ্যে লবণতুল্য আছে জাহাপুরের জমিদাররা।

কি কি দেখবেনঃ
জমিদার বাড়িতে পৌঁছেই দেখবেন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে দুটি সিংহ। তারা আপনাকে এ বাড়িতে নিঃশব্দে স্বাগত জানাবে। প্রধান ফটকে সবসময় দু’জন রক্ষী থাকত। জমিদারি আমলে এলে পরিচয় দিয়ে ঢুকতে হতো।এখন আর সেদিন নেই। রাইফেল অথবা তীর-ধনুক হাতে মাথায় পাগড়ি নিয়ে কোন শিখকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবেন না। বহিরাঙ্গন এবং অন্দরমহল তারাই দেখতেন। আপনাকে মূল গেটে দেখে হয়তো কেউ এগিয়ে আসবেন। তিনি আপনাকে মূল বাড়িতে নিয়ে যাবেন।

প্রথম বিল্ডিংটি তিন তলা। পুরোটাই ইট-সুরকি দিয়ে নির্মিত। এরকম আরও ৯টি বিল্ডিং ছিল। ২টি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু জড়াজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বাকিগুলো ভালো। প্রথমটি বাদে বাকি সবগুলো দোতলা। প্রধান গেট দিয়ে প্রবেশ করেই একটি মন্দির দেখতে পাবেন।এটি নাট মন্দির। দুর্গা পূজার সময় এখানে ভক্তরা সমবেত হন। পাশেই রয়েছে দুর্গাদেবীর প্রতিমা। প্রতিমাটি স্থায়ীভাবে নির্মাণ করা হয়েছে।

এখান থেকে সোজা চলে যাবেন অন্দর মহলে। এ মহলেই বর্তমান বংশধররা বসবাস করছে। এখানে দেখা হবে ১১তম বংশধর শ্রী আশীষ কুমার রায়, সমরেন্দ্র রায় ও অজিত কুমার রায়ের সঙ্গে। এছাড়া রয়েছেন প্রফেসর অঞ্জন কুমার রায়, অধ্যক্ষ রঞ্জন কুমার রায় ও তাদের পরিবারবর্গ। তারাই বর্তমানে এ বিশাল বাড়িটি দেখাশোনা করছেন। জমিদারদের আরও ২টি পরিবার এখানে বসবাস করছে। তবে ওই পরিবারগুলোর অধিকাংশ সদস্যই জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করছেন। তাই তাদের কারও সঙ্গে আপনার দেখা নাও হতে পারে। আপনার চোখের সামনের ভবনটির দরজার ওপরে খোদাই করা লেখা ‘১৩৩৪ বঙ্গাব্দ’ দেখবেন। এটি তৈরি করেছন অঞ্জন কুমার রায়ের দাদা অশ্বিনী কুমার রায়। এটি জমিদার বাড়ির সর্বশেষ ভবন। এর সামনে প্রশস্ত বারান্দা রয়েছে। ফ্লোর থেকে ছাদের উচ্চতা ১৪ ফুট। ছাদের নিচের অংশে কাঠের এবং লোহার তৈরি কারুকার্যময় সিলিং দেখতে পাবেন। দোতলায় ওঠার জন্য সরু সিঁড়ি দেখতে পাবেন।একটু ওঠে মাঝখানে দাঁড়াবেন। দোতলায় ৮ থেকে ১০টি কক্ষ। ইচ্ছে করলে ছাদ থেকে প্রায় ৩ একর আয়তনবিশিষ্ট পুরো জমিদার বাড়িটি দেখতে পারেন।

১৮৬২ সালে এ বংশের লোকরা জমিদারি লাভ করেন। জমিদারি শুরু করেন গৌরি মোহন। তার ভাই রাম দয়াল ও কমলা কান্ত তাকে সহযোগিতা করেন। তাদের অওতাধীন বর্তমান তিতাস, মুরাদনগর, দাউদকান্দি, চান্দিনা, দেবিদ্বার ও নবীনগর বিস্তৃত ছিল। বাড়ির বাইরের অংশের একটি ঘরে উঁচু রথ দেখতে পাবেন। লোকজনের মুখে জানবেন, জমিদার অশ্বিনী কুমার রায় ১৩২৪ বঙ্গাব্দে জগন্নাথ দেবের রথ ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। আপনি যদি রথ যাত্রার সময় যান তাহলে দেখবেন হাজার হাজার ভক্ত সমবেত হয়।

বাড়ির বাইরের অংশে সুউচ্চ দেয়াল দেখবেন। একদিকে কাঁটা তারের বেড়া রয়েছে। একে একে সবগুলো ভবন ঘুরে দেখুন। দেখবেন কোনটা আই টাইপ, কোনটা এল টাইপে নির্মিত। সবগুলো ভবনেই সুশোভিত নকশা রয়েছে। সবগুলোতে ফুলের নকশা করা হলেও একই ধরনের ফুল ব্যবহার করা হয়নি। এমনকি জানালার গ্রিলগুলোতেও নকশা করা রয়েছে। এ ধরনের নকশা আজকাল আর দেখা যায় না। জমিদার বাড়ির লোকদের কাছে জানবেন, বাড়িগুলোর নকশা তৈরিতে ঢাকার বিক্রমপুরের মিস্ত্রিরা কঠোর পরিশ্রম করেছেন। এগুলো মুঘল রীতিতে তৈরি।
এবার প্রবেশ করুন রানী মহলে। সেখানে গিয়ে রানী নন্দ রানী, মহামায়া রায়, ও শ্যামা সুন্দরী দেবীর স্মৃতি মনে পড়বে। রানী মহলের সামনে একটি পুকুর ছিল। ওই পুকুরের পানিতে জাফরান মিশিয়ে রানীরা গোসল করতেন। এছাড়া হস্তচালিত পাম্পের মাধ্যমে ৩ তলায় পানি উঠিয়ে রানীরা গৃহকর্ম সম্পাদন করতেন।

এবার চলে আসুন বেডরুমে। জমিদারদের ব্যবহৃত শৌখিন খাট, নকশা করা চেয়ার, গা এলিয়ে দেয়া ইজি চেয়ার, কারুকার্যখচিত ফুলদানি সবকিছুই দেখতে পাবেন। কাউকে জিজ্ঞেস করলে জানবেন, সেগুন কাঠের তৈরি নকশা করা আসবাবপত্রগুলো শতাধিক বছরের পুরনো। এবার আয়নামহলের দিকে এগিয়ে যান। এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় নাচ-গানের আসর বসত। ওই সময় ব্যবহৃত দু-একটি হ্যাজাক লাইট দেখতে পাবেন।শৌখিন জমিদাররা জারবাতি ব্যবহার করতেন। তবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকায় সেগুলোতে মোমবাতি ব্যবহার করা হতো। তখন কোন বৈদ্যুতিক পাখা না থাকায় হাতেটানা পাখা ব্যবহার করা হতো। এমন পাখা রঞ্জন বাবুর কাছে সন্ধান করলে দেখতে পাবেন।

জমিদার গিরিশ চন্দ্র রায়ের পুত্র হেম চন্দ্র রায় সংস্কৃতিবান ছিলেন। তার আমলে জলসা ঘরে বড় ধরনের সাংস্কৃৃতিক অনুষ্ঠান হতো।
বসতঘরের সামনে একটি ছোট্ট বাগান দেখতে পাবেন। এ বাগানে এক সময় শোভা পেত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আনা রঙ-বেরঙের ফুল গাছ। উড়িষ্যা থেকে আনা গোলাচি গাছটি দীর্ঘ দিন জীবিত ছিল। এখনও আছে নয়নাভিরাম পারিজাত,চাপা, ম্যাগনেশিয়াম ও কনকচাঁপা।এছাড়া পৃথক ফলবাগানও ছিল।

এবার আপনি চলুন ডাইনিং রুমে। এখানে নিয়মিত কয়েকজন পাকা রাঁধুনি থাকত। জমিদার পরিবারের সদস্য ছাড়াও খাওয়া-দাওয়া করত পাইক-পেয়াদা ও খাজনা আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারীরা। জমিদারদের ব্যবহৃত শ্বেত পাথরের একটি প্লেট দেখে নিজের চোখকে ধন্য করতে পারেন। ভাত খাওয়ার পর ফল খাওয়া ছিল তাদের নিত্যদিনের অভ্যাস। তখনকার যুগে হাটবাজার কিংবা গলির মোড়ে আপেল-আঙ্গুর পাওয়া যেত না। নিজস্ব নৌকা দিয়ে চাঁদপুর গিয়ে সেখান থেকে স্টিমারে কলকাতা গিয়ে আপেল, আঙ্গুর নিয়ে আসা হতো। ডাইনিং রুমের চারদিকে চোখ রাখুন, দুর্লভ অনেক কিছু চোখে পড়বে। বর্তমানে আমরা পানি বিশুদ্ধ করার জন্য ফিল্টার ব্যবহার করি। আজ থেকে ১শ’ বছর আগেও জমিদাররা যে কতটা স্বাস্থ্যসচেতন ছিলেন তা দরজার পাশে রাখা ফিল্টারটির দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন। ফিল্টারটির নিচের অংশে চোখ নিলে দেখতে পাবেন ছোট্ট করে লেখা রয়েছে, ‘মেইড ইন লন্ডন’।

এবার খাওয়ার ঘর থেকে বেড়িয়ে আসুন। বের হওয়ার রাস্তায় দেখবেন একটি ছাতা। তবে এটি যেনতেন ছাতা নয়, রুপার হাতলের ছাতা।জমিদার বাবুরা যখন প্রজাদের সুখ-দুঃখ দেখার জন্য বের হতেন তখন দু’জন লোক এটি বয়ে বেড়াত।

মূল বাড়ি থেকে বের হয়ে এবার শ্মশানে চলে আসুন। এখানে সমাহিত রয়েছেন জমিদার রাম মোহন রায়, কৃষ্ণমোহন রায়, গৌরি মোহন রায়সহ বহু জমিদার। তবে হিন্দুরীতি অনুযায়ী আগুনে দাহ না করে মাটি দেয়া হয় সাধু পুরুষ কমলাকান্ত রায়কে। এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় মোমবাতি জালানো হয়। হিন্দু-মুসলমান সবাই তাকে সম্মান করত। তার ভক্তদের মুখে শুনবেন তার সমাধির সামনের পুকুরটির নাম ফেনপুকুর।এক সময় বহু ভক্ত এখানে আসত। তাদের জন্য ফ্রি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। শোনা যায়, তাদের জন্য রান্না করা ভাতের মার ফেলতে ফেলতে এ যায়গাটি গর্ত হয়ে পুকুরটির সৃষ্টি হয়েছে।

সমাধি সৌধ অতিক্রম করে সামনে গেলে দেখতে পাবেন বেশ কয়েকটি মন্দির। এলাকাবাসরী মুখে শুনবেন, শুধু মন্দির নয় জাহাপুরের জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট, মাদ্রাসা, হাইস্কুল, পোস্ট অফিস ও দাতব্য চিকিৎসালয় গড়ে উঠেছে। হাতে সময় থাকলে সব ঘুরে ঘুরে দেখবেন।

কিভাবে যাবেনঃ
ঢাকার সায়েদাবাদ কুমিল্লা অথবা কোম্পানীগঞ্জগামী তিশা অথবা অন্য কোন লাক্সারিয়াস বাসে উঠবেন।ময়নামতি সংলগ্ন ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছবেন কুমিল্লা শহরের আগে মাত্র ২ ঘণ্টায়। কোম্পানীগঞ্জের বাসে উঠলে আর বাস পরিবর্তন করতে হবে না। কুমিল্লার বাসে উঠলে ময়নামতিতে নামতে হবে। এখান থেকে আবার কোম্পানীগঞ্জের বাসে উঠে দেবিদ্বারের পান্নারপুলে নামতে হয়। সেখান থেকে বাখরাবাদ রোডে ১০ কিলোমিটার গেলেই জাহাপুর পৌঁছতে পারবেন।

ফেরার পথঃ
যদি নিজস্ব যানবাহনে আসেন তাহলে দিনে দিনেই ফিরতে পারবেন। সমস্যা হলে কোম্পানীগঞ্জ অথবা দেবিদ্বারের কোন হোটেলে উঠুন। অথবা ১ ঘণ্টা হাতে নিয়ে কুমিল্লা শহরের অন্য যে কোন হোটেলে উঠুন।বাসায় ফেরার সময় প্রিয়জনের জন্য ঐতিহ্যবাহী খদ্দরের পোশাক এবং রসমলাই নিয়ে যেতে ভুলবেন না কিন্তু!

 

আরো পড়ুন