কুমিল্লায় যুবলীগ নেতা জামালকে আরও আগে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল

কুমিল্লার তিতাস উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জামাল হোসেনকে প্রথমে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এ জন্য দুজন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান, একজন সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন রমজানের আগে বৈঠক করেন। বৈঠকে জনপ্রতি ২০ জন লোক জড়ো করে রোজার সময় জামালকে গণপিটুনিতে হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু জামাল বিষয়টি আঁচ করতে পেরে বাসা থেকে তেমন বের হতেন না। ওই পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার পর তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

জামাল হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার জড়িত শুটার দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেলুর আদালতে দেওয়া জবানবন্দি থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। দেলোয়ার দাউদকান্দি উপজেলার চর চারুয়া গ্রামের বাসিন্দা। ১৫ মে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কুমিল্লার ৩ নম্বর আমলি আদালতের (দাউদকান্দি) বিচারক কামাল হোসেনের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন দেলোয়ার।

গত ৩০ এপ্রিল রাত আটটার দিকে দাউদকান্দির গৌরীপুর পশ্চিম বাজার ঈদগাহ এলাকায় যুবলীগ নেতা জামালকে (৪০) গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনি তিতাস উপজেলার জিয়ারকান্দি নোয়াগাঁও গ্রামের ফজলুল হকের ছেলে। তবে গৌরীপুর পশ্চিম বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি।

জবানবন্দিতে দেলোয়ার হোসেন বলেন, গৌরীপুর বাজারে জমিজমা বিক্রি ও ভবন নির্মাণে চাঁদা আদায় নিয়ে দুটি পক্ষ বিদ্যমান। এক পক্ষে যুবলীগ নেতা জামাল ও তাঁর ভাই কামাল হোসেন, অন্য পক্ষে মো. সুজন ও মো. শাকিল নামের দুজন আছেন। জামালকে হত্যার আগে মার্চ মাসে দাউদকান্দির জিংলাতলি ইউপির চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেনের বাড়িতে আলমগীর, আলমগীরের স্ত্রী দাউদকান্দি উপজেলা পরিষদের সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পারুল আক্তার, অলি হাসান, শাহ আলম, সুজন, কালা মনির, আরিফ, তিতাস উপজেলার জিয়ারকান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলী আশরাফ ও তাঁর ছেলে আবু বকর, ইউপি সদস্য স্বপনসহ বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে জনপ্রতি ২০ জন লোক এনে জামালকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে শাহ আলম ১০ লাখ টাকা দেবেন বলে জানান। পরে তাঁরা তিতাসে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শাহিনুল ইসলাম ওরফে সোহেল শিকদারের সঙ্গে দেখা করেন। তখন তিতাস উপজেলা পরিষদের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান মো. ফরহাদ আহমেদ ফকিরও উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠক ও পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে তাঁকে (দেলোয়ার) মারধর করেন জামাল। পরে সুজন, শাহ আলী ওরফে আল আমিন ও মামুন নামের কয়েকজনকেও মারধর করা হয়। অলি হাসানকে ফোনে হত্যার হুমকি দেন জামাল। এরপর সবাই জামালের ওপর ক্ষিপ্ত হন।

জবানবন্দিতে দেলোয়ার আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের সময় আরিফ ও কালা মনির দুটি করে গুলি করেন। তিনি (দেলোয়ার) একটি গুলি ওপরের দিকে করেন। হত্যাকাণ্ডের পর গৌরীপুর বাজারে গিয়ে একজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাঁরা নোয়াখালীর সুবর্ণচরে চলে যান।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও কুমিল্লা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবির) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাজেস বড়ুয়া বলেন, দেলোয়ার হোসেন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে হত্যার পরিকল্পনা, জামাল খুনের নেপথ্যে কারা জড়িত, কী কারণে হত্যা করা হয়েছে, তার বর্ণনা দেন। পুলিশ মামলার পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে।

যুবলীগ নেতা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২ মে রাতে নিহত জামালের স্ত্রী পপি আক্তার বাদী হয়ে দাউদকান্দি থানায় ৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা সাত থেকে আটজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। এর মধ্যে ৬ মে এজাহারনামীয় ৩ নম্বর আসামি মো. ইসমাইল, তিতাস উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহিনুল ইসলাম ওরফে সোহেল শিকদার ও মো. শাহ আলমকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। একই দিন তিতাসের জিয়ারকান্দি গ্রামের মো. রবি ও শাহপরান এবং লালপুর গ্রামের মাইক্রোবাসচালক সুমন হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৯ মে দেলোয়ার ও সাহিদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। ৯ মে রাতে মাজহারুল ইসলাম ওরফে সৈকত নামের আরেকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে দেবীদ্বার উপজেলার নবীয়াবাদ গ্রামের মো. মাসুদকে ১০ মে রাতে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে ইসমাইল, শাহিনুল ইসলাম, শাহ আলম, দেলোয়ার হোসেন, সাহিদুল ইসলামকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে। মো. মাসুদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন মাইক্রোবাসচালক সুমন, হত্যাকাণ্ডের পর অস্ত্র বহন করা মাজহারুল ইসলাম ওরফে সৈকত, শুটার দেলোয়ার হোসেন ও হত্যাকাণ্ডের পর আসামিদের পলায়নে সম্পৃক্ত সাহিদুল ইসলাম ওরফে সাদ্দাম মাস্টার।

মামলার এজাহারনামীয় ছয় আসামি ও অজ্ঞাতনামা এক আসামি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তাঁরা হলেন তিতাস উপজেলার জিয়ারকান্দি গ্রামের মো. সুজন (৩২) ও মো. আরিফ (২৮) নেপালে, জিয়ারকান্দি গ্রামের বাদল (৪৫) দুবাইতে, মো. শাকিল (৩৫) ভারতে, জিয়ারকান্দি গ্রামের অলি হাসান (৩৯) সৌদি আরবে ও কালা মনির (৪২) দেশে আত্মগোপনে আছেন। মামলার অজ্ঞাতনামা আসামি জিয়ারকান্দি গ্রামের শাহ আলী ওরফে আল আমিন দুবাইতে থাকেন।

মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্তকারী কর্মকর্তা রাজেশ বড়ুয়া বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। এখনো আসামি গ্রেপ্তার বাকি আছে। সব আসামি গ্রেপ্তারের পর অভিযোগপত্র দেওয়া হতে পারে। এটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিষয়।

আরো পড়ুন