কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী রুপবাবুর জমিদার বাড়ি

দূর থেকে দেখে বুঝার উপায় নেই এটা জমিদার বাড়ি। ঘন গাছ-গাছালির মাঝে জমিদার বাড়িটি। রং উঠে গেছে। লোহায় ঝং ধরেছে। তবে এত সবের মাঝে স্বগৌরবে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটি। মোটর বাইক নিয়ে খুঁজে বের করে ফেললাম জমিদার রুপেন্দ্রলোচনের বাড়ি। স্থানীয়রা রুপ বাবুর বাড়ি নামেই চিনেন। কুমিল্লা মুরাদনগর উপজেলার বাংগরায় জমিদার রুপ বাবুর বাড়ি। অন্তত আড়াই’শ বছর আগে জমিদারী পরিচালনা হতো এ বাড়ি থেকে।

বাড়িটিতে প্রবেশ করতে কেমন যেন অনুভূত হলো। শান্ত সুনিবিড় পরিবেশ। চারদিকে লম্বা-লম্বা গাছ। বাড়ির সামনে কাঁচারী ঘর। ঘরের দরজা জানালায় অনিন্দ্য কারুকাজ। উত্তর ভিটায় রয়েছে একটি মন্দির। এটাকে নারায়ন মন্দির বলা হয়। আর পশ্চিম ভিটায় মূল বাড়িটি। তিনতলা বাড়িটি। বর্তমানে জমিদার বাড়িতে একটি পরিবার বাস করে।

বাড়িটির চারপাশ ঘুরে দেখছি। ছবি তুলছি। বাড়ির অন্দরে রয়েছে জমিদারী আমলের চেয়ার টেবিলসহ আরো কিছু আসবাবপত্র। দো’তলায় প্রবেশ করতে চাইলাম। বাড়ির বাসিন্দা জানালেন উপরের তলায় তালা দেয়া। অগত্য বাড়িটির আশপাশ ঘুরে দেখতে হয়েছে।

তবে এ বাড়ির ইতিহাস না জেনে যাওয়া যাবে না। তাই যুৎসই কাউকে খুঁজতে লাগলাম। পেতেও বেশী দেরী হয় নি। জমিদার রুপবাবুর প্রজা যারা ছিলেন তাদের একজন শ্রী মনোরঞ্জন চন্দ্র নট্ট । বংশ পরম্পরায় তারা জমিদার বাড়িতে ঢোল বাজাতেন। তিনি জমিদার বাড়ির পাশে থাকেন। জমিদার বাড়ি দেখাশুনা করেন। চাষাবাদ করেই চলে মনোরঞ্জন নট্টদের জীবন। কথা হয় মনোরঞ্জন নট্টের সাথে।

মনেরঞ্জন নট্ট জানালেন, জমিদার রুপবাবু ব্রিটিশ সরকারের রায় বাহাদুর উপাধিপ্রাপ্ত ছিলেন। তাই তখন প্রজারা রুপবাবুকে প্রেসিডেন্স বলেও সম্বোধন করতেন । জমিদার রুপবাবু তার বাবা উমালোচন মজুমদারের মত প্রজাবৎসল জমিদার ছিলেন। রুপবাবুর বাবা জমিদার উমালোচন মজুমদার ১৮৮৫ সালে বাংগরায় একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ঐতিহ্যবাহী বাংগরা উমালোচন উচ্চ বিদ্যালয়। প্রাথমিক অবস্থায় এটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ছিলো। পরে উমালোচন মজুমদারের ছেলে জমিদার রুপবাবু বর্তমান জায়গায় মূল ভবন স্থাপন করেন। বিদ্যালয়টির সামনে সুবিশাল মাঠ। এত বড় খেলার মাঠ সম্ভবত কুমিল্লা জেলার আর কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেই।

রুপ বাবুর মায়ের নাম শান্তমনি দেবী। জমিদার বাড়ির দক্ষিণ পশ্চিমে রয়েছে একটি দিঘি। নাম দশান্তমনি সাগর। দিঘির পাড়ে শান বাঁধানো ঘাট। বাংগরা বাজারে শান্তমনি দেবীর নামে একটি দাতব্য চিকিৎসালায় রয়েছে। ১৯০০ সালে এটি স্থাপন করা হয়েছিলো। প্রজারা সেখানে চিকিৎসা নিতেন। দাতব্য চিকিৎসালয়ের নকশাটি অসাধারণ। রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে এখন সেই নকশায় ঝং ধরেছে। ক্ষয়ে পড়ছে পলেস্তরা। বাংগরা বাজারে অগ্রণী ব্যাংকেরও শাখাও রুপবাবুদের। এছাড়াও জেলা প্রশাসকের ডাক বাংলোর জায়গাওটাও রুপবাবুদের দেয়া। ৯ টি গ্রামজুড়ে ছিলো রুপবাবুদের জমিদারী।

জমিদার রুপবাবুর এক ছেলে। মানিক বাবু। মানিক বাবুর তিন ছেলে। দেবী প্রসাদ মজমুদার, শিবু প্রসাদ মজুমদার ও শ্যামা প্রসাদ মজুমদার। তাদের মধ্যে শ্যামা প্রসাদ ও দেবী প্রসাদ মজুমদার ঢাকায় থাকেন। কুমিল্লায় পানপট্টির বাংগরা হাউজে থাকেন শিবু প্রসাদ মজুমদার। বিভিন্ন সময়ে তারা বাপ-দাদার ভিটে যান।

রুপবাবুর বাড়ির বর্ণনাকারী শ্রী মনোরঞ্জন চন্দ্র নট্ট জানান, তার বাবা প্রমদ চন্দ্র নট্ট এই জমিদার বাড়িতে ঢোল বাজাতেন। পরে তিনি ইউনিয়ন পরিষদের দফাদার ছিলেন। বাবার পথেই আছেন মনোরঞ্জন নট্ট। তিনি এখন গ্রাম পুলিশ হিসেবে কর্মরত।

জমিদারীকালে এ বাড়িতে প্রতিদিন অন্তত এক দেড়’শ লোক খাবার আয়োজন হতো। বড় চুলায় রান্না হতো। খাবারের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়তো আশেপাশে। জমিদার বাড়িতে যারা কাজ করতেন তারা সবাই এক সাথে বসে খাবার খেতেন। কথা বলতে বলতে দুপুর হয়ে এলো। আমাদেরও পেটে খিদে। তাই হয়তো আমাদের নাকেও জমিদারী খাবারের ঘ্রাণ এসে লাগলো। কথা শেষে মনোরঞ্জন নট্টকে ধন্যবাদ দিলাম। চমৎকারভাবে রুপবাবু জমিদার বাড়ীর ইতিহাসটা তুলে ধরার জন্য।

কুমিল্লা থেকে কোম্পানীগঞ্জ। সেখান থেকে বাংগরা। তারপর বাংগরা থানার সামনে গিয়ে যে কাউকে বললে দেখিয়ে দিবে ঐতিহ্যবাহী রুপবাবুর জমিদার বাড়ি।

আরো পড়ুন