কুমিল্লা জেলার নামকরণ ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলী

ডেইলিকুমিল্লানিউজ ডেস্কঃ বর্তমান কুমিল্লা চট্টগ্রাম বিভাগের অধীন একটি জেলা। প্রাচীনকালে এটি সমতট জনপদের অন্তর্গত ছিল এবং পরবর্তীতে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ হয়েছিল। কুমিল্লা নামকরণের অনেকগুলো প্রচলিত মতের মধ্যে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় চৈনিক পরিব্রাজক ওয়াং চোয়াঙ কর্তৃক সমতট রাজ্য পরিভ্রমণের বৃত্তান্ত থেকে। তার বর্ণনায় কিয়া-মল-ঙ্কিয়া (Kiamolonkia) নামক যে স্থানের বিবরণ রয়েছে সেটি থেকে কমলাঙ্ক বা কুমিল্লার নামকরণ হয়েছে বলে পন্ডিতেরা অভিমত দিয়েছেন। এ অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শন‍াদি থেকে যতদূর জানা যায় খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকে ত্রিপুরা গুপ্ত সম্রাটদের অধিকারভুক্ত ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে সপ্তম থেকে অষ্টম শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এ অঞ্চলে বৌদ্ধ দেববংশ রাজত্ব করে। নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা হরিকেলের রাজাগণের শাসনাধীনে আসে। প্রত্নপ্রমাণ হতে পাওয়া যায় যে, দশম হতে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত প্রায় দেড়শ বছর এ অঞ্চল চন্দ্র রাজবংশ দ্বারা শাসিত হয়েছে।

মধ্যবর্তী সময়ে মোঘলদের দ্বারা শাসিত হওয়ার পরে ১৭৬৫ সালে এটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে আসে। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে কোম্পানী ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দ প্রদেশে একজন তত্ত্বাবধায়ক (Superintendent) নিয়োগ করে। তখন কুমিল্লা ঢাকা প্রদেশের অন্তর্গত ছিল। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লাকে কালেক্টরের অধীন করা হয়। ১৭৯০ সালে ত্রিপুরা জেলা গঠনের মাধ্যমে ত্রিপুরা কালেক্টরেটের যাত্রা শুরু হয়। ১৭৯৩ সালে তৃতীয় রেগুলেশন (Regulation III) অনুযায়ী ত্রিপুরা জেলার জন্য একজন দেওয়ানি জজ নিযুক্ত করা হয় এবং সে বছরই তাকে ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১৮৩৭ সালে ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরের পদগুলিকে পৃথক করা হয়। ১৮৫৯ সালে আবার এই দুটি পদকে একত্রিত করা হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরবর্তী সময়ে ১৯৬০ সালে ত্রিপুরা জেলার নামকরণ করা  হয় কুমিল্লা এবং তখন থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর পদটির নামকরণ হয় জেলা প্রশাসক (Deputy Commissioner)। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লার দু’টি মহকুমা চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে পৃথক জেলা হিসেবে পুনর্গঠন করা হয়।

দেশের বিভিন্ন আন্দোলনের সাথে কুমিল্লার সম্পৃক্ততার ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ। ১৭৬৪ সালে সমশের গাজীর নেতৃত্বে সংঘটিত ত্রিপুরার রাজাদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন কুমিল্লার ইতিহাসে উজ্জ্বল ঘটনা। প্রিন্স ওয়ালেসের ভারত ভ্রমণের প্রতিবাদে ২১ শে নভেম্বর ১৯২১ সালে দেশব্যাপী আহুত ধর্মঘটে কুমিল্লাবাসী সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে। সে সময় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লায় অবস্থান করছিলেন এবং তিনি বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা লিখে কুমিল্লার জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। গান্ধী অভয়াশ্রম নামের প্রতিষ্ঠানটি এসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মহাত্না গান্ধী কুমিল্লা ভ্রমণ করেন। ১৯৩১ সালে চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় মোহিনী গ্রামের প্রায় চার হাজার চাষী রাজস্ব প্রদানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এসময় ব্রিটিশ গুর্খা সৈনিকরা বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করলে চারজন চাষী প্রাণ হারান। ১৯৩২ সালে লাকসামের হাসনাবাদে কৃষকদের বিশাল মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হলে বেশ কিছু লোক প্রাণ হারান। কুমিল্লার জনগণ কখনই কোন অন্যায় শোষনকে মেনে নেয়নি এবং সবসময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। যেসকল বীর এসব প্রতিবাদে প্রাণ উৎসর্গ  করেছেন তাঁদেরকে কুমিল্লাবাসী গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কুমিল্লার জনগণ অংশগ্রহণ করেছে। কুমিল্লায় বেশ কয়েকটি স্থানে গণহত্যা সংঘটিত হয় যেমন, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট, লাকসাম, হোমনা, বেলতলী এবং রসুলপুর। বেতিয়ারা, মুদাফ্‌ফরগঞ্জ নগরিপাড়া, ক্যান্টনমেন্ট, কৃষ্ণপুর, ধনঞ্জয়, দিলাবাদ ও লাকসাম বিড়ি ফ্যাক্টরিতে গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়।

কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী অতীতের সাক্ষ্য বহন করছে এখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনসমূহ। এ জেলার বেশ কয়েকটি স্থানে বহু মূল্যবান পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক স্থানের সন্ধান পাওয়া গেছে। তেমনি এক ঐতিহাসিক স্থানের সন্ধান পাওয়া যায় লালমাই ময়নামতি পাহাড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে। এখনকার মাটি খুঁড়ে প্রাচীন সভ্যতার চিহ্ন খুজেঁ পাওয়া গেছে। এ পাহাড়ের পুরাকীর্তিগুলোর মধ্যে শালবন বিহার, কুটিলা মুড়া, চন্দ্রামুড়া, রূপবান মুড়া, ইটাখোলা মুড়া, সতের রত্নমুড়া, রাণীর বাংলোর পাহাড়, আনন্দবাজারের প্রাসাদসমূহ, চন্ডীমুড়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব স্থান হতে উদ্ধারকৃত প্রত্নসম্পদ যেমন মূর্তি, ধাতব তৈজসপত্র ও অন্যান্য নিদর্শনসমূহ বর্তমানে ময়নামতি জাদুঘরে রক্ষিত আছে। অন্যান্য ঐতিহাসিক নির্দশনের মধ্যে রয়েছে সপ্তরত্ন মন্দির (জগন্নাথমন্দির), শাহ সুজা মসজিদ, ধর্মসাগর, চন্ডীমাতার মন্দির (বরুড়াতে লালমাই পাহাড়ের উপরে অবস্থিত), চান্দলা শিবমন্দির (ব্রাহ্মণপাড়া, অষ্টাদশ শতাব্দী), সতিশালা জামে মসজিদ, শশীদলের পাঁচ পীরের মাজার, হরিমঙ্গল মাঠ, রামগর বড়মাঠ, সাইতশালা রামমোহন মন্দির, হাসনাবাদ মাঠ এবং হাতিয়াভাঙ্গা দূর্গ। কুমিল্লার প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী এসব স্থান পর্যটকদের  কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় । এছা‌ড়াও কুমিল্লায়  আগত পর্যটকগণ কোটবাড়ি, ক্যান্টনমেন্ট ইত্যাদি ঘুরে আনন্দ লাভ করেন। কোটবাড়িতে অবস্থিত বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে গঠিত ময়নামতি ভ্রমণপিপাসু পর্যকটকগণের প্রধান আকর্ষণ। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৩.১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত সৈনিকদের সমাধিক্ষেত্রটিও (ওয়ার সিমেট্রি) একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র। এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বার্মা অধিগ্রহণকারী জাপানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার সামরিক স্থাপনা ছিল। কুমিল্লার অপর একটি ঐতিহ্য পশ্চিমগাঁও নবাববাড়ি। কুমিল্লা তথা দেশের প্রথম নারী নবাব ফয়জুন্নেসা, যিনি একাধারে কবি, শিক্ষাবিদ এবং মহৎ হ্নদয়ের অধিকারী তিনি এখানে বাস করতেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার জীবনের বেশ কিছু সময় এখানে বসবাস করেছেন। তাঁর দুই স্ত্রী প্রমিলা দেবী এবং নারগিস উভয়েই কুমিল্লার অধিবাসী ছিলেন। দেশবিখ্যাত কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ এবং কুমিল্লা জেলা স্কুল এখানকার সবচেয়ে প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (BARD) কুমিল্লার কোটবাড়িতে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ একাডেমী। গোমতীর তীরে অবস্থিত কুমিল্লা শহরে বেশ কয়েকটি বিখ্যাত জলাশয় রয়েছে। যেমন: ধর্মসাগর, রানীর দীঘি, নানুয়ার দীঘি, উজির দীঘি ইত্যাদি। কুমিল্লায় বহু মনীষী জন্মগ্রহণ করেছেন যারা বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও আন্তজার্তিক পর্যায়ে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। নবাব সিরাজুল ইসলাম, হরদয়াল নাগ, মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, নবাব স্যার সামশুল হুদা, রায় বাহাদুর অমিন্দচন্দ্র রায়, সৈয়দ আবদুল জব্বার, বসন্ত কুমার মজুমদার, ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত, শচীন দেব বর্মন, এম এ আযম প্রমুখের সমাজসেবা, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবদানের কথা কুমিল্লাবাসী কখনও ভুলবেনা। ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন, ফজলে নিজামি এবং ফুলেন্দু দাস কুমিল্লার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। এছাড়া বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ডঃ আখতার হামিদ খান তার উদ্ভাবিত কুমিল্লা মডেল এর সফল ব্যবহারের মাধ্যমে আর্ন্তজাতিকভাবে সুনাম অর্জন করেছেন। কুমিল্লার মুরাদনগর উপেজলায় বাখরাবাদে দেশের অন্যতম বৃহৎ গ্যাস ফিল্ড রয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝমাঝিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কুমিল্লা শহরের দক্ষিণে একটি বৃহৎ কটনমিল স্থাপন করে। সে সময়ে এখানে উৎপদিত সুতি বস্ত্র অন্যান্য জেলায় বিক্রি হত। কুমিল্লার খদ্দর যেমন সারাদেশে বিখ্যাত তেমনি দেশে-বিদেশে বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের  সুখ্যাতি রয়েছে। অন্যান্য কুটির শিল্পের মধ্যে বেতের কাজ, শীতল পাটি, হুকা, মাদুর ইত্যাদি বিখ্যাত।

কুমিল্লা তার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সম্পদ, সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং এখানকার জনগণের উষ্ণ আন্তরিকতা দিয়ে সবাইকে সাদর সম্ভাষণে প্রস্তুত।

আরো পড়ুন