তালগাছের গ্রাম কুমিল্লার সাতঘরিয়া

‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে। মনে সাধ কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়- একেবারে উড়ে যায়- কোথা পাবে পাখা সে?’ তাল গাছ দেখলে বিশ্বকবি রবীদ্রনাথ ঠাকুরের এ কবিতার কথা অবচেতন মনে চলে আসে।

এমনই ছবির মতো সুন্দর সারি সারি তালগাছের দেখা মেলে সীমান্তঘেঁষা কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নের সাতঘরিয়ায় গ্রামের সড়কের দুই পাশে। এ যেন তালগাছের গ্রাম।

গ্রাম বাংলার অতি চিরচেনা ফল তাল। আকাশ পানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি তালগাছ। আর গাছে-গাছে ঠাসা তাল ফল ও বাবুই পাখির ঝুলন্ত বাসা, পাখ-পাখির কলতান কার না ভালো লাগে।

তাল গাছের আদি নিবাস আফ্রিকা হলেও কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের সাতঘরিয়া যেন তালগাছের গ্রাম বললে ভুল হবে না। এটি আসলেই তালগাছের গ্রাম। যতদূর চোখ যাবে সড়কের দুপাশে শুধু সারি সারি তালগাছ। প্রায় প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় শোভা পাচ্ছে পরিবেশবান্ধব তালগাছ। ছোট-বড় তালগাছে ঘেরা মনোমুগ্ধ পরিবেশ যে কাউকে আকৃষ্ট করে।

তালগাছের দৃশ্য উপভোগ করতে ও মোবাইল ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করতে বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসেন প্রকৃতি প্রেমী মানুষ। তালগাছের দৃষ্টিনন্দন এসব ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শেয়ার করেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, চট্টগ্রামের মো. সোহেল চৌধুরী আগ্রাবাদের একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিনি এসেছেন তালগাছের সারির সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে। তিনি বলেন, সড়কের দুই পাশে অগণিত তালগাছ সাতঘরিয়া গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে যা দেখতে আমাদের এখানে ছুটে আসা। চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা আসার পথে এখানে বিরতি দেওয়া প্রাকৃতি প্রেমীদের জন্য এটি চমৎকার একটি স্থান।

আয়তনের দিক থেকে জেলার চৌদ্দগ্রামের জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নের গ্রামেটি বড়। এর প্রায় প্রতিটি সড়কের দুই পাশে বজ্রপাত নিরোধক ও পরিবেশ বান্ধব সারি-সারি তালগাছ লাগিয়েছেন ওই এলাকার গ্রামবাসীরা। এমনকি বাড়ির আঙিনাতেও রয়েছে ছোট-বড় তালগাছ।

আমরা জানি গাছ মানুষকে অক্সিজেন দেয়। ক্ষতিকারক কার্বনডাই অক্সাইড গ্রহণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। গাছ ছায়া দেয় ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা করে। কিন্তু গাছ যে আমাদের বজ্রপাত থেকে রক্ষা করে তা অনেকেরেই অজানা। তালগাছ বজ্রপাত নিরোধক গাছ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। গত ৩ বছরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার সাতঘড়িয়া গ্রামে কেউ বজ্রপাতে মারা যায়নি বলে ওই এলাকার লোকজন জানিয়েছেন।

৩ বছরে বজ্রপাতে কেউ মারা যায়নি

৭৫ বছরের প্রবীণ সাতঘরিয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আবদুল্লাহ বলেন, এই গ্রামে আদিকাল থেকেই তালগাছ রোপণ করা হয়। সেই ধারাবাহিকতা আমরা ও আমাদের সন্তানেরাও অব্যহত রেখেছি। সারি সারি তালগাছ যেমন গ্রামের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে তেমনি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাত মোকাবিলাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। গত ৩ বছরে বজ্রপাতে আমাদের এ গ্রামে কেউ মারা যায়নি।

১৭ উপজেলায় ৫০ হাজার তালগাছ লাগানো হয়েছে। আগামী বছরে ১ লাখ রোপণ করা হবে।

কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য জেলার ১৭ উপজেলায় ৫০ হাজার তালের বীজ রোপণ করা হয়েছে। এসব বীজ সড়কের পাশে না লাগিয়ে ফসলি মাঠের আইলে লাগানো হবে।

তিনি বলেন, তালগাছ বজ্রপাত নিরোধক ও পরিবেশ বান্ধব। নির্বিচারে এ গাছ উজাড় করার ফলে বর্তমান সময়ে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে গেছে। মাঠে কৃষকদের মৃত্যু ঝুঁকি কমাতে কৃষি বিভাগ এ উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারি অর্থ বরাদ্দ পেলে আগামী বছর এক লাখ বীজ রোপণ করা হবে বলে তিনি জানান।

এ বিষয়ে কুমিল্লা বন বিভাগের প্রধান সহকারী মো. জাকির হোসেন বলেন, তালগাছ রোপণে সরকারিভাবে কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। তারপরও জনস্বার্থে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ফান্ড থেকে এক হাজার চারা রোপণ করা হয়েছে।

অর্থের যোগান দিচ্ছে তালগাছ

সব ধরনের মাটিতে তালগাছ জন্মে। সহজ রোপণ পদ্ধতি, কষ্ট সহিষ্ণু, কম যত্নে উৎপাদন ও বৃদ্ধির ফলে গ্রামীণ সড়ক, মহাসড়ক, বাঁধ বেড়িবাঁধ, রেল লাইন, পুকুর পাড়, খালের পাড়, নদীর পাড়, জমির আঁইল, পতিত জমি ও বসতবাড়ির শেষ সীমানায় তালগাছ রোপন উপযোগী স্থান।

তালগাছের গভীর মূলী ও শাখা প্রশাখা নেই বলে জমির আইলে রোপণে খাদ্য পুষ্টি ও ছায়া দেয়। ফসলের ক্ষতি করে না। তালের পাতা দিয়ে হাত পাখা, মাদুর, টুপি, ঘরের ছাউনি, চাটাই, ছাতা, লাকড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

গাছের ফাইবার বা আঁশ থেকে বিভিন্ন রকমের সৌখিন সামগ্রী তৈরি হয়, যথা- টুপি, ঝুড়ি, পাপোষ, ছোট বাষ্কেট, ও মাছ ধরার খলশানীতে ব্যবহৃত হয়।

পুরুষ তাল গাছের ফুল বা জটা হতে রস সংগ্রহ করে তা দিয়ে পাটালি গুড়, ভিনেগার, পিঠা, বড়া, লুচি, খাবার ইত্যাদি তৈরি করা হয়। পাকা তালের রস দিয়ে পিঠা, বড়া, খির, পায়েস তৈরি করা হয়। কচি ও কাঁচা তালের নরম শাঁস মুখরোচক পুষ্টিকর। সাতঘড়িয়া গ্রামের মানুষ তালগাছ থেকে এসব খাদ্যপণ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য্য জিনিষ তৈরি করে অর্থ উপার্জনও করছেন।

আরো পড়ুন