কুমিল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের মহড়ার পর ‘মুরুব্বির’ খোঁজে পুলিশ

কুমিল্লার অশোকতলার বিসিক এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের একটি চক্র শুক্রবার রানীর দীঘি, তালপুকুর পাড়, আদালত পাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে মহড়া দিয়েছে। ওইদিন বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত বিক্ষিপ্ত মহড়া দেওয়ার সময় ককটেল ফাটিয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও শক্তিমত্তার কথা জানান দেয়। সম্প্রতি এক গ্যাং লিডার কারাগার থেকে বের হয়েছে। প্রতিপক্ষ রতন গ্রুপকে ভয় দেখানো ও তাদের দেখে নিতে শুক্রবার তারা ওই মহড়া দেয় বলে জানিয়েছে। এ সময় মোটরসাইকেলে ছিল তাদের গ্যাং লিডার। পেছনে দলবদ্ধ হাঁটতে থাকে গ্রুপের সদস্যরা। আর কিছু সময় পরপর ককটেল ফাটায়। এতে জনমনে ভয়ানক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

এদিকে শুক্রবারের মহড়ার পর অভিযানে নামে পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ দল। শনিবার গভীর রাতে কিশোর গ্যাং লিডার রতন, সাইফুলসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল রোববার দুপুর পর্যন্ত এ ঘটনায় মোট ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া গ্যাং সদস্যদের মধ্যে রয়েছে ইমরান হোসেন রতন (১৯), মো. সাইফুল ইসলাম (১৯), মো. মোজাহিদ (২১) ও মো. রফিউল আলম শাফি (২০)। এ ছাড়া অস্ত্র সরবরাহকারী মো. রুবেলকেও (৩৫) গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক এমপি আ ক ম বাহার ও তার পরিবারের ছত্রছায়ায় কুমিল্লায় কিশোর গ্যাং কালচার গড়ে ওঠে। কুমিল্লার আলোচিত কিশোর গ্যাং গ্রুপগুলো হচ্ছে রতন, ঈগল, র্যাক্স, এক্স, এলআরএন, বিসিকে, মডার্ন, রকস্টার, ডিস্কো বয়েজ, বসসহ কমপক্ষে ২০টি। এসব গ্যাং সদস্য নিজেদের আধিপত্য দেখাতে প্রকাশ্যে সহিংসতায় জড়াচ্ছে। ২০১৭ সালের পর থেকে গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের হাতে অন্তত ১২টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এ ছাড়া মাদক কারবার, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ইভটিজিংয়ের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে এসব গ্যাং।

সম্প্রতি এসব গ্যাংয়ের সদস্যদের সঙ্গে পাড়া-মহল্লার ছাত্র-যুবদল ও বিএনপি নেতাদের সখ্য বেড়েছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের মাধ্যমে গ্যাং সদস্যরা মহল্লায় ‘মুরুব্বি’ পেয়ে গেছে। কিন্তু প্রধান মুরুব্বির খোঁজে তারা মহড়া দিয়ে বেড়াচ্ছে বলে জানিয়েছে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে তাদের বিভিন্ন কোড নামে গ্রুপ রয়েছে। গ্রুপে ঘোষণা আসামাত্রই তারা দ্রুততম সময়ে এক জায়গায় মিলিত হয়ে নানা অপরাধ সংঘটিত করছে।

জানা গেছে, কুমিল্লা শহরে এখন অশোকতলা-ধর্মপুর এলাকার বিসিক ও ডিসি অফিস সংলগ্ন ছোটরা মফিজাবাদ কলোনির (বস্তির) রতন গ্রুপ একে অন্যের প্রতিপক্ষ। মোগলটুলীর ঈগল গ্রুপ খুনখারাবিতে জড়িয়ে এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। বছরখানেক আগেও ঈগল ও রতন গ্রুপের দ্বন্দ্বে অতিষ্ঠ ছিল ওই অঞ্চলের মানুষ। বখাটে নিম্ন আয়ের পরিবারের কিশোররাই এমন গ্রুপের সদস্য।

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র বাহারকন্যা তাহসিন বাহার সূচনার স্বামী সাইফুল ইসলাম রনি ওরফে জামাই রনির হাত ধরেই শহরে কিশোর গ্যাং গ্রুপ গড়ে ওঠে। তারা তখনই ক্ষমতাসীন রাজনীতির সহযোগী শক্তি হয়ে ওঠে। বাহারের ভাতিজা মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আজিজ সিহানুকও তাদের অন্যতম শেল্টারদাতা ছিল। বর্তমানে কিশোর গ্যাংয়ের প্রধান শেল্টারদাতা রেসকোর্সের মো. আকিব হোসেন। সে অস্ত্রধারী ক্যাডার ও বিএনপির সাবেক নেতা আনোয়ার হোসেনের ছেলে। আনোয়ার হোসেন বর্তমানে মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আকিবকেও এখন কেউ রাজনৈতিক দলে ভিড়তে দিচ্ছে না।

এদিকে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা বাহারের বিশ্বস্ত ছিল আকিব। ঠিকাদারি কাজের রড সাপ্লাইয়ার। জামাই রনির ঘনিষ্ঠ। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারি কাজে বাহারের ক্যাডার মেসার্স এনএস গ্যালারির মালিক পলাতক সাইফুলের অসমাপ্ত ঠিকাদারি কাজগুলো দেখাশোনা করছে সে। এসব কাজের ভাগ বাহার ও সাইফুলকে নিয়মিত পাঠিয়ে আসছে।

এদিকে বিসিকে গ্রুপের অন্যতম গ্যাং লিডার আব্দুল্লাহ মুন্তাজ। অশোকতলার মারামারির ঘটনায় জেল খেটে বের হয়ে এসেছে। সে-ই নিজ গ্রুপকে সংগঠিত করে মহড়া দিয়েছে। আরেক গ্যাং লিডার তানজীব আব্দুল্লাহ। কুমিল্লায় ছাত্রদলের মিছিলে সদস্যদের নিয়ে হাজির থাকে। শুক্রবার তার নেতৃত্বে মহড়া হয়েছে।

জানা গেছে, ২২ এপ্রিল সকালে শহরের ধর্মসাগর পাড় রানীর কুটি এলাকায় নাফিজ অময় (২৫) নামে এক যুবককে কুপিয়ে আহত করে রতন গ্রুপের সদস্যরা। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়। আসামি করা হয় রতন, তার প্রধান সহযোগী সাইফুলসহ তিনজনকে। এর পর থেকেই রতন, সাইফুলসহ গ্রুপের সদস্যরা পলাতক।

রতন গ্রুপের এক সদস্য জানান, তাদের গ্রুপ অনেক বড় এবং পুরোনো। সদস্য সংখ্যা বেশি। তারা সক্রিয় থাকায় অশোকতলার বিসিকে, কেবিএস ও মোগলটুলীর ঈগল গ্রুপ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। মামলার কারণে রতন গ্যাংয়ের লিডার রতন ও সাইফুল পলাতক থাকায় এ সুবাদে শুক্রবার অশোকতলার বিসিকে, কেবিএস ও ঈগল গ্রুপ একত্রিত হয়ে নিজেদের শক্তিমত্তা জানান দিতে ওই মহড়া করে। পরে পুলিশ সক্রিয় হয়ে অভিযান শুরু করলে তারা সবাই পালিয়ে যায়।

কুমিল্লা মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি ফখরুল ইসলাম মিঠু বলেন, ছাত্রদলের কেউ কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত নয়। এমন প্রমাণ পেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব। অভিযোগ নজরে এলেই খতিয়ে দেখা হবে। ছাত্রদল ছাত্রদের সংগঠন, বখাটেদের নয়।

কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ মোল্লা টিপু সাংবাদিকদের বলেন, কিশোর গ্যাং, তাদের সন্ত্রাস—এসব আওয়ামী লীগের সৃষ্টি। বর্তমান সময়ে আমাদের কেউ তাদের সঙ্গে নেই। এমন তথ্যও আমাদের জানা নেই। যদি এমন তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই দলীয় ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধার:

শুক্রবার অভিযানের পর কিশোর গ্যাং ক্যাডারদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে র্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনী। এরই মধ্যে গ্রুপের গ্যাং লিডারসহ ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে একটি নাইন এমএম পিস্তল, একটি রিভলবার, চার রাউন্ড নাইন এমএম পিস্তলের গুলি, আট রাউন্ড রিভলবারের গুলি। দেশি ধারালো অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ছুরি ও কুড়াল। এ ছাড়া ইয়াবা, গাঁজা ও বিদেশি মদও উদ্ধার করা হয়। এসব উদ্ধার করা হয় কিশোর গ্যাংয়ের শেল্টারদাতা আকিবের রেসকোর্সের বাসা থেকে। এ ছাড়া অন্যদের কাছ থেকে আলামত হিসেবে আরও উদ্ধার করা হয়েছে ল্যাপটপ, বেশকিছু মোবাইল ফোন ও স্বর্ণের চেইন।

র্যাব কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, সম্প্রতি কুমিল্লা নগরীতে কিশোর গ্যাং আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে শনিবার রাতে সেনাবাহিনী ও র্যাবের যৌথ অভিযানটি রোববার ভোর পর্যন্ত চলে। অভিযানে সদর দক্ষিণ উপজেলার বাসিন্দা অস্ত্র সরবরাহকারী মো. রুবেলকে প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয়। রুবেল সম্প্রতি কুমিল্লা শহরে প্রকাশ্যে দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করে আলোচনায় আসে এবং বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করত।

কোতোয়ালি থানার ওসি মহিনুল ইসলাম বলেন, কিশোর গ্রুপের তৎপরতা বন্ধ করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তাদের ধরে জেলে পাঠানো হয়। তখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। তারা জেল থেকে বের হয়ে আবার বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা কেউ মহড়াসহ অপকর্ম করলেই গ্রেপ্তার করে আদালতে চালান করি।

সূত্রঃ কালবেলা

আরো পড়ুন