কুমিল্লায় ১৩ বছরের কিশোরীকে বিয়ে করা সেই বৃদ্ধ গ্রেফতার, পার পেলেন না কাজীও
কুমিল্লার লালমাইয়ে ১৩ বছরের কিশোরীকে ৬৫ বছরের বৃদ্ধের বিয়ে করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মেয়ের মায়ের দায়ের করা অপহরণ মামলায় বৃদ্ধ রিকশাচালক শামসুল হক সামুকে কারাগারে প্রেরণ করেছে আদালত। আর কিশোরীকে তার মায়ের হেফাজতে দেয়া হয়েছে।
এদিকে প্রতারণার মাধ্যমে অন্যের নাম, সীল, কাবিন ব্যবহার করে বৃদ্ধ রিকশাচালক ও কিশোরীর বিয়ে পড়ানোর অভিযোগে গোলাম সারওয়ার মজুমদার নামে একজন কাজীকে গ্রেফতার করেছে কুমিল্লার লালমাই থানা পুলিশ।
শুক্রবার তাকে কুমিল্লা কোতয়ালী থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযুক্ত কাজী লাকসাম উপজেলার আজগরা ইউপির নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্বে রয়েছেন।
এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কাজীকে নিয়ে অভিযান অব্যাহত রেখেছে বলে জানিয়েছেন লালমাই থানার ওসি মো. আইয়ুব।
জানা যায়, জেলার লালমাই উপজেলার পেরুল দক্ষিণ ইউপির পশ্চিম পেরুল গ্রামের এক ব্যক্তি ঢাকায় চাকরি করায় গ্রামে বসবাস করা তার পরিবারের দেখাশুনা করতেন পেরুল দীঘিরপাড়ার রিকশাচালক সামছুল হক সামু। তার ২য় কন্যা স্থানীয় পেরুল উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
সামছুল হক সামু নিজের রিকসায় তাকে নিয়মিত স্কুলে আনা নেয়া করতেন। কাজের কারণে মাঝে মধ্যে তিনি ওই বাড়িতে রাত্রিযাপনও করেছেন। কিন্তু গত ১০ মে রোববার সামছুল হক সামু সবাইকে হতবাক করে তার বয়স থেকে ৫২ বছরের ছোট ওই ছাত্রীকে কাজী অফিসে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন।
এই ঘটনা প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পেলে কুমিল্লাসহ সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। মুহুর্তেই খবরটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। পর দিন উপজেলা ইউএনও এবং থানার ওসি স্থানীয় চেয়ারম্যানের মাধ্যমে তার কার্যালয়ে এই অসম দম্পত্তিকে ডেকে মিমাংসা করার চেষ্টা করে। কিন্তু রিকশাচালক সামু ও কিশোরী তারা দুজনেই সংসার করার বিষয়ে অনড় থাকে এবং কিশোরী নিজেকে প্রাপ্ত বয়স্ক হিসেবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল করে। যদিও ওই জন্মসনদ ভুয়া বলেছে স্থানীয়রা।
১৪ মে বিকেলে কিশোরীর মা বাদী হয়ে বৃদ্ধ সামছুল হকের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ২/৩ জনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে লালমাই থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে উপজেলার পেরুল উত্তরের হরিশ্চর স্কুল সংলগ্ন ভাড়া বাসা থেকে সামছুল হককে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় পুলিশ ওই কিশোরীকেও উদ্ধার করেন।
শুক্রবার দুপুরে কুমিল্লার আমলী আদালত নম্বর ৯ এর দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সামছুর রহমানের আদালতে কিশোরীর জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়। একই আদালত বৃদ্ধ সামছুল হককে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
এদিকে নিজের নাম ব্যবহার করার বিষয়টি জানতে পেরে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাজী মুজিবুর রহমান উল্লেখিত কাবিননামা তার কার্যালয়ে রেজিস্ট্রি হয়নি মর্মে গত ১৪ মে কুমিল্লা কোতয়ালী থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
শুক্রবার দুপুরে লালমাই থানা পুলিশ কোতয়ালী থানা পুলিশের সহায়তায় লাকসামের আজগরা ইউপি নিকাহ রেজিস্ট্র্রার গোলাম সারওয়ার মজুমদারকে কোতয়ালী থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে।
লাকসামের আজগরা ইউপি আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী আবদুল লতিফ বলেন, মাওলানা গোলাম সারোয়ার মজুমদার আজগরা ইউপির সরকারি নিকাহ রেজিস্ট্র্রার। এছাড়া তিনি আমাদের ইউপি আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
লালমাই থানার ওসি মোহাম্মদ আইয়ুব বলেন, বৃদ্ধ সামছল হককে আদালতের নির্দেশে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। আদালত ভিকটিমের জবানবন্দী গ্রহণ করেছেন। প্রতারণার মাধ্যমে অন্যের নাম, সীল, কাবিন ব্যবহার করে কাবিন সৃষ্টির অভিযোগে গোলাম সারোয়ার মজুমদার নামে একজনকে গ্রেফতার করেছি। তাকে নিয়ে অন্যদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
শুক্রবার বিকেলে কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটের ৯ নম্বর আমলী আদালতে এই অসম দম্পত্তিকে হাজির করা হয়। আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট শামসুর রহমান উভয় পক্ষের শুনানী শুনে বৃদ্ধ রিকশাচালক শামসুল হক শামুকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করেন আর কিশোরীকে মামলার বাদী তার মায়ের জিম্মায় দিয়ে দেন।
লালমাই থানার ওসি মো. আইয়ুব জানান, কাবিননামায় দেখা যায় গত ১০ মে কুমিল্লা সিটি কর্পোশেনের ৭ নম্বর ওয়ার্ড এর নিকাহ রেজিষ্ট্রার মুজিবুর রহমান সরকারের কার্যালয়ে ৫ লাখ টাকা মোহরানায় বই নম্বর ৫৪, পৃষ্ঠা নম্বর ২৮ ও ক্রমিক নং ৪৪০-এ তাদের বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়। কিন্তু আমরা ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে জেনেছি, কাজী মজিবুর রহমান সরকার বিবাহ পড়াননি। তার নাম ব্যবহার করে লাকসামের গোলাম সারওয়ার মজুমদার অসততার আশ্রয় নিয়ে বিবাহ পড়িয়েছে। তাকে গ্রেফতার করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেন যে, কাজি অফিসের ঠিকানা ও সিল মোহর তিনি ভুয়া দিয়েছেন।
কিশোরী সন্তানকে পেয়ে মেয়ে অপহরণ মামলার বাদী ও কিশোরীর মা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, শামু আমাদের সরলতা ও বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার অবুঝ এই মেয়েকে সর্বনাশ করেছে। প্রশাসন যেন শামুর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয় যাতে আর কোনো লম্পট কোনো মেয়ের এমন সর্বনাশ করতে না পারে।