কুমিল্লার যে রাস্তার শেষ সীমানা আফগানিস্তানের কাবুল!
কালের আবর্তে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহাসিক গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড। এক সময় গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড উপমহাদেশে ‘সড়ক এ আজম’ নামে পরিচিত ছিল। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, পাসপোর্ট-ভিসার কোনো ঝক্কি না থাকলে এই রাস্তা ধরেই আপনি আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত যেতে পারবেন।
চার শতাব্দীর পুরাতন এ সড়কটি কুমিল্লা তথা বাংলাদেশ অংশে অস্তিত্ব হারাতে বসলেও দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশে তা এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে এশিয়ান হাইওয়ে হিসেবে। যা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড ঐতিহ্যের সাক্ষ্য হয়ে আছে।
মুঘল আমলে শুরু হওয়া এই সড়কটি আশির দশকের শুরুতে ঢাকা চট্রগ্রাম মহাসড়কের একমাত্র স্থল পথ ছিল। যা কুমিল্লা শহরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এখনো কুমিল্লা নগরীর চকবাজার এলাকার প্রাচীন কোনো কোনো দোকানের সাইনবোর্ডে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড লেখা রয়েছে কালের সাক্ষী হিসেবে।
আশির দশকের শুরুতে ঢাকা চট্রগ্রাম মহাসড়কের হাইওয়ে শুরু হলে একেবারেই অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে ঐতিহ্যমন্ডিত এই সড়কটি।
১৫৩৭ সালে মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের সেনা প্রধান হিসেবে শের শাহ বাংলা জয় করেন। এর তিন বছর পর ১৫৪০ সালে এ অঞ্চলে তিনি আফগান শুরি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫৪১ থেকে ১৫৪৫ সালের মাত্র পাঁচ বছরের শাসনামলে শের শাহ’র তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করা হয় ‘সড়ক এ আজম’।
তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লার শহরের ওপর দিয়ে যশোর হয়ে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া ও পাকিস্তানের পেশোয়ারের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত বিস্তৃত এ সড়কটি।
২ হাজর ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কটি উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিম অংশকে সংযুক্ত করেছে। ওই আমল থেকেই সড়কটি মূল সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পরবর্তী পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার ‘সড়ক এ আজম’ই সড়কটির নামকরণ করেন গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড নামে।
গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডটি নির্মিত হওয়ার পর থেকে বেশ কয়েকবার এটি সংস্কার করা হয়। এর মধ্যে প্রথম সংস্কার করেন মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজারা। ১৮৩৩ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত সড়কটির আরেক দফা সংস্কার করে বৃটিশ সরকার। তখন তারা এর নামকরণ করে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড। এর আগে অবশ্য বিভিন্ন সময়ে তৎকালীন শাসকরা শাহ রাহে আজম, সড়কে আজম, বাদশাহী সড়ক ও উত্তর পথ হিসেবেও চিহ্ণিত করেছেন সড়কটিকে।
বর্তমানে ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তান শের শাহ’র নির্মিত এ সড়কটি এশিয়ান হাইওয়ে হিসেবে ব্যবহার করলেও বাংলাদেশে এর চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে যে অংশটুকু এখনও ঐতিহাসিক এই সড়কটির সাক্ষ্য বহন করে চলছে তার অবস্থা চরম শোচনীয়।
জানা গেছে, বাংলাদেশে সড়কটির অস্তিত্ব রয়েছে কেবলমাত্র যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলায়। শের শাহ সড়ক নামে উপজেলার প্রবেশমুখ থেকে বিপরীত দিকের শেষ সীমানা পর্যন্ত মাত্র ৩৭ কিলোমিটার, বর্তমানে আঞ্চলিক সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আশির দশকের শুরুতে ঢাকা চট্রগ্রাম মহাসড়কে বাইপাস হওয়ায় এ অঞ্চলে অস্তিত্ব হারায় গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড নামক সড়কটি।
গবেষক ও লেখক আহসানুল কবীর বলেন, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও দীর্ঘতম সড়ক পথ। দুই শতাব্দীরও অধিক সময় এটি উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিম অংশকে সংযুক্ত করে রাখে। এটি বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থেকে শুরু হয়ে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া হয়ে পাকিস্তানের পেশাওয়ারের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত পৌঁছায়। এর আগে বিভিন্ন নামে উত্তরপথ, শাহ রাহে আজম, সড়কে আজম, বাদশাহী সড়ক নামে পরিচিত ছিল।
গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডে বিস্তৃত রুট মৌর্য সাম্রাজ্যের সময় থেকে ছিল। এটি গঙ্গার মুখ থেকে সাম্রাজ্যের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আধুনিক সড়কের পূর্ববর্তী সংস্করণটি সম্রাট শের শাহ শুরি নির্মাণ করেন। তিনি ঘোড়ার ডাকেরও প্রচলন করেন। এতে প্রাচীন মৌর্য সড়কের সংস্কার ও বর্ধিত করা হয়। ১৮৩৩ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে ব্রিটিশরা এর আরো সংস্কার সাধন করে।
কুমিল্লার এই গবেষক বলেন, গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। ঢাকা থেকে কুমিল্লা নগরীর ওপর দিয়ে চট্রগ্রামে যানবাহন চলাচল করতো । এটিকে বলা হতো গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড। কুমিল্লা শহরের চকবাজার রোডটির দুই পাশের সব দোকান পাট ও অফিসের সাইন বোর্ডে শোভা পেত গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড হিসেবে। ইতিহাসের ঐতিহ্য ধরে রাখার স্বার্থে তিনি এই নামটি আবার সংযোজনের দাবি জানান।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক নাসিম আরা বেগম জানান, নির্মাণের পর থেকে কয়েক শতাব্দী ধরে উপমহাদেশের ভেতর স্থলপথে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্থানে এ সড়কটি ব্যবহৃত হচ্ছে এশিয়ান হাইওয়ে হিসেবে।
তিনি বলেন, ইতিহাসকে টিকিয়ে রাখতে ওই দেশগুলোর সরকার সময়ের সঙ্গে সড়কটির সংস্কারের ধারা অব্যাহত রেখেছিল। ফলে সড়কটি সেখানে আজো শের শাহ’র নির্মাণ কীর্তিকে অমর করে রেখেছে। দেশে অস্তিত্ব সংকটে পড়া সড়কটিকে টিকিয়ে রাখতে সমন্বিত উদ্যোগের বিকল্প নেই।
সাংস্কৃতিক সংগঠক শাহজাহান চৌধুরী গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে বলেন, কুমিল্লা হাই স্কুলের ছাত্র থাকাবস্থায় কুমিল্লা শহরের শাসনগাছা হয়ে পুলিশ লাইন, ফৌজদারী, মোগলটুলি, রাজগঞ্জ, চকবাজার দিয়ে শুয়াগাজি পর্যন্ত রাস্তাটিকে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড বলা হতো। যদিও ঢাকা চট্রগ্রাম সড়কের কুমিল্লার এই অংশটিসহ পুরোটাই গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড। তারপরেও মানুষ কুমিল্লার এই অংশটিকেই গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড বলে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডেও এই অংশে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড লেখা থাকতো। তখন কুমিল্লা শহরের ওপর দিয়ে বাস চলাচল করতো। হাই স্কুলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাসের আসা যাওয়ার এই শোন শোন শব্দ পেতাম।
সাংস্কৃতিক সংগঠক শাহজাহান চৌধুরীর দাবি, ইতিহাসের ঐতিহ্য রক্ষার্থে এবং বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মের সঠিক ইতিহাস জানার স্বার্থে কুমিল্লা শহরের চকবাজার থেকে সদর দক্ষিণ উপজেলার শুয়াগাজি পর্যন্ত রাস্তাটির আগের নামকরণ গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলকে দ্রুত উদ্যোগী ভূমিকা নিতেও তিনি আহবান জানান।
সূত্রঃ ডেইলি বাংলাদেশ