কুমিল্লার “ডেলনী হাউস” সমৃদ্ধ এক অতীতের স্বাক্ষী
আহসানুল কবিরঃ বিগত দুইশত বছর ধরে আদালতের পাশে শহরবাসীর আগ্রহের কেন্দ্র বিন্দু হয়ে সবুজ শ্যামলিমায় সগৌরবে যে বাড়ীটি দাড়িয়ে আছে সেটিই ডেলনী হাউস। আলিশান এই বাড়ীটি আনুমানিক ১৮১৫ সনে নির্মিত হয়।তাদের আদি নিবাস ফ্রান্সের ভিলেজ অব দ্যালোনীতে। পিয়েরে যোশেফ ডেলনী নামে একজন নৌ কর্মকর্তা আনুমানিক ১৮০০সনের দিকে ভাগ্যের অন্বেষনে নিজস্ব দুটি স্কুনার নিয়ে প্রথম ভারতবর্ষে আসেন। ডেলনী এখানে মসলা, লবন,কাপড় ইত্যাদি নিয়ে ইউরোপে বিক্রয় করতেন। ফলে অল্পদিনের মধ্যে তিনি বিত্তশালী হয়ে উঠেন।
এসময় সমুদ্রপথে তার সাথে পরিচয় ঘটে ভাগ্যের অন্বেষনে আসা কুর্জন(কার্জন কুটির)পরিবারের। তাদের নিকট থেকে ডেলনী জানতে পারেন সন্দীপ এলাকায় ফরাসী ঘাটির আশেপাশে ফরাসীদেরকে জমি লিজ দেয়া হবে। ডেলনী তখন তাদেরকে নিয়ে চট্টগ্রামের বাবুঘাটে(বর্তমানে সদরঘাট) নোঙর করেন এবং একটি হাউসবোট ভাড়া করেন। হাউসবোটযোগে তারা চলে যান কলকাতা চন্দ্র নগরে।
কুর্জন ত্রিপুরা রাজপরিবারের ক্লার্ক হিসাবে যোগ দেন অপরদিকে ডেলনী ভুলুয়া,সন্দীপ এবং হাতিয়াতে প্রচুর জমি ক্রয় করেন। এছাড়া তিনি সরকার থেকেও প্রচুর পরিমানে জমি লীজ নেন। এটি ১৮১৫ এর আগের কথা। এসময় মিঃ ডেলনী এ এলাকার একচ্ছত্র জমিদারে পরিণত হন। কিন্তু নদী ভাঙ্গনে তার জমিদারীর বিশাল অংশ তলিয়ে গেলে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন।এই অবস্থায় তিনি নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর ও বসবাসের উপযোগী স্থান হিসাবে ত্রিপুরা রাজার অধীনস্হ চাকলা রৌশনাবাদের মেহেরকুল(বর্তমান কুমিল্লা শহর) পরগণাকে বেছে নেন। কুমিল্লা শহরে নতুন এক সাম্রাজ্যের ভিক্তি স্হাপন করলেন তিনি এবং তার বংশধররা। তারা পরবর্তীতে হোমনাবাদ পরগণার লাকসামে, নূরনগর পরগণার শালদা নদীর পাড়ে, চাঁদপুরে এমনকি ঢাকার শেরে বাংলা নগর এলাকায় প্রচুর পরিমাণে ভূ-সম্পত্তি ক্রয় করেন।
কুমিল্লায় আদালতের পাশে ডেলনী নির্মাণ করেন এক সুরম্য অট্টালিকা। এই বাড়ীটি ১৭একর(১৭০০ শতক) জায়গার উপর। যদিও বর্তমানে তা ৯ একরে পরিণত হয়েছে বিবিধ কারনে। প্রাসাদোপম এই বাড়ীটি আনুমানিক ২০০ বছর পূর্বে নির্মিত। ১০০০০ (দশ হাজার) বর্গফুটের অধিক জায়গা নিয়ে নির্মিত একতলা বাড়ীটিতে মোট ১৬ টি কক্ষ, ৫০টির অধিক দরজা, ১৫টি জানালা, ৮টি টয়লেট, একটি কিচেন রয়েছে। পুকুর রয়েছে দুইটি। চারদিকে সবুজের সমারোহ। ঠিক সদর দরজার সামনেই শানবাঁধানো ঘাট। বারান্দায় রয়েছে জাহাজ থেকে জাহাজে নিক্ষেপযোগ্য একটি ভারী মর্টার শেল। ড্রইং রুমে ১৬০ বছরের পুরানো একটি সিলিং ফ্যান হিমেল হাওয়ার পরশ দিয়ে যাচ্ছে এখনো। সাথে আছে জিইসি কোম্পানি নির্মিত একই সময়ের একটি রেগুলেটর।
ভিক্টোরিয়ান প্যাটার্নের চুন সুরকী এবং লোহার পাত দিয়ে তৈরী আনুমানিক ১৫/১৬ ফুট উঁচু ভবনটি ছবির মত ছিমছাম পরিপাটি করে সাজানো। অভিজাত এই বাড়ীতে জেনারেটর এর আগমন ঘটে আরপি সাহার জেনারেটর এর ও পূর্বে। দেয়ালে শোভা পাচ্ছে পূর্বপুরুষদের ছবি। তেমনি একটি ছবি ব্রাইস জিন ব্যাপ্টিস্ট রেনার্ড ব্যারন এর। যিনি ১৮৫৪ সনে মৃত্যু বরণ করেন। চাকরী করতেন মিশরে। নেপোলিয়ন বেনাপোর্ট এর অধীনে চাকুরীতে ছিলেন। ১৮১৪ সনে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে প্রমোশন পান। ত্রিপুরা ও কুমিল্লার সেটেলমেন্ট অফিসার মিঃ থম্পসন সাহেবের ১৮১৮ সনে প্রদত্ত একটি স্টেটমেন্ট থেকে জানা যায় পিয়ারে যোসেফ ডেলনী ১৮৫৯ সনে মৃত্যু বরণ করেন। তাকে বিষ্নুপুর কবরস্থানে কবরস্থ করা হয়। সেখানেই তাদের পারিবারিক কবর।
তাঁর পুত্রের সময় থেকে এ পরিবারের গৌরবগাঁথা এগিয়েছে অতি দ্রুত। এ পরিবারের লোকজন অত্যন্ত সৌখিন ছিলেন। তার প্রমাণ আমরা পাই বর্তমান প্রজন্মের কাছে সংরক্ষিত দুটি দাওয়াতপত্র থেকে। ১৮৯০ এবং ১৮৯৫ সনে সিংহ প্রেস থেকে মুদ্রিত এদুটো দাওয়াতপত্রে রোববার ছুটির দিনকে সামনে রেখে শনিবার রাত নয়টায় সকলকে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এটা যে নৈশভোজ,পানাহার সহ সমগ্র রাত্রি জাগরণের আমন্ত্রণ তা বুঝতে নিশ্চয় অসুবিধা হওয়ার কথা না। ডেলনী পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের রিচার্ড রেইমন্ড ডেলনী এবং পরিবারের অপরিহার্য সদস্য পল এলবার্ট ডেলনী ববি মনে করেন অনুষ্ঠান দুটি টাউন হলে হয়েছিলো। যুক্তির বিচারে সেটি মনে হয়না। কুমিল্লা শহরে তখন এতো জনারণ্য ছিলোনা। সন্ধ্যার পর সড়কগুলো ফাঁকা হয়ে যেতো। টাউন হল থেকে গভীর রাতে কিংবা ভোরে বাড়ী ফেরা বিপদজনক ছিলো। পক্ষান্তরে ডেলনীদের বাড়ীর সীমানা টাউন হল থেকেও অনেক বড় ছিলো। নিজস্ব জেনারেটরে পুরো বাড়ীতে বিদুৎ সরবরাহ করা হতো। নিশি যাপনের জন্য অনেকগুলো সুপরিসর কামরা ছিলো। ফলে এ আয়োজনটি তাদের নিজস্ব আঙ্গিনায় হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী।
ত্রিপুরা রাজ পরিবারের সাথে এই পরিবারের মধুর সম্পর্ক ছিল সর্বজনবিদিত। দুই পরিবারের মধ্যে উপহার বিনিময় হত। সমাজ সেবায় তাঁদের অবদান অসামান্য। কুমিল্লা জজকোর্ট মসজিদের জায়গাটি জমিদার তফাজ্জল আহমেদ চৌধুরীর মাধ্যমে ফক্সি ডেলনীর দান করা।
ফক্সি ডেলনীর ছেলে পল আই ডেলনী এবং ফিল জে ডেলনীর সময়ও তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে। ১৯৩৯ সনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ফিল জে ডেলনী ১৪তম ডিভিশনের কমান্ডার জেনারেল স্মিথ এর অধীনে তাতে অংশ নেন এবং যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করেন। এসময় বৃটিশরা তাদের বাসভবনটিকে সার্জিক্যাল হাসপাতালে রুপান্তর করেন। যুদ্ধ শেষে তিনি পূনরায় ব্যবসা বাণিজ্যে মনোনিবেশ করেন এসময় তিনি ব্যবসা ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি করেন। এতদঅঞ্চলের প্রথম তেলের পাম্প বার্মা ইষ্টার্ণ পাম্পের প্রতিষ্ঠা করেন ফিল। তার মালিকানায় অনেকগুলো বাস,ট্রাক, ও লঞ্চ ছিলো যেগুলো সারা বাংলাদেশে চলাচল করতো। কুমিল্লা এয়ারপোর্ট নির্মাণের সময় এর নির্মাণ কাজের একটা অংশের ঠিকাদারী পান ফিল ডেলনী। জেমস ফিনলে টি কোম্পানিতে তাদের অংশীদারিত্ব ছিল। কুমিল্লার তৎকালীন সময়ের অনেক ব্যাংকের শেয়ার কিনেছিলেন তাঁরা। ফিল ডেলনী ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন অপরদিকে পল প্রশাসনের উচ্চস্তরের লোকজনের সাথে মেলামেশা করতেন বেশী। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা প্রায়শই পলের আমন্ত্রণে ডেলনী হাউসে আসতেন।
পাকিস্তান আমলে ডেলনীদের নিজস্ব এরোপ্লেন ছিলো। পাইপার কাপ নামীয় প্লেনটিতে পাইলট এবং কো পাইলট ছাড়াও আরো দুজন বসতে পারতেন। প্লেনটি চালানোর জন্য ইউরোপীয় একজন পাইলটও রাখা হয়েছিলো। তাদের প্লেনে কুমিল্লা শহরের গন্যমান্য ব্যক্তিরা আরোহন করেছেন।কুমিল্লা মোহামেডান ক্লাবের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ফিল ডেলনী এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি আমৃত্যু মোহামেডান ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। তাদের বিত্ত বৈভব আর সম্পদের প্রাচুর্য পুরো শহর জুড়েই বিস্তৃত ছিলো। বর্তমান ইসলামপুর এলাকার অধিকাংশ ভূমির মালিকানা তাদেরই ছিলো। এখানে তাদের ঘোড়ার আস্তাবল ছিল। যদিও গোমতী নদীর তীরবর্তী এজায়গাটি ডেলনীরা ক্রয় করেছিলেন ডক ইয়ার্ড নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে। ফারুকী হাউস সংলগ্ন এলাকার নিজস্ব ঘাট থেকে তাদের লঞ্চ গুলি আগরতলা ও অন্যান গন্তব্যস্থলের উদ্দশ্যে ছেড়ে যেত। আমরা বর্তমানে যে রাস্তাটিকে ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড় হিসাবে চিনি সেখানে তাদের ফক্স হান্টিং এর কুকুরগুলো রাখা হতো। নিউ মার্কেটের পাশেই জেলা শিক্ষা অফিসটিও একসময় ডেলনীদেরই ছিলো। এটি ছিলো তাদের কান্দিরপাড়ের বাসভবন। তবে এটি কিভাবে হাতছাড়া হলো এ প্রশ্নের উত্তর বর্তমান ওয়ারিশদের জানা নেই। কুমিল্লা ক্লাব এবং জিলা স্কুলের মধ্যবর্তী জায়গাটিও ডেলনী পরিবারের। কুমিল্লা টাউন হলের দলিলের চৌহদ্দিতেও ডেলনী কম্পাউন্ডের কথা বলা আছে। এর একটি কারন হতে পারে জিলা স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক এইচ জি লেজিস্টার বিয়ে করেছেন ডেলনী পরিবারে।
শহরেরর বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহন ছিলো। জজকোর্ট মসজিদ নির্মাণে ভূমি প্রদান, কুমিল্লা মোহামেডান ক্লাবকে পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও কুমিল্লা শহরের সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলো ডেলনী পরিবার। ভার্নাল থিয়েটার এ এলাকার সবচেয়ে প্রাচীন নাট্য সংগঠন। ১৯০৮ সালে এর জন্ম। ভার্নাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই ডেলনী পরিবার এশহরে নাট্যচর্চা শুরু করে। তাদের উদ্যোগে ডেলনী হাউস এবং টাউনহলে অসংখ্য নাটক এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়।ভার্ণাল থিয়েটার ও অন্যানদেরকে তারা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন অকৃপণ ভাবে। নাট্যগুরু সাঈদ আহমেদ তাঁর “জীবনের সাত রং” বইয়ে লিখেছেন ১৯৪৯ সনে তারা সেক্সপিয়ারের “মার্চেন্ট অফ ভেনিস” নাটকটি মঞ্চস্থ করতে কুমিল্লা আসলে ডেলনীদের বাসায়ও একটি শো তারা পরিবেশন করেছিলেন এবং সেখানেই তাদের আপ্যায়ন ও নৈশযাপনের ব্যবস্হা করা হয়।কুমিল্লায় একটি জিমখানা ক্লাব তাঁরা পরিচালনা করতেন। জিমখানা ক্লাবের উদ্যোগে যে স্হানটিতে নিয়মিত ঘোড়াদৌড় প্রতিযোগীতা হতো সেটিই আজকের রেইসকোর্স। শহরের চার্চ সমুহে তাদের অর্থানুকল্য ছিলো। শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। মিশনারী স্কুল, জিলা স্কুল এবং ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্নে তাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা রয়েছে।
কুমিল্লা জেলার প্রথম প্রাইভেট কারটি তাদের। যার নাম্বার হচ্ছে ইবিটি-১(ইষ্ট বেঙ্গল টিপারা-১)। দুজন ড্রাইভার পালাক্রমে চালাতেন একজনের নাম তাহের আরেকজন ফক্কু। বাংলাদেশে প্রথম রিক্সা আনেন ফিল ডেলনী। ১৯৩৯ সনে তিনি কলকাতা থেকে শখ করে রিক্সা আনেন। কবি শামসুর রাহমান, নাট্যগুরু সাঈদ আহমদ এবং সত্যেন সেনের লেখায় আমরা পাই ঢাকা শহরে তারও পরে রিক্সার আগমন ঘটে।
ঐতিহ্যবাহী এই বাড়ীর বেশীরভাগ এখন দেশের বাইরে থাকেন। মিসেস মীরা ডেলনী, রিচার্ড রেইমন্ড ডেলনী, পল এলবার্ট ডেলনী ববি সহ তাদের কিছু অংশ বর্তমানে এখানে বাস করেন। তারা আমাদের এই মাটিরই অংশ হয়ে আছেন। অত্যন্ত বন্ধু বৎসল মানুষ রিচার্ড এবং ববি ভাই। তাদের মধ্যে আমি কখনো অহংকারের ছিটে ফোটাও লক্ষ করিনি। তথাপিও অনেকে তাদের ভুল বোঝেন। আমি বলবো এটি আমাদের বোঝার অক্ষমতা। আগামীতে তাদেরকে নিয়ে বড় পরিসরে কাজ করার আশা রাখি।
তথ্য সুত্রঃ
১.ডেলনী হাউসে রক্ষিত দলিল দস্তাবেজ
২.রিচার্ড রেইমন্ড ডেলনীর সাথে কথপোকথন
৩.পল এলবার্ট ডেলনীর সাথে কথপোকথন
৪.ঢাকা আমার ঢাকা -শামসুর রাহমান
৫.জীবনের সাত রং- সাঈদ আহমেদ
৬.আত্মজৈবনিক -বুদ্ধদেব বসু