কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যুগ
ডেস্ক রিপোর্টঃ ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা’র ময়নামতি সংলগ্ন লালমাই পাহাড়ের পাদদেশ ঘিরে অবস্থিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি)। দেশের ২৬তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ২০০৬ সালে এটি যাত্রা শুরু করে। ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ ছাত্র-ছাত্রীদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠে ক্যাম্পাস। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত, বিভিন্ন পরিবার থেকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এসে যেন নতুন একটি পরিবার খোঁজে পায়। নিয়মিত কাস-পরীক্ষার ফাঁকে হঠাৎ করেই জমে ওঠে আড্ডা-গান আর কৌতুকের আবহ। সময়ের পরিক্রমায় প্রাণোচ্ছলতা ও তারুণ্যের দীপ্যমান শিখায় শিক্ষার্থীরা গড়ে তুলছে জ্ঞানচর্চার এক নতুন ভুবন।
ইতিহাস বলে, আজ থেকে প্রায় ১৩০০ বৎসর পূর্বে (৭ম-৮ম শতাব্দী) পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার আতুড়ঘর ছিলো কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের পাদদেশের এই ময়নামতি শালবন বিহার। বিহার মানে বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে বিশ্বমানের জ্ঞানচর্চা হতো বলেই একে বিহার নামে অভিহিত করা হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে জ্ঞানপিপাসুরা ছুটে আসতেন তাদের জ্ঞানের ঝুলিকে সমৃদ্ধ করতে। সময়ের পরিক্রমায় বিহারের সেই প্রাচীন অবয়ব আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। তবে ইতিহাসের পূনরাবৃত্তির মাধ্যমে শালবন বিহারের কোলঘেষা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) নতুন করে দেশের মধ্য-পূর্বাঞ্চলের মানুষের জন্য জ্ঞানের বার্তা নিয়ে এসেছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অনতিদূরে কুমিল্লার কোটবাড়ি সংলগ্ন শালবন বৌদ্ধ বিহারের পাশে অবস্থিত এই বিদ্যাপীঠ। কুমিল্লা শহর থেকে যার অবস্থান প্রায় ১০ কি.মি. পশ্চিমে। কোলাহলমুক্ত সবুজ-শ্যামল এই ক্যাম্পাস তাই সহজেই টানে সবাইকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনাগুলোর ছাদে ওঠলে দেখা যাবে উঁচু-নিচু টিলাসম ‘একখ- দার্জিলিং’! প্রকৃতির নিবিড় ছোঁয়ায় বেড়ে ওঠা সারি সারি বৃক্ষরাজি মন কাড়ে দর্শনার্থীদের। সারাবছর দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ নানা প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
মাত্র ৭ টি বিভাগ, ১৭ জন শিক্ষক ও ৩ শতাধিক শিক্ষার্থী নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। সময়ের পরিবর্তনে আজ বিশ^বিদ্যালয়ে ৬টি অনুষদে ১৯ টি বিভাগে ২ শতাধিক শিক্ষক ও প্রায় ৬ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছেন। একে একে ১২টি আবর্তন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে। একইসাথে প্রায় ৬টি আবর্তন তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে তাদের কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন।
অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে বেশকিছু প্রায়োগিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের উদ্যোগ ও বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় আইকিউএসি (ইন্সটিটিউশনাল কোয়ালিটি এস্যুরেন্স সেল) নামক একটি প্রকল্প বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার গুনগত মান নিশ্চিত করে মানসম্মত গ্র্যাজুয়েট তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রকল্প পরিচালক রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সৈয়দুর রহমানের পরিচালনায় বিভিন্ন সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শিক্ষা মানসম্মতকরণে গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করা হয়।
বিশ^বিদ্যালয়ে অন্যান্য শিক্ষামূলক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যে রয়েছে সায়েন্স কাব, আইটি সোসাইটি, থিয়েটার, প্রতিবর্তন, অনুপ্রাস, প্ল্যাটফর্ম, বিএনসিসি, রোভার স্কাউট, বন্ধু, অনুস্বার ইত্যাদি। এসব সংগঠন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও মানসিক উন্নয়ন সাধনে ভূমিকা রাখে।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই প্রতিষ্ঠার একযুগ পার করতে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বছর বছর বাড়ছে শিক্ষার্থীদের আগমন। তবে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্বদ্যালয়ের কাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছেনা। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের দোহায় দিয়ে প্রশাসন আমাদেরকে অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমবয়সী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়-ইত্যাদি) যেখানে আকাশচুম্বী ভবন ও যাবতীয় আধুনিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে সেই তুলনায় আমরা ‘কিছুই’ পাচ্ছি না।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টি নানা সমস্যায় জর্জড়িত। প্রতিষ্ঠার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সকল বিভাগের জন্য পর্যাপ্ত কাসরুম নেই। নেই কোনো সেন্ট্রাল অডিটরিয়াম। সেন্ট্রাল মাঠের কাজ যেখানে অনেক আগেই শেষ হওয়ার কথা সেখানে এটি বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে এখনো। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৬ হাজার শিক্ষার্থীর তুলনায় হল আছে মাত্র ৪ টি যেখানে সর্বোচ্চ ৭শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী হিজিবিজি করে থাকছেন। ক্যাম্পাস ও হলগুলোতে নেই কোনো ওয়াইফাই-নেটওয়ার্ক সুবিধা। প্রশাসনিক ভবনের পাঁচতলায় ছোট পরিসরে যে লাইব্রেরি রয়েছে তা প্রয়োজনের সিকিভাগও পূরণ করে না বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন দপ্তরের অবস্থাও নাজেহাল। শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বাস আছে মাত্র ৪টি। এছাড়া বিআরটিসির ভাড়া করা বাসগুলোরও ফিটিংস ঠিক নেই। ফলে মাঝে মাঝেই রাস্তাঘাটে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে শিক্ষার্থীরা ভোগান্তিতে পড়েন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯ টি বিভাগে প্রায় ২ শতাধিক শিক্ষকের মধ্যে ‘অধ্যাপক’ রয়েছেন মাত্র ৩ জন। তারা হলেন- ড. মো: জাকির ছায়াদউল্লাহ খান (অর্থনীতি বিভাগ), ড. মাসুদা কামাল (লোক প্রশাসন বিভাগ) ও ড. মোহাম্মদ সৈয়দুর রহমান (রসায়ন বিভাগ)। ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সমাপ্তি ঘটছে, অথচ একজন অধ্যাপকের সংস্পর্শ পাইনি’- বলে অনুযোগ করেছেন অন্যান্য বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী।
এরপরও শিক্ষার্থীরা এসব সমস্যা নিয়েই প্রতিদিন জমায়েত হচ্ছেন উচ্চশিক্ষার এই দ্বারে। নেপাল থেকে আসা বিদেশি শিক্ষার্থী মো: জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরূপ সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। তবে আশানুরূপ সুযোগ-সুবিধা তেমন কিছুই পাচ্ছি না। প্রশাসনের কাছে আমাদের চাওয়া থাকবে যাতে তারা ক্যাম্পাসের উন্নতির দিকে যাতে সুনজর দেয়।’ একই সুরে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী উম্মে কুলসুম বলেন, ‘অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় আমরা অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের অপ্রতুলতা পূরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে প্রশাসন সচেষ্ট হবে।’
প্রতিষ্ঠার এক যুগে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ করা হয়েছে ৬ জন অধ্যাপককে। এদের মধ্যে মাত্র ২জন তাদের পূর্ণ মেয়াদকাল (৪ বছর) শেষ করতে পেরেছেন। রাজনীতিক অসন্তোষ, শিক্ষকদের মধ্যে ‘গ্রুপিং’, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ধর্মঘট ইত্যাদির বলি হয়ে বাকি অধ্যাপকরা তাদের উপাচার্যের দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এহেন ক্রান্তিকালে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন কুমিল্লার কৃতিসন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী।
নতুন উপাচার্যের কাছে তাই বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের অনেক প্রত্যাশা। উপাচার্যও আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতি বিধানের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। আমি স্বপ্নবাজ মানুষ। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। সেসবের বাস্তব রূপ দিতে আমি সচেষ্ট হবো। তবে আমি একা তা পারবোনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলের সহযোগিতায় আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে সার্থক হব বলে মনে করি।’