কুমিল্লায় ‘পরিকল্পিত খুন’কে সড়ক দুর্ঘটনা বানাল পুলিশ !
ডেস্ক রিপোর্টঃ কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলায় একটি পরিকল্পিত খুনের ঘটনাকে সড়ক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। ঘটনাটি তদন্ত করার জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
গত বছরের ২৫ আগস্ট দিবাগত রাত ২টার দিকে উপজেলার মনোহরগঞ্জ-হাসনাবাদ সড়কের দাদঘর গ্রাম থেকে উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের অলি আহাম্মদের ছেলে ইসমাইল হোসেন বাবুলের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আট সন্তানের জনক এই ব্যক্তি তাঁর পরিবার নিয়ে প্রায় ১১ বছর ধরে দুর্গাপুর গ্রাম থেকে সাত কিলোমিটার দূরে বাইশগাঁও ইউনিয়নের লাকতমা এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন।
পরিবারের অভিযোগ, স্থানীয় সূত্র ও কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাবুলের লাশ উদ্ধারের পর তাঁর বাঁ গালে আঘাতের চিহ্ন ছিল। শরীরের আর কোথাও আঘাতের চিহ্ন ছিল না। স্থানীয় লোকজন ধারণা করে, বাবুলকে হত্যা করা হয়েছে।
বাবুলের ভাই ইউনুছ মিয়ার ভাষ্য, ঘটনার পর পুলিশ সড়ক দুর্ঘটনা ধরে নিয়েই একটি সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে লাশ মর্গে পাঠায়। পরদিন তাঁরা থানায় হত্যা মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। উল্টো হুমকি দিয়ে তাঁদের থানা থেকে বের করে দেয়। পরে সড়ক দুর্ঘটনার মামলা করে পুলিশ। মামলায় পুলিশ উল্লেখ করে যে ইসমাইল হোসেন বাবুল লাকতমা গ্রামের শ্বশুরবাড়ি থেকে দুর্গাপুর গ্রামে আসার সময় রাত ১২টার দিকে অজ্ঞাতনামা গাড়ির ধাক্কায় মারা গেছেন।
ইউনুছ জানান, ঘটনার পাঁচ দিন পর ওই বছরের ৩০ আগস্ট তাঁর ভাবি মরিয়ম বেগম আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় দুর্গাপুর গ্রামের আবদুল হক, আবুল হাসেম, ইসমাইল হোসেন, আবদুল হামিদসহ ৯ জনকে আসামি করা হয়।
ইউনুছের অভিযোগ, আসামিরা তাঁদের প্রায় ১৮০ শতক সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে। এ নিয়ে ২০০৭ সালে তাঁর ভাই বাবুল তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছিলেন। এর পর থেকে আসামিরা তাঁর ভাইকে খুনের হুমকি দিতে শুরু করে, যার কারণে তিনি অন্য গ্রামে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। তিনি আরো অভিযোগ করেন, হুমকি দেওয়ার ঘটনায় তাঁরা মনোহরগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছিলেন, কিন্তু পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
ইউনুছ বলেন, তাঁর ভাবি মামলা করার পর আদালত ঘটনা তদন্তের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ একজন আসামিকেও জিজ্ঞাসাবাদ না করে নিজেদের মনগড়া একটি প্রতিবেদন চলতি বছরের ৩ এপ্রিল আদালতে দাখিল করে। সেই প্রতিবেদনেও এই খুনের ঘটনাকে সড়ক দুর্ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয়। তাঁরা গত ৭ আগস্ট পুলিশের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করেন। আদালত নারাজি আমলে নিয়ে মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
গত মঙ্গলবার মামলাটি হাতে পেয়েছে পিবিআই। সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক মো. শাহজাহান কালের কণ্ঠকে বলেন, তদন্ত করে তাঁরা প্রকৃত ঘটনা জানতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদী।
যে রাতে বাবুলের লাশ উদ্ধার করা হয় তার ঘণ্টা দুয়েক আগে দাদঘর বাজারে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ওই গ্রামের আঠিয়াবাড়ীর মৃত ইলিয়াছ মেম্বারের ছেলে অটোরিকশাচালক মো. সবুজের। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি বাবুলকে তখন চিনতেন না। তাঁর সঙ্গে বাজারের একটি চায়ের দোকানে দেখা হয়েছিল। এরপর রাত ১২টার দিকে অটোরিকশা রাখতে গিয়ে সবুজ দেখেন বাবুল বাজারের কাছে মাদরাসার বারান্দায় শুয়ে আছেন। কথা বলার একপর্যায়ে জানতে পারেন, ভয়ে তিনি বাড়ি যাচ্ছেন না। পথে তাঁকে কেউ মেরে ফেলতে পারে—এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন তিনি।
সবুজ বলেন, তিনি বাবুলকে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি যাননি। মাদরাসার একটি কক্ষে শুয়ে পড়েছিলেন। সেখান থেকে চলে আসার আধাঘণ্টা পর একটি অটোরিকশাকে দ্রুতগতিতে মাদরাসার দিকে যেতে দেখেন তিনি। ওই অটোরিকশায় চার-পাঁচজন লোক ছিল, যাদের তিনি চিনতে পারেননি। অটোরিকশাটিকে থামার সংকেত দিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু থামেনি। ওই অটোরিকশার চালককে তিনি চিনতে পেরেছিলেন। পরদিন সকালে জানতে পারেন বাবুলের লাশ পাওয়া গেছে।
সবুজ বলেন, কিছুদিন আগে নাথেরপেটুয়া পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। তিনি সেদিন রাতের ঘটনা পুলিশের একজন কর্মকর্তাকে বলেছেন। এর পর থেকে তাঁকেও বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে মুখ বন্ধ করার জন্য। তবে কারা তাঁকে হুমকি দিচ্ছে তাদের পরিচয় জানেন না তিনি।
আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) দপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে সুবিচার চেয়ে আবেদন করে বাবুলের পরিবার। এর পরিপ্রেক্ষিতে কুমিল্লার লাকসাম সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপারকে (এএসপি) ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। সিনিয়র এএসপি নাজমুল হাসান রাফি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি অভিযোগের সুস্পষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ পাইনি।’
বাবুলের পরিবারের পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘ভিকটিম পক্ষ নিরীহ, আর আসামিরা প্রভাবশালী, যার কারণে খুব সহজেই আসামিরা পুলিশকে ম্যানেজ করে একটি পরিকল্পিত হত্যার ঘটনাকে দুর্ঘটনা বানাতে পেরেছে। এ ছাড়া ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে এমন কথা উল্লেখ করা হয়নি। এতে বোঝাই যায়, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আর আসামিদের সঙ্গে আঁতাত করে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করেছে পুলিশ।’
মামলার প্রধান আসামি আবদুল হক স্থানীয় বাইশগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। তিনি বলেন, নিহত বাবুল তাঁদের ১০টি পরিবারের ক্রয় সূত্রে মালিক হওয়া প্রায় ১৮০ শতক সম্পত্তি নিজেদের দাবি করে মামলা করেন আদালতে। গত ১৪ বছর তাঁরা সেই মামলা লড়ছেন।
বাবুলকে কখনো খুনের হুমকি কিংবা মারধর করেননি দাবি করে আবদুল হক বলেন, বাবুল মারা যাওয়ার পর কিছু মানুষের প্ররোচনায় তাঁর পরিবার তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তাদের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও কাল্পনিক।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মনোহরগঞ্জ থানার ওসি মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ঘটনাটি আমি এ থানায় যোগদানের আগের। আর আমি এসব ব্যাপারে কিছুই জানি না।’ আপনার যোগদানের পরই এই মামলার প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়েছে জানালে ওসি কোনো জবাব না দিয়ে মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি আর ধরেননি।
সূত্রঃ কালের কণ্ঠ